অনেক নিশানের জন্ম হোক বাংলাদেশে

খবরটি ক’দিন আগেই দেখেছিলাম একটি জাতীয় দৈনিকে।
একজন রিকশাচালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলের সামনে ফুটপাত পরিষ্কার রাখার জন্য ওখানে ফুল বিছিয়ে রেখেছেন। বেশ চমকে গিয়েছিলাম প্রথম ধাক্কায়। রিকশাচালক, যাদেরকে আমার মত ‘ভদ্রলোকেরা’ নিত্যদিন অপমান আর জোর-জুলুম করে থাকি, সেই শ্রমিক শ্রেণির একজন এমন চমৎকার একটি কৌশল উদ্ভাবন করেছেন জেনে বেশ সাহস পাচ্ছিলাম।
সাহস পাচ্ছিলাম এই ভেবে যে-
এবার বুঝি ‘আমাদের’ টনক নড়বে! এরপরে অবশ্য অন্য দশজন ‘মধ্যবিত্তের’ মতোই বিষয়টি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। মধ্যবিত্তের এই চরিত্রটি লক্ষ্য করেই সম্ভবত শামসুর রাহমান লিখেছিলেন- ‘খাচ্ছি-দাচ্ছি, চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছি, ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাচ্ছি......’! আমিও তো আর ‘ঝাঁকের’ বাইরে নই! তাই রিকশাচালকের বিষয়টি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে গিয়েছিলাম!ক’দিন আগে মতিঝিলে গিয়েছিলাম কি একটা কাজে। ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়টা একবার ঢু-মেরে আসাটা আমার বরাবরের অভ্যাস। সেদিনও সেটাই করছিলাম। শহীদ মিনার পেরিয়ে ফুলার রোডের কোন ধরে এস এম হলের সামনে দিয়ে পলাশীর দিকে এগোতেই ফুটপাতে গাঁদা ফুল নজরে এলো। মনে পড়লো কাগজের খবরটির কথা। সিএনজিটা থামিয়ে নেমে পড়লাম। মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় বেশকয়েকটি ছবি তুলে রাখলাম ফুল বিছানো ফুটপাতের।
ফুলার রোডের ঠিক উল্টোদিকে এস এম হলের কোনায় দেখি নিজের রিকশার উপরে পরম নিশ্চিন্তে ঘুম দিয়েছেন একজন রিকশাচালক। দিবানিদ্রা আর বলে কাকে। তারপাশেই অন্যকয়েকজন রিকশাচালক জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। বুঝলাম, আজকের মত আয়-রোজগার পকেটে এসে গেছে; তাই নিশ্চিন্তে আড্ডা।
ওদের জিজ্ঞেস করি সেই রিকশাচালকটি কোথায়, যিনি এই ফুলগুলো ফুটপাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন। উত্তর, ‘ও তো পলাশীর মোড়ে হলের গেটের কিনারেই থাকে’। কথা না বাড়িয়ে ওদিকে এগোই।
ঠিক গেটের কাছেই দেখা মিললো তার। রিকশাটি একজায়গায় রেখে নিজের জামা কাপড় ঠিকটাক করছেন। সামনে গিয়ে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ি- ‘আপনিই তো এখানে ফুলগুলো বিছিয়ে রাখেন, তাই না?’।
একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায় মানুষটি। উত্তর দেন, ‘জ্বী’। এরপরে শুরু করি আলাপ। নানান কথা, নানান গল্প। কীভাবে শুরু হল ফুল দেওয়া, সেটা জানার চেষ্টা করি। রিকশাচালক বলতে শুরু করেন-
‘আমি থাকি যাত্রাবাড়ি। অনেক রাত পর্যন্ত রিকশা চালাইলে সেদিন আর বাসায় ফিরা যাই না। এটা যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ভাবলাম এইখানে থাকাটা নিরাপদ। সেই জন্য অনেক সময় এইখানে রাত কাটাইয়া দেই। একদিন রাত প্রায় একটা দেড়টা বাজে মনে হয়; আমি রিকশার সিটের উপরে মাথা দিয়া শুইয়া রইছি। হঠাৎ আমার মাথার কাছে পানি পড়ার আওয়াজ পাইলাম। মাথা ঘুরাইয়া চাইয়া দেখি- এক ভদ্রলোক আমার রিকশার বডিতে পেশাব করতেছে! এমনিতেই ফুটপাতগুলা দুর্গন্ধে ভর্তি, তার উপরে মাথার কাছে এই পেশাবের গন্ধ নিয়া কেমনে ঘুমাই!’
