নদী কমিশন ‘কাগুজে বাঘ’

তায়েব মিল্লাত হোসেন, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৮ ডিসেম্বর ২০১৬, ০৮:৩০

দুই বছর আগের সেপ্টেম্বরে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে ‘কাগুজে বাঘ’ বলেছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল মতিন। কমিশনের আইন ও প্রতিষ্ঠার পরিস্থিতি দেখে এমন মূল্যায়ন ছিলো তার। দুই বছর পর এসে মূল্যায়ন কী?

‘নদী কমিশন দুর্বল প্রতিষ্ঠান। পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানতো কাগুজে বাঘই হয়। তারা আসল বাঘ হতে পারে না।’ দুই বছর আগের অবস্থানেই অনড় বাপার সাধারণ সম্পাদক।

এমন মন্তব্যের বিপরীতে কোনো যুক্তি তুলে ধরেননি নদী কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম। এই কমিশন আসলেই কী- কাগুজে বাঘ?

‘আপাতদৃষ্টিতে আমরা হয়তো কাগুজে বাঘ, কারণ আমাদের ক্ষমতা কম। তবে বাঘ ছিলো, বাঘ আছে, যদি ধরে বসে, ঘাড়ে চেপে বসে- জনমনে আমরা এমন একটা অবস্থান তৈরি করতে চাচ্ছি। এই হিসেবে আমরা আসলে অদৃশ্য বাঘ।’ ঢাকাটাইমসকে বললেন নদী কমিশনের চেয়ারম্যান।

কমিশন দিনে দিনে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে, এই কথা স্বীকার করলেন বাপার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিনও। তিনি ঢাকাটাইমসকে জানালেন, পরিবেশ ও নদী আন্দোলনে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কমিশন কিছু কিছু যোগাযোগ শুরু করেছে।

দেশের নদী-নদীর সুরক্ষায় ২০১৩ সালের জুলাই মাসে করা হয় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন। এর একবছরের বেশি সময় পর গঠিত হয় এই কমিশন। প্রতিষ্ঠার দুই বছর পার হলেও এখনো সক্রিয় একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজের জায়গা করে নিতে পারেনি নদী কমিশন। আলাপ-আলোচনা, প্রস্তাবনা, নদী দিবস উদযাপন, রচনা প্রতিযোগিতা আয়োজন, মাঠ জরিপ- এমন কিছু কাজেই সীমিত আছে তারা। নদী রক্ষায় এখনো কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি কমিশন।

এর পেছনে তহবিল ও জনবল সংকটকে দায়ী করলেন কমিশনের একাধিক সদস্য। জনবল কাঠামো এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে তারা জানান। আইনি সীমাবদ্ধতার কারণেই পরামর্শধর্মী প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা উঠে আসতে চাইছে। এভাবে নদী রক্ষার কাজ কতটুকু করা যাবে, তা নিয়ে তারা নিজেরাও অবশ্য শঙ্কার মধ্যে আছেন।

তবে সুপারিশ দিয়েও নদ-নদীর সুরক্ষায় ভূমিকা রাখা সম্ভব বলে মনে করছেন কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আইনে যেভাবে নির্দেশনা আছে, তাতে আমাদের সুপারিশ সংসদে পর্যন্ত আলোচনা হওয়ার কথা। আর সংসদে আলোচনা হলে পুরো জাতি জানবে। তখন জনসচেতনতা তৈরি হবে, আবার নদী দখলদাররাও সতর্ক হয়ে যাবে।’

জনবল কাঠামোর অপেক্ষায়...

আইন প্রনয়নের তিন বছর পার হলেও এখনো নদী কমিশনের জনবল অবকাঠামো চূড়ান্ত হয়নি। ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে সদস্যদের নিয়োগ করা হয়।

নদী কমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, পাঁচ সদস্য (এরমধ্যে একজন চেয়ারম্যান), ছয় কর্মকর্তা ও ১০ কর্মচারী; মোট ২১ জনবল নিয়ে চলছে কমিশন। তবে তিনজন সদস্য অবৈতনিক হিসেবে আছেন।

