অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ নির্বাচন কমিশন

গেল বৃহস্পতিবার মানে ৩০ মার্চ একই দিনে দুটি নির্বাচন হলো, সুনামগঞ্জে জাতীয় সংসদের উপনির্বাচন এবং কুমিল্লায় সিটি করপোরেশন নির্বাচন। সুনামগঞ্জ-২ দিরাই উপজেলার এই আসনটি শূন্য হয়েছিল সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের মৃত্যুতে। উপনির্বাচনে সেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দেয় সুরঞ্জিতের স্ত্রী জয়া সেনগুপ্তকে। বিএনপি সেখানে কোনো প্রার্থীই দেয়নি। আর কুমিল্লায় ছিল সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই প্রার্থী দেয়। সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নির্বাচিত হয়, কুমিল্লায় বিএনপি প্রার্থী। দুটি নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয় নতুন নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে। কুমিল্লায় বিএনপি প্রার্থী বিজয়ী হলেও বিজয়টা স্পষ্ট হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা কিন্তু কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করেই চলছিল। তবে সুনামগঞ্জ নিয়ে তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
গত কিছুদিন ধরেই বলা হচ্ছিল নতুন নির্বাচন কমিশন কতটা সফলভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে, তার পরীক্ষা হবে ৩০ মার্চ। একই দিনে দুটি পরীক্ষায় অংশ নিল কে এম নুরুল হুদার কমিশন। বিএনপির মতো জাতীয় পর্যায়ের একটি দল কেবল কুমিল্লার পরীক্ষা নিয়ে মন্তব্য করলো, সুনামগঞ্জের পরীক্ষা নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করলো না। অঙ্ক আর ইংরেজি দুই বিষয়ে পরীক্ষা হলো, কেবল ইংরেজির ফল দিয়ে কি ছাত্রের যোগ্যতা বিচার করা যায়? তারপরও বড় রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপির দৃষ্টি যখন পুরোটাই কুমিল্লাকে নিয়েই ছিল, তাই এই আলোচনাটাও কুমিল্লাকেন্দ্রিকই হোক না হয়।
কুমিল্লাকে পরীক্ষাক্ষেত্র, বিএনপিকে পরীক্ষক আর নির্বাচন কমিশনকে যদি পরীক্ষার্থী হিসাবে বিবেচনা করা যায়, তাহলেও পুরো দৃশ্যপটকে কিন্তু অতোটা গোছানো মনে হয়নি। বিশেষ করে পরীক্ষকের কর্মকা- ছিল অনেকটাই অগোছালো। তবে তারা অবশ্য বেশ আটঘাট বেঁধেই নেমেছিল। নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হলো সকাল আটটা থেকে। এর ঘন্টা চারেক পর থেকেই ঢাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে উত্থাপিত হতে থাকলো অভিযোগের পর অভিযোগ। বোঝা গেল পরীক্ষার্থী হিসাবে যে নির্বাচন কমিশনকে তারা বেছে নিয়েছে, তাকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার মানসিকতা তাদের নেই।
কুমিল্লায় যখন তাদের প্রার্থী ভোটযুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন, তখন ঢাকায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বসে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ একের পর এক সংবাদ সম্মেলন করছেন। এমনিতেই তার সংবাদ সম্মেলন করার একটা বাতিক রয়েছে। এই বাতিক এতটাই প্রকট যে, বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত এতে প্রকাশ্যে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তারপরও তার আচরণে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। এদিন দিনব্যাপী কুমিল্লার নির্বাচনের মতো একটা ঘটনা পেয়ে রিজভী কিছুক্ষণ পরপর সংবাদ সম্মেলন করতে থাকেন। সেসব সম্মেলনে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাক্কুর বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়নি।
