অতঃপর নুরুল হুদা

ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে যখন একটা নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে সার্চ কমিটি নিরপেক্ষ ‘মহামানব’দের খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তখন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের দুটি প্রদেশ পাঞ্জাব ও গোয়াতে নির্বাচন হচ্ছিল। এই দুটি রাজ্যেই গত পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিল বিজেপি। গোয়াতে তারা এককভাবে এবং পাঞ্জাবে আকালি দলের সঙ্গে মিলে কোয়ালিশন করে। ৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন যখন হচ্ছিল, তখনও রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় বিজেপি-ই। ভারতের কেন্দ্রেও এখন বিজেপির শাসন। ইতিমধ্যে ভোটের যে নমুনা দেখা গেছে, তাতে গোয়া নিয়ে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও পাঞ্জাবে যে বিজেপি-আকালি সরকারের ভরাডুবি হচ্ছে সেটা বলা যায় সহজেই। এখানে মূল লড়াইটা হবে আম আদমি পার্টি ও কংগ্রেসের মধ্যে। ৪ তারিখ নির্বাচন হয়ে গেছে, রেজাল্ট কিন্তু হয়নি এখনো। রেজাল্ট হবে ১১ মার্চ।
পুরো এক মাসেরও বেশি সময় পরে। এই দীর্ঘ সময় ভোটের হিসাবটা কার কাছে থাকবে? এই সময়ে নির্বাচন কমিশনের উপর সরকারি দল প্রভাব বিস্তার করে ভোটের ফল কি পাল্টে দিতে পারে না? এমন ঘটনা বাংলাদেশে হলে সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলই হয়ত সন্দেহটা করতো। ভারতে কেন করছে না? তাদের সরকারি দলের সঙ্গে বিরোধী দলের স¤পর্ক কি খুবই ভালো? না তা নয়। তারা আসলে নির্বাচন কমিশনের উপর ভরসা করে। তারা বিশ্বাস করে, নির্বাচন কমিশনে যারা যান, তারা তাদের দায়িত্বটা ঠিকভাবে পালন করবেন। সরকারের চাপে তারা নতজানু হবেন না, নিজেদের দায়িত্বে অবহেলা করবেন না।
এই যে সৎ এবং যোগ্য লোককে নির্বাচন কমিশনে বসানো, তার জন্য সেখানে কিন্তু কোনো সার্চ কমিটি গঠন করতে হয় না। সরকার একটা কমিশন গঠন করে, বিরোধীরা তা মেনে নেয়। সরকারের গঠন করা নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় হওয়া নির্বাচনে সরকারি দল হেরেও যায়। পরাজিত হয়ে সরকারি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে বেঈমান বলে গালও দেয় না। অথচ ভারত কিন্তু আমাদের থেকে খুব একটা দূরের দেশ নয়। একেবারেই লাগোয়া।
আমাদের চেহারা-ছবির মধ্যেও অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মিল পাওয়া যায় না কেবল মানসিকতায়। যা হোক, আমাদের ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি পুরো দশদিন ধরে আলোচনা গবেষণার পর দশজন যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তির নাম নিয়ে গেলেন রাষ্ট্রপতির কাছে। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে ৫ জনকে চূড়ান্ত করতে দশ ঘন্টা সময়ও নিলেন না। নাম জমা দেওয়ার দু-তিন ঘন্টার মধ্যেই একেবারে লিখিত ঘোষণা চলে এলো। সবমিলিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া বড়ই ইন্টারেস্টিং।
দশজনের নাম চূড়ান্ত করতে সার্চ কমিটি বসলেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে। তারপর রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নামের প্রস্তাবনা চাইলেন। পাওয়া গেলে ১২৫টি নাম। তারা সেখান থেকে ফেলে দিলেন ১০৫টি নাম। শর্টলিস্টেড ২০ নাম নিয়ে চললো গবেষণা। গবেষণা শেষে সেখান থেকে ১০ জনের নাম চূড়ান্ত করলেন। সন্দেহ নেই, এই দশজনের নাম চূড়ান্ত করতে তাদেরকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।
বিচার করতে হয়েছে- নির্বাচন কমিশনের মতো একটা সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনের জন্য এদের মধ্যে কে কতটা যোগ্য হবেন। চূড়ান্ত এই দশজনের নাম তারা জনসমক্ষে প্রকাশ করেছেন। সবাই জেনেছেন, কারা এরা। সার্চ কমিটি সম্ভবত প্রতিটি পদের জন্য দুজনের করে নাম প্রস্তাব করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের একটি পদের জন্য দুজনের নাম, আবার বাকি চারটি নির্বাচন কমিশনার পদের জন্য আটজন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদের জন্য প্রস্তাবিত নাম দুটি হলো আলী ইমাম মজুমদার ও কে. এম. নুরুল হুদা। নাম দুটি দেখার পর মহামান্য রাষ্ট্রপতি দ্রুতই বুঝে গেলেন কে. এম. নুরুল হুদাই যোগ্যতম। নামগুলো যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, আমি আমার দুই যুগের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে স্মরণ করার চেষ্টা করলাম- কে এই নুরুল হুদা? প্রথমে ভেবেছিলাম- সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা কি না। পরে শুনলাম, এই ভদ্রলোকের নামের আগে খান মোহাম্মদ অর্থাৎ কে. এম. আছে। ইনি অবসরপ্রাপ্ত সচিব জেনে সহকর্মীদের যারা নিয়মিত সচিবালয়ে যাতায়াত করে তাদের কাছে জানতে চাইলাম। তারাও কেউ চিনতে পারলেন না। বিপরীতে আলী ইমাম মজুমদারকে অবশ্য অনেকেই চিনলেন। যারা তাকে চেনেন তারা অবশ্য এমন কথাও বললেন- আলী ইমাম মজুমদারকে সিইসি করা হবে না। কেন?