একটি সূত্র জানায়, কমিশন ২০১৫ সালে ১৫৯টি পদের প্রস্তাব দিলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন করেনি। কমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, পরে ১১০ জনের একটি জনবল কাঠামো করা হয়েছিলো। তা কাঁটছাট করে ৪৮ জনে দাঁড়ায়। এই প্রস্তাব সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেয়া হয়েছে। তা এখনো অনুমোদন পায়নি।

লোকবল নিয়োগ হলে নদী কমিশন গতিশীল হবে বলে মনে করছেন এর সার্বক্ষণিক সদস্য মো. আলাউদ্দিন। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কমিশন এখনো প্রাথমিক কাজ নিয়ে আছে। এখনো নদী সুরক্ষার প্রস্তুতিমূলক পর্ব চলছে। লোকবল নিয়োগ হলে পুরোদমে আমাদের কাজ শুরু হবে।’

লোকবল নিয়োগ হবে কবে, জানতে চাইলে নদী কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, চলতি ডিসেম্বর মাসের মধ্যে জনবল কাঠামো সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর অনুমোদন পাবে। জানুয়ারির মধ্যে লোক নিয়োগের পদক্ষেপ নেয়া যাবে বলে তিনি মনে করছেন।

ক্ষমতা কম, প্রয়োগে অনীহা

হবিগঞ্জের মাধবপুরে সোনাই নদীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বহুতল ভবন নির্মাণ করছে। নদী রক্ষার জন্যে এটি ঠেকাতে আন্দোলনে আছে বাপা। তারা এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেয় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে। কমিশন তদন্ত শেষে যে প্রতিবেদন দেয়, তাতে বলা হয়, ব্যক্তিগত জমিতে ভবন তৈরি হচ্ছে। তাদের এমন দায়সারা অবস্থানে ক্ষুদ্ধ বাপার সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল মতিন বলেন, ‘আইনগতভাবেই নদী কমিশনের ক্ষমতা সীমিত। কিন্তু যেটুকু ক্ষমতা আছে, তা প্রয়োগেও তাদের মধ্যে অনীহা দেখা যায়।’

সোনাই নদীর ঘটনায় কমিশন দখলদারদের পক্ষ নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন বাপার সাধারণ সম্পাদক। তা মানতে নারাজ কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, বিভিন্ন আমলের রেকর্ডপত্র, দলিল-দস্তাবেজ দেখে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে স্থাপনার কারণে সোনাই নদীর প্রবাহ যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ না হয়, সেদিকে তারা কড়া নজর রাখছেন। এ বিষয়ে স্থাপনা নির্মাতাদের সতর্ক করা হয়েছে। তারা নদীর কোনো ক্ষতি করলে ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান কমিশনের চেয়ারম্যান।

তবে আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে কমিশন সরাসরি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে না বলে জানান এর একজন কর্মকর্তা। নাম-পদবি প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘আইনে কমিশনকে সুপারিশধর্মী করে রাখা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে কমিশনের যে চেতনা, তা চিন্তা করলে ঠিকই আছে। কিন্তু আমাদের দেশে শুধু পরামর্শ কেউ মানতে চায় না। সুপারিশ এড়িয়ে যাওয়ার অনেক অজুহাত থাকে। আইন প্রয়োগের ক্ষমতাও থাকতে হয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের দেশে যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান নদীর ভালোমন্দ দেখে তারা সবাই নদী ব্যবহারকারী। তারা নদী রক্ষা করবে কিভাবে? নদী রক্ষা আর ব্যবহার এক বিষয় নয়। কেন্দ্রীয় নদী কমিশনের অনুমোদন ছাড়া ভারতের কোনো প্রদেশের কোনো প্রকল্প সচল হয় না। আমাদের দেশেও কমিশনকে এমন ক্ষমতাসম্পন্ন করতে হবে।’

নতুন প্রতিষ্ঠান হলেও নদী কমিশন দেড়-দুই বছর পর যে অবস্থানে আসার কথা ছিলো, কর্মকাণ্ডে ধীরগতির কারণে তা পারেনি বলে মনে করছেন এর অবৈতনিক সদস্য পানি বিজ্ঞানী ড. মমিনুল হক সরকার। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, কমিশন নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে আছে। মন্ত্রণালয়ের অধীনে রেখে একে সক্রিয় করা কঠিন। আইনি সীমাবদ্ধতা, বাজেট ও লোকবলস্বল্পতা- এসব কারণে কমিশন কাঙ্খিত অবস্থানে যেতে পারেনি বলে তিনি মনে করেন।