দুপুরের দিকে রিজভী সাহেব সাংবাদিকদের বললেন, নানাভাবে ক্ষমতাসীনরা এই নির্বাচনকে প্রভাবিত করছে। এই নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়েও তিনি সংশয় প্রকাশ করলেন। বললেন, কুমিল্লায় তিনি নাকি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কোনো লক্ষণই দেখতে পাচ্ছেন না। তার বক্তব্যের কিছু অংশ যদি সরাসরি তুলে দেওয়া যায়, তাহলে হয়ত দুপুর নাগাদ তার চিন্তাভাবনা কেমন ছিল, সেটা বোঝা যাবে। তিনি বলেন, ‘ক্ষমতাসীনরা স্থানীয় প্রশাসনকে কাজে লাগাচ্ছে, ব্যবহার করছে এবং এক নারকীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে ভোটারদের মনে ভীতি সৃষ্টি করে তারা একতরফা ভোট করার ইচ্ছা নিয়ে কাজ করছে। আমি আবারো স্থানীয় প্রশাসন ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের অনাচারমূলক কর্মকা-ে নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ত ভূমিকা, নির্বাক ভূমিকার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’ এসময় তিনি আরও জানালেন নির্বাচন কমিশন নাকি তার উপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছে না। তবে একথা ঠিক, রিজভী যখন এসব অভিযোগ তোলেন, ততক্ষণে কুমিল্লার কয়েকটি কেন্দ্রে কিছু অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে, কিছু অভিযোগ এসেছে। বিভিন্ন টেলিভিশনে তার কিছু নমুনাও দেখা গেল। ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কুমিল্লা সরকারি সিটি কলেজ কেন্দ্রের বাইরে রাস্তার ওপর বেলা ১১টার দিকে কয়েকটি হাতবোমা ফাটানো হয়। তবে সংশ্লিষ্ট অনেকে বলেন, এই কাজটির পিছনে আসলে ভূমিকা রয়েছে সেখানকার কমিশনার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দুই ব্যক্তির। সেখানকার নির্বাচন কর্মকর্তারাও জানিয়েছেন যে, ওই কেন্দ্রের কাউন্সিলর প্রার্থীদের ব্যালট নিয়ে কিছু অনিয়মের অভিযোগের কথা। এ ধরনের অভিযোগ ওঠেছিল আরও একটি কেন্দ্র নিয়ে।
এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন দুটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করে দেয়। তাহলে এখানে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতাটি ঠিক কোথায়? রিজভী কিন্তু এই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগটিই তুলেছিলেন। নির্বাচনে ভোট চলাকালে অঘটন তো ঘটতেই পারে। জাল ভোট দেওয়ার প্রবণতা কোনো কোনো মানুষের মনে থাকতেই পারে। দুষ্ট লোকগুলো সেই মানসিকতার প্রকাশ ঘটানোর চেষ্টাও করতে পারে। প্রশ্ন হলো, নির্বাচন কমিশন সেই অন্যায় কাজগুলো হতে দিচ্ছে কি দিচ্ছে না? অনেক সময় এমন হয় যে, উত্থাপিত অভিযোগকে নির্বাচন কমিশন কোনো পাত্তাই দেয় না। কুমিল্লার ক্ষেত্রে তেমন কিছু তো হয়নি, বরং কমিশন আলোচিত দুটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দিয়েছে। তারপরও কেন এত অভিযোগ?
বিএনপির লাগাতার এই অভিযোগের মধ্যেই সন্ধ্যার পর থেকে নির্বাচনের ফল আসতে শুরু করলো। একটা দুটো করে কেন্দ্রের ফল আসে, আর টেলিভিশনগুলো তা প্রচার করতে থাকে। দেশের মানুষ দেখলো বেশ একটা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হচ্ছে। একবার মনিরুল হক সাক্কু এগিয়ে তো একবার আঞ্জুম সুলতানা সীমা এগিয়ে। তবে সেরকম বেশিক্ষণ চলেনি, একটু পরেই দেখা গেল নিয়মিতভাবেই এগিয়ে থাকছেন সাক্কু। শেষ পর্যন্ত হলোও তাই। জিতে গেলেন বিএনপি প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। আগেরবারও জিতেছিলেন তিনি। ফলে সিটি করপোরেশনে পরিণত হওয়ার পর দুবারই মেয়র হলেন সাক্কু। আগেরবার জিতেছিলেন তিনি প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল খানকে পরাজিত করে। আর এবার জিতলেন সেই আফজাল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমার বিরুদ্ধে। তবে আগেরবারের চেয়ে এবার ভোটের ব্যবধান কিছুটা কম হলো।
তবে আগেরবারের সঙ্গে এবারের নির্বাচনের মূল পার্থক্য হলো প্রতীক নিয়ে। এবার নির্বাচন হয়েছে দলীয় প্রতীকে। বিশেষ করে মেয়র পদে নির্বাচনটি হয়েছে নৌকা এবং ধানের শীষের মধ্যে। কুমিল্লায় এই লড়াইয়ে হেরে গেছে নৌকা। নৌকার এই পরাজয় দল হিসাবে আওয়ামী লীগের জন্য যে একটা ধাক্কা, সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যদিও এই নির্বাচনের ফলাফলের উপর সরকারের তেমন কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না, তবুও বিষয়টা একেবারে গুরুত্বহীনও ছিল না। বরং কুমিল্লার কারণে দলীয় ঐক্যের একটা পরীক্ষাও এখানে খুঁজেছেন অনেকে। সে পরীক্ষায় মর্মান্তিকভাবে হতাশ হয়েছে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে অনেকের সঙ্গেই কথা হয়েছে। আমার যে সব সহকর্মী এই নির্বাচনের নিউজ কভার করতে কুমিল্লায় গিয়েছিলেন তারা বলেছিলেন, পুরো বিষয়টাই আসলে নির্ভর করছে দলীয় কোন্দলের ওপর। প্রধান দুই প্রার্থীই দলীয় প্রতীক পেলেও দলের সব ভোট তারা পাবেন কি না সন্দেহ। এটা আওয়ামী লীগ বিএনপি উভয়ের জন্যই সত্য। নির্বাচনের ফল যখন প্রকাশ পেল, তারপরও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গেল সেই একই মনোভাবের প্রতিফলন। নৌকা প্রতীক নিয়েও হেরে গেছেন আঞ্জুম সুলতানা সীমা, কিন্তু সব দায় যেন গিয়ে পড়ছে স্থানীয় সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহারের ওপর। এই বাহারের সঙ্গে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল খানের বিরোধ অনেক পুরনো। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের উদাহরণ এই দুই নেতার মতো আর কেউ দেখাতে পেরেছেন বলে শোনা যায় না। আফজাল খান গতবার নির্বাচন করেছেন, এবার করছেন তার মেয়েÑ বিষয়টিকে বাহার নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ীই বিচার করবেন এ রকমটাই ভেবেছেন অনেকে। সেই ভাবনাই শেষ পর্যন্ত সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ব্যক্তিগত বৈরিতার কাছে নির্মমভাবে পরাজিত হয়েছে দলীয় স্বার্থ। আওয়ামী লীগ বড় দল, বড় দলে স্থানীয় পর্যায়ে কোন্দল থাকতেই পারে। কিন্তু সেই কোন্দল যে পুরো দলকেই জাতীয়ভাবে অপদস্থ করতে পারে, সেটা আরও একবার দেখা গেল কুমিল্লায়। এ ধরনের দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি এর আগেও দেখা গেছে নারায়ণগঞ্জে। কিন্তু এবার সেখানে দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি শামীম ওসমানের মতো ব্যক্তিকেও পর্যন্ত সংযত আচরণ করতে দেখা গেছে। সে কারণেই অনেকে আশা করেছিলেন কুমিল্লাতেও বুঝি সেরকম কিছু হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি, ব্যক্তিগত বৈরিতাই জয়ী হয়েছে।
তবে দলের এই পরাজয়কে বেশ সাফল্যের সঙ্গেই সামলে নিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। পরাজয়কে পরিণত করতে চেয়েছেন পরবর্তী বড় কোনো প্রাপ্তির ভিত্তিতে। তারা বলছেন, এই নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব। বিরোধীদল বিএনপি অবশ্য কিছুটা বেকায়দায় রয়েছে। দিনভর অভিযোগ করার পর ফল দেখে আর আগের কথার প্রতিফলন প্রমাণ করতে পারছে না। অগত্যা বলছে, অনিয়ম কারচুপি ঠিকই হয়েছে, না হলে আরও বেশি ব্যবধানে জয় আসতো! আর এক নেতা বললেন, নির্বাচন অবাধও হয়নি, সুষ্ঠুও হয়নি, তবে ফলাফল ফেয়ার হয়েছে! এসব কথা যখন জাঁদরেল এই নেতারা বলেন, একবার ভেবেও কি দেখেন না যে, কতটা হাস্যকৌতুকের জন্ম দিচ্ছেন তারা?
তবে সবকিছুর ওপরে লাইমলাইটে চলে এসেছে নতুন নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের দিন বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী বলেছিলেন, ‘আগেও বলেছি, এখনো বলছি, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন এই কমিশনের জন্য অগ্নি পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় পাস না করতে পারলে ব্যর্থতার সব দায়িত্ব নিয়ে অচিরেই বিদায় নিতে হবে।’
সাক্কুর বিজয়ের পর কি বললেন এখন এই নেতা? কি বলবে তার দল?
মাসুদ কামাল : লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

মন্তব্য করুন