আমি সাহেব রে কই- ‘স্যার, পেশাবটা একটু দূরে করলে হয় না?’। আমিতো এই রিকশার উপরেই থাকি।
উনি আমার কথা শুইন্যা ক্ষেইপা গেলেন। বললেন- ‘বেটা, এমনিতেই রাস্তা দখল কইরা অপরাধ করছ, আবার আমারে বড় বড় কথা কও! একদম মুখের উপরে ............ কইরা দিমু। এরপরে আমি চুপ মাইরা থাকি। উনি চইলা যান।’
‘খুব কইরা ভাবতে থাকি, কি কইরা এখানে এই পেশাব করা বন্ধ করা যায়!’ ‘একদিন রিকশায় পেসেঞ্জার লইয়া শাহবাগ দিয়া টিএসসির দিকে আইতেছি, পুলিশের অফিসের সামনে (পুলিশ কন্ট্রোল রুম) দেখি- রাস্তার কাছে অনেকগুলা বাসি ফুল ফেলাইয়া থুইছে। ব্যাপারটা মনে ধরল। পেসেঞ্জার টিএসসিতে নামাইয়া দিয়া গেলাম ওই পুলিশ অফিসের কাছে। দেখি ফুলগুলা তহনো আছে। রিকশায় যতটা ধরছে, ততগুলা বাসি ফুল ভইরা আমি এইহানে নিয়া আসি।’
‘ওই চায়ের দোকান থেইকা একটা ঝাড়ু নিয়া কিছুটা ফুটপাত ঝাড়ু দিয়া পরিষ্কার করি। ওই পরিষ্কার জায়গাডিতে ফুলগুলা ফাঁক ফাঁক কইরা বিছাইয়া দিলাম। তাতে দেহি কাম অইছে। আর কেউ ওই ফুলের জায়গাডাতে পেশাব করে না। আমিও মনে মনে সাহস পাইলাম। শাহবাগ থেইকা আরো বেশি বেশি ফুল নিয়া আইসা এই পুরা এলাকাডাতেই বিছায়া দেই।’
‘এইডা দেইখা হলের ছাত্ররা আগাইয়া আইলো।’ ‘আমারে তারা উৎসাহ দিল। কেউ কেউ আমার সাথে ফুটপাথ পরিষ্কারের কামে হাত দিল। আমিতো আল্লা আল্লা কইয়া উনাগো হাত থেইকা ঝাড়ু কাইরা লই। কিন্তু ছাত্ররা অনেক ভাল (এ সময় তাঁর চোখ ছলছল করতে থাকে)। উনারা আমারে অনেক সাহায্য করছে। উনাদের হল থেইকা দুইটা বোর্ড আমারে আইনা দিল। আমি একটু লেহাপড়া জানি, এইটা শুইনা আমারে শিখায়া দিল বোর্ডে কি লেখতে অইব।’
‘আমি লেইখা দিলাম, এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এরিয়া। এটা স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাষ্কর্য চত্বর এরিয়া। এখানে বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উদয়ন স্কুল এবং কলেজ রয়েছে, তাই এখানের পরিবেশ সুন্দর রাখা আমাদের কর্তব্য’।
‘এরপর থেইকা এখানে কেউ আর পেশাব করেনা কিংবা ময়লা ফেলে না।’ ‘হলের ছাত্র ভাইয়েরা আমারে কইছিল হলের ডাইনিং রুমে থাকতে। আমি যাই নাই। এইটা উচিত অইব না। কোথায় এমএ বিএ পাস ছাত্র ভাইয়েরা আর কোথায় আমি একজন রিকশাওয়ালা! লজ্জায় আমি আর যাই নাই ওহানে। এইহানে রিকশার মইধ্যে রাত কাটাই।’
অসাধারণ এই মানুষটির নাম নিশান।
নিশানের ভাষ্য অনুযায়ী- তাঁর জন্ম বরিশালে (যদি আমার স্মৃতি ঠিক থাকে)। ক্লাশ ফোর-ফাইভ অব্দি পড়েছেন। এই সময়ে নিশানের মা মারা যান। মায়ের মৃত্যুর পরে তার পিতা আর একটি বিয়ে করেন। সৎ-মায়ের হাতে নিশান এবং তার বড়ো ভাই নির্যাতিত হতে থাকে দিনের পর দিন। এক সময় অতীষ্ঠ হয়ে নিশান পাড়ি জমান ঢাকার উদ্দেশে। তখন থেকেই ঢাকায়। বহু কষ্টে আজ অব্দি বেড়ে ওঠা। নিশানের সংসারে- স্ত্রী আর এক সন্তান মাত্র। এতদিন যাত্রা বাড়িতেই তারা থাকতেন নিশানের সাথে। কিন্তু আয়ের সাথে ব্যয় না মেলায় স্ত্রী-সন্তানকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে তিনি এখন একাই ঢাকায় থাকেন। সামান্য আয় রোজগারের চেষ্টা করেন।
আগামী দিনগুলো কিভাবে কাটবে তা নিয়ে কোন পরিকল্পনা কিংবা মাথাব্যাথা নেই নিশানের। তাঁর কাছে ‘জীবন যখন যেমন’। কেটে যাবে কোনমতে। বড়ো কোন স্বপ্ন নেই, উচ্চাভিলাস তো দূরের কথা, কোন রকমের কোন অভিলাসই নেই।
নিশানকে নিয়ে কোন মন্তব্য করতে পারলাম না!
কোন ‘বয়ান’ কিংবা ‘বিপ্লবী বক্তব্য’ও দেওয়া গেল না। সবখানে, সবকিছুতে বয়ান কিংবা বক্তৃতা দেওয়াটা উচিতও নয়! নিশানের বিষয়টি সবার কাছেই পরিষ্কার বলে মনে হয়। অনেক ‘নিশানের’ জন্ম হোক বাংলাদেশে।
ভালো থাকুন সবাই।লেখক: নাট্য নির্মাতা ও নির্দেশক, অভিনেতা

মন্তব্য করুন