প্রাণের উৎসবে কেন নিয়ন্ত্রণের খাঁড়া?

বাংলা নববর্ষ উদযাপন নিয়ে নাটক শুরু হয়েছে। পয়লা বৈশাখের উৎসব কখন কিভাবে করতে হবে, অথবা করা ঠিক হবে কি হবে না, মঙ্গল শোভাযাত্রা করা যাবে কি যাবে না- এসব নিয়ে হচ্ছে নানা কথা। প্রতিবারই কিছু না কিছু হয়, কিন্তু এবার যেন তা কিছুটা বাড়তি মাত্রা পেয়েছে। বাড়তি মাতামাতি দুদিকেই- পালনে যেমন, প্রতিরোধেও তেমনি। সরকারি আদেশ হয়েছে- সারা দেশে বাংলা নববর্ষ আড়ম্বরের সঙ্গে পালন করতে হবে। দেশের প্রতিটি স্কুল কলেজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজ নিজ সামর্র্থ্য অনুযায়ী আয়োজন করতে হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা।
আর এরই বিপরীতে ক্ষেপে উঠেছে ইসলাম নামধারী সংগঠনগুলো। মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে তাদের প্রবল আপত্তি। একে তারা রীতিমতো ইসলামবিরোধী বলেই প্রচার করছে। তারা রাজধানী ঢাকাতেই এটিকে করতে দিতে চায় না। আর তার ওপর এ অনুষ্ঠানটি দেশজুড়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি করা হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই।
তাহলে দাঁড়ালটা কী? একদিকে সরকার বলছে- সারা দেশে বাংলা নববর্ষের উৎসব করতে হবে, মঙ্গল শোভাযাত্রা করতে হবে, আর বিপরীত দিকে কতিপয় ইসলাম নামধারী সংগঠন বলছে এসব করতে দেওয়া হবে না। এ সংগঠনগুলোর জোরালো কোনো ভিত্তি দেশেজুড়ে নেই, কিন্তু তারপরও তাদের আচরণকে উপেক্ষা করা যাবে না। বড় একটা অনুষ্ঠান করতে অনেক লোক লাগে, কিন্তু সেই অনুষ্ঠানটিকে ভ-ুল করতে দু-একজন দুষ্ট লোকই যথেষ্ট। দেশে জঙ্গিদেরও কোনো শক্ত ভিত্তি নেই, লুকিয়ে চুরিয়ে থাকে তারা।
অথচ ১৭ কোটি মানুষের দেশের বদনাম কিন্তু দু-একজন জঙ্গিই করছে। তাই সে রকম হাতেগোনা নামসর্বস্ব কয়েকটি সংগঠনের নেতারা প্রকাশ্যে হইচই করতে থাকবে, আর পাশাপাশি সাধারণ মানুষ নির্বিঘেœ পয়লা বৈশাখ কিংবা মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো উৎসব করতে পারবে- এমনটি বোধকরি সহজ নয়। মনের মধ্যে আতঙ্ক নিয়ে আর যাই হোক আনন্দ উৎসব করা যায় না।
হুজুর নামধারী এ লোকগুলো বলছেন, বৈশাখী উৎসব, মঙ্গল শোভাযাত্রা, কিংবা পান্তা ইলিশ খাওয়া- এসব নাকি ইসলামী আকিদাবিরোধী। তাই এসব করা যাবে না। প্রথম দিকে তারা এসব গুনগুন করে বলেছে। দেখেছে কী প্রতিক্রিয়া হয়। তারপর সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে ধীরে ধীরে সাহস বেড়েছে, প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেছে। কদিন আগে দেখলাম রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে বলছে তারা। সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত হেফাজতে ইসলাম-এর নেতা শাহ আহমদ শফি এক বিবৃতিতে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ বরণের নামে বিভিন্ন জীবজন্তুর মূর্তি নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা, মুখে উল্কি আঁকা এবং নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ এসব অনৈসলামিকতা ও বিজাতীয় সংস্কৃতি। সুতরাং মুসলমানদের জন্য মঙ্গল শোভাযাত্রার সংস্কৃতিচর্চা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।’
যে কাজটা তিনি অবশ্যই পরিত্যাজ্য বলছেন, সেটাই আবার সরকার বলছে করতে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা করার জন্য রীতিমতো লিখিত নির্দেশনা দিয়েছে। তাহলে কে কে এখানে মুখোমুখি দাঁড়াল? অনুষ্ঠানগুলো পালন করতে যাবে সাধারণ মানুষ, এমনকি নারী-শিশুরা পর্যন্ত। আর তা বাধা দিতে চেষ্টা করবে ইসলামের হেফাজতের নামধারী হুজুররা।
এই যে সাধারণ মানুষের সঙ্গে হুজুরদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া, এ কাজটি কে করল? সরকারই নয় কি? হুজুরদের এমন বিবৃতি, যা কিনা সরকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্পূর্ণই সাংঘর্ষিক, সে বিষয়ে সরকারের কোনো বক্তব্যই বা নেই কেন? সরকার কি তাহলে হুজুরদের বিবৃতি মেনে নিচ্ছে? যদি মেনে নিয়েই থাকে, তাহলে তাদের ঘোষিত আগের সিদ্ধান্তই বা প্রত্যাহার করছে না কেন?
আসলে সরকারকে বোঝা বড় দায়। তারা যে কখন কী করে, কেন করে বলা মুশকিল। আমরা বরং হুজুরদের ফতোয়ার দিকে একটু তাকাতে পারি। মঙ্গল শোভাযাত্রা সম্পর্কে তারা মোটাদাগে দুটি কথা বলেছেন। এক. এটা অনৈসলামিক এবং দুই. এটা বিজাতীয় সংস্কৃতি। ইসলামিক নাকি ইসলামবিরোধী এটা একটা বিশাল বিতর্ক।
কোনটা যে প্রকৃত ইসলাম, সেটা নির্ধারণ করতে যেয়ে এখন পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়েই চলছে হত্যা আর ধ্বংসের উৎসব। এসব করছে কোনো না কোনো মুসলিম নামধারীরাই। সৌদি আরবের ইসলাম আর ইরানের ইসলাম এক নয়। আইএসআইএসের ইসলাম আর সিরিয়ার ইসলাম এক নয়। ইসলাম রক্ষার নাম করে ইহুদিদের চর হিসাবে খ্