একজনের কাছে জানতে চাইলাম। বললেন, যে যোগ্যতার কারণে কাজী রকিবউদ্দীন সিইসি হন, সেই যোগ্যতা না থাকার কারণে আলী ইমাম মজুমদার হতে পারবেন না। আলী ইমাম মজুমদারের যোগ্যতা বাংলাদেশের সিইসি হওয়ার জন্য লাগসই নয়। হলে তিনি গতবারই হতেন। সেবারও সার্চ কমিটি তার নাম প্রস্তাব করেছিল। তখন তাকে বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত রকিবউদ্দীনের উপর আস্থা রেখেছিলেন রাষ্ট্রপতি। সেই আস্থার সুফল এখনও ভোগ করছে বর্তমান সরকার। হয়ত সে কারণেই এবার আরও কম পরিচিত, বলতে গেলে একেবারেই অপরিচিত নুরুল হুদাকে নির্বাচন করা হলো সিইসি হিসেবে।
আমি একটা কথা প্রায়ই বলি। কোন মানুষ কতটা ভালো সেটা নির্ভর করে তার স¤পর্কে আপনি কত কম জানেন তার উপর। জাতিগতভাবে আমরা যথেষ্ট ছিদ্রান্বেষী। কাজেই যার স¤পর্কেই যা কিছু জানুন না কেন, দেখবেন সেখান থেকে কি অবলীলায় আপনি তার দোষগুলো বের করে ফেলছেন। এটা আপনার দোষ নয়, এটা এই মাটির গুণ। এই যে এখন আলী ইমাম মজুমদারের জন্য আমার কথার মধ্যেও একটা হাহাকার দেখা যাচ্ছে, যদি তাকেই সিইসি নির্বাচন করা হতো, দেখতেন তারই কত কত দোষ আমি একটানে লিখে যাচ্ছি। সে বিচারে ভদ্রলোককে ভাগ্যবানই বলতে হয়। দুই দুবার তালিকায় থেকেও সিইসি হতে না পারায় তার প্রতি মানুষের সহানুভূতি অনেক বেড়ে গেছে।
আবার বিপরীত দিকে সমস্যা হয়েছে কে. এম. নুরুল হুদাকে নিয়ে। এই ভদ্রলোক সম্পর্কে অনেকেই তেমন কিছু জানেন না। ফলে তার সমালোচনা করতে গিয়েও তেমন একটা সুবিধা করতে পারছে না, এমনকি খোদ বিরোধী দল বিএনপিও। তার সমালোচনায় যে দুটি বিষয় সবচেয়ে বেশি আসছে, বিএনপিপন্থিরা উচ্চারণ করছেন, তা হলো এক. ইনি জনতার মঞ্চের সঙ্গে স¤পৃক্ত ছিলেন, দুই. পাকিস্তান আমলে যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তখন ছাত্রলীগ করতেন! হুদা সাহেব কিন্তু স্পষ্ট করেই বলেছেন, তিনি জনতার মঞ্চের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তিনি তখন ছিলেন কুমিল্লার ডিসি। জনতার মঞ্চ হয়েছে ঢাকায় সচিবালয় ও প্রেসক্লাবের মাঝে।
সেই সময় কুমিল্লা থেকে একদিনের জন্যও তিনি ঢাকাতে আসেননি। তাহলে কিভাবে জড়িত থাকবেন? কুমিল্লাতেও জনতার মঞ্চের তেমন কোনো তৎপরতা ছিল না। সেখানেও সরকারবিরোধী কোনো মঞ্চে তিনি ওঠেননি। তাহলে এসব অভিযোগের ভিত্তি কি? এখন পর্যন্ত বিএনপি বা তার অনুগতদের কাছ থেকে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য-প্রমাণ দেখা যায়নি। একটা যুক্তি অবশ্য একজন দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর এই লোককে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। ইনি যদি বিএনপিবিরোধী না হতেন, তাহলে কি আর তাকে এভাবে অবসরে পাঠানো হয়? অকাট্য যুক্তি, সন্দেহ নেই।