এ বিষয়ে নদী কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, নতুন একটি প্রতিষ্ঠান উঠে দাঁড়াতে কিছুটা সময় লাগে। কারণ প্রথমে নিজের জনবল, অবকাঠামো, সরঞ্জাম- এসব দিকে নজর রাখতে হয়। নিজে গুছিয়ে উঠার আগে মূল কাজে হাত দেয়া যায় না। তারপরও নদী রক্ষায় তৃণমূলে কমিশন বেশকিছু কাজ শুরু করেছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার নদীর তথ্য সংগ্রহ, জরিপের মতো কাজ শুরু হয়ে গেছে। নদী রক্ষায় স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করতেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।

সেই তেইশ দফার খবর কী?

এই ১৯ ও ২০ নভেম্বর কক্সবাজারে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত তথা বঙ্গোপসাগরের পারে দুই দিনের জাতীয় নদী সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল।

শেষ দিনে ২৩টি প্রস্তাবনার মাধ্যমে এর পর্দা নামে। প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেন নদী কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম।

এতে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের নদ-নদী ও জলাশয়ের সব তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশ করা হবে। নদী রক্ষার জন্য সবাইকে সম্পৃক্ত করে দখল-দূষণ প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এর মাধ্যমে টেকসই ব্যবস্থাপনায় নদীকেন্দ্রিক সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা হবে। নদীর উন্নয়নের মাধ্যমে প্রকৃতিবান্ধব পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্যে সামাজিক কার্যক্রম বাড়ানো হবে। এর জন্যে গণমাধ্যমেরও সহায়তা নেয়া হবে।

‘স্বাস্থ্যকর পর্যটন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য টেকসই নদী ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক এই সম্মেলনের ২৩টি প্রস্তাবনায় নদী, জলাভূমি বিষয়ক আইন, নীতি ও পরিকল্পনা পুনর্মূল্যায়ন ও হালনাগাদ করার কথা বলা হয়েছে। নদী সংরক্ষণ শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন এবং এ বিষয়ে পাঠ্যক্রম (প্রথম শ্রেণি-অষ্টম শ্রেণি) নদী পর্যটন অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব আছে। নদী ও জলাভূমি দূষণ ও দখল প্রতিরোধে এ বিষয়ক আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করার বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে।

২৩ দফা বাস্তবায়নে কী করছেন? এমন প্রশ্নে নদী কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মাত্রই প্রস্তাবনা এসেছে। এগুলো নিয়ে এখন প্রাথমিক পর্যালোচনা চলছে। পর্যায়ক্রমে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে এগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।’

ঢাকাটাইমস/০৮ডিসেম্বর/টিএমএইচ

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

কী বার্তা নিয়ে আসছেন ডোনাল্ড লু 

দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ে গ্রেপ্তার হন সাবেক রেলমন্ত্রীর এপিএস, যেভাবে উত্থান তার

‘মেড ইন জিনজিরা’: অবহেলিত সম্ভাবনার স্বপ্ন দুয়ার 

ইবনে সিনা হাসপাতালে রুশ কিশোরীকে যৌন হয়রানি: অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে পুলিশ

ভারতের রপ্তানির খবরে ১০ টাকা কমলো পেঁয়াজের দাম

অবন্তিকার আত্মহত্যা: এখনো মেলেনি তদন্ত প্রতিবেদন, থমকে গেছে আন্দোলন 

সড়কে এআইয়ের ছোঁয়া, বদলে যাচ্ছে ট্রাফিক ব্যবস্থা 

এখন তিন হাসপাতালে রোগী দেখছেন সেই ডা. সংযুক্তা সাহা

কোরবানির ঈদ সামনে, মশলার বাজারে উত্তাপ

প্রতিমন্ত্রীর শ্যালকের অপহরণকাণ্ড: ১৬ দিনেও গ্রেপ্তার হননি আলোচিত লুৎফুল হাবীব

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :