একটি চিঠি: সেই দিন আর এই দিন

দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেত্রী। প্রধানমন্ত্রী চীনে রাষ্ট্রীয় সফরে যাবার উদ্দেশে বিমানে উঠলেন। তাঁকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশের আকাশসীমা ছাড়াতেই দেশের একটি বাদে সবগুলো জেলায় একযোগে বোমা ফাটলো। সঙ্গে জঙ্গিবাদী জেএমবির লিফলেট। বোমাগুলো শক্তিশালী ছিল না। কোথাও কেউ হতাহত হয়নি। কিন্তু এ ঘটনা সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দিল বাংলাদেশে গোপনে বেড়ে উঠেছে জঙ্গিবাদ। এরপর আরো কয়েক জায়গায় আত্মঘাতী জঙ্গি হানায় হতাহতের ঘটনা ঘটলো। প্রধানমন্ত্রী জঙ্গিবাদ দমনে কঠিন প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। জাতির এ সংকটকালে আলোচনার আহ্বান জানিয়ে চিঠি লিখলেন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে।
চিঠিটি হুবহু তুলে ধরছি:
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
সম্মানিত বিরোধী দলীয় নেত্রী,
আসসালামু আলাইকুম।
আমার শুভেচ্ছে নিন।
আপনি জানেন দেশের বিভিন্ন জায়গায় নাশকতামূলক বোমা হামলা চালানো হচ্ছে। এতে নিরপরাধ মানুষ জীবন দিচ্ছেন, আহত হচ্ছেন, সম্পদেরও ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। পবিত্র ইসলামের নামে জনবিচ্ছিন্ন একটি বিপথগামী গোষ্ঠীর সুপরিকল্পিত এই সন্ত্রাসী তৎপরতায় আমাদের জননিরাপত্তা হুমকির সন্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় স্বার্থ ও ভাবমূর্তিরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। চলমান গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, সামাজিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিসহ আমাদের সাফল্য ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার চক্রান্ত চলছে।
আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন, সরকার ইতিমধ্যে পরিস্থিতি মোকাবেলায় সম্ভাব্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহন করেছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করার পাশাপাশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত গঠন এবং সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
পবিত্র ইসলামের অপব্যাখ্যা করে পরিচালিত এই তৎপরতায় আত্মঘাতী কৌশল বেছে নেয়ায় সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নেতিবাচক মাত্রা। তাই আমরা এই সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছি। এই জাতীয় সমস্যাকে জাতীয়ভাবে মোকাবেলাই সময়ের দাবি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ধরনের পরিস্থিতিতে দলমত-নির্বিশেষে সকলে মিলে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ ইতিবাচক ফল নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের জনগণও আজ আশা করছেন আমাদের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা। আমি আশা করি জনগণের সেই প্রত্যাশা ও দাবি সম্পর্কে দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতৃত্বও সচেতন রয়েছেন।
জাতীয় প্রতিটি প্রয়োজনের মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার অনুকূলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। স্বাধীনতার মহান সংগ্রাম, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগে এক সঙ্গে কাজ করার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের রয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এবারেও তার ব্যতিক্রম ঘটবে না। মত, পথ ও কৌশলের ক্ষেত্রে আমাদের পার্থক্য আছে, গণতান্ত্রিক সমাজে সেটা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু আজকের সমস্যা কোনো দলীয় বা রাজনৈতিক সমস্যা নয়- সারা জাতির সমস্যা। তাই যে কারো পক্ষে এককভাবে এ সমস্যার সমাধান করা দুরূহ। এ কারণে সমাধানের পথ নির্ণয়ে আমরা একটি জাতীয় সংলাপের আয়োজন করেছি। দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষাও তা-ই। আপনারা তাতে অংশ নিয়ে জনগণের প্রত্যাশা ও সময়ের দাবি পূরণ এবং ইতিহাস-নির্ধারিত কর্তব্য পালন করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।
সেই প্রত্যাশা থেকেই আমি আপনাদের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের সংগে আলোচনার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছি এবং আপনিসহ আপনার দলের প্রতিনিধিবৃন্দকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। জাতীয় এই সংলাপে আপনাদের সংগে আলোচনা সাপেক্ষে সময় ও তারিখ নির্ধারণ করা হবে।
আল্লাহ্ হাফেজ
আপনাদেরই
খালেদা জিয়া
৬। ১২। ০৫
এই আমন্ত্রণে শেখ হাসিনা সাড়া দেননি। এমনকি আওয়ামী লীগের তরফ থেকে চিঠির জবাব পর্যন্ত দেয়া হয়নি। পরে সরকারের একক চেষ্টায় অভিযান চালিয়ে শায়খ আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই সহ জঙ্গি নেতাদের আটক, বিচার ও তাদের কাঠামো ভেঙে ফেলা সম্ভব হয়।
আজকের দিনে সরকারের তরফ থেকে এমন জাতীয় সংলাপের আয়োজন এবং এ ধরণের সৌজন্যমণ্ডিত চিঠির কথা ভাবা যায় কী?
লেখকঃ লেখক ও সাংবাদিক এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব

মন্তব্য করুন