আর দ্বিতীয় যে সমালোচনা, ছাত্রজীবনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার, সেটা রীতিমতো হাস্যকর। পাকিস্তানে আমলে তিনি ছাত্রলীগ না করে জামায়াতের অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ করলেই বুঝি খুশি হতেন এই সমালোচকরা? তখন ছাত্রলীগ না করে আর কি করতে পারতেন তিনি? তখন তো ছাত্রদল ছিল না! আসলে এরকম সমালোচনা প্রত্যাশিত নয়। একটা নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে গেছে, এখন যদি প্রতিটা লোকের অর্ধশতাব্দী পূর্বের চিন্তাভাবনাকে সামনে নিয়ে এসে তার সমালোচনার চেষ্টা করা হয়, সেটা এই কমিশনের কর্মকাণ্ডের স্বাভাবিক গতিকেই প্রকারান্তরে বাধাগ্রস্ত করবে। বিতর্ক যে একেবারে নেই, আরও ভালো কিছু করা যে যেত না- তা হয়ত নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কমিশন তো গঠিত হয়ে গেছে। এর অধীনেই নির্বাচন হবে।
নির্বাচন করতে চাইলে সকল দলকে এদের পরিচালনাতেই করতে হবে। তাহলে আর চুলকিয়ে ঘা করা কেন? অথচ বিএনপি সেই কাজটিই করছে। এরই মধ্যে তাদের কোনো কোনো নেতা বলছেন, এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আবার সেদিন দেখলাম, আর এক নেতা গয়েশ্বর রায় বললেন- মানুষের অবাধ ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা পেলে তারা এই নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচনে যাবেন। জনগণ কি বুঝবে, কোনটিকে মানবে? তবে আমার কেন যেন মনে হয়, এই বাদ প্রতিবাদের হুজুগটা এখন ধীরে ধীরে কমে আসবে।
বিএনপি কিন্তু সার্চ কমিটি নিয়ে হইচই করেছিল। বরং বলা যায়, নির্বাচন কমিশন নিয়ে যতটা এখন করছে তারচেয়ে অনেক বেশিই করেছিল। কিন্তু এরপর দুদিনের মাথায় আবার সেই সার্চ কমিটির কাছেই নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিজেদের প্রস্তাবিত নামগুলো জমা দিয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, এই নির্বাচন কমিশনারের অধীনে তারা আগামী জাতীয় নির্বাচনে ঠিকই অংশ নেবে। নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ফল যে কি দুঃসহ হয়, তার প্রমাণ তো ২০১৪ সালেই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে তারা। তারপরও এখন থেকেই সার্বক্ষণিক যে সমালোচনা, এটা আসলে কমিশনকে কিছুটা চাপে রাখার জন্যই হয়ত করছে তারা।
সেদিন এক টেলিভিশন টক শোতে নতুন সিইসি সম্পর্কে এক সিনিয়র সাংবাদিক কিছু তথ্য দিলেন। এই সাংবাদিক ভদ্রলোক কুমিল্লার লোক। নিয়মিত এলাকায় যাওয়া-আসা আছে। জানালেন, নুরুল হুদা সাহেব যখন কুমিল্লার ডিসি ছিলেন, তখন সেখানে অসাধারণ সৎ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নিজের বাসায় অফিসের বিদ্যুৎ সংযোগ বাদ দেওয়া, স্ত্রীর রিকশায় চলাচল করা, সন্তানের সাইকেলে স্কুলে যাওয়াসহ বেশ কিছু উদাহরণও দিলেন। টক শোতে আরও বেশ কয়েকজন ছিলেন।
তারা যেহেতু ওনার স¤পর্কে তেমন কিছু জানেন না, তাই কোনো প্রতিবাদও উচ্চারিত হলো না। হয়ত সততার ওই সার্টিফিকেটটাই সত্য। দেশের একজন নাগরিক এবং ভোটার হিসেবে কামনা করি, ওটাই সত্য হোক। সেই সঙ্গে এটাও কামনা করি, নতুন সিইসি কেবল সৎই হবেন না, সেই সঙ্গে যোগ্যও হবেন। সততা অবশ্যই একটা যোগ্যতা, কিন্তু বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদের জন্য সবচেয়ে বড় এবং প্রত্যাশিত যোগ্যতাটি সম্ভবত ব্যক্তিত্ব এবং নৈতিক দৃঢ়তা। আশা করি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কে. এম. নুরুল হুদা সেটা দেখাতে পারবেন।
মাসুদ কামাল : লেখক ও জেষ্ঠ সাংবাদিক

মন্তব্য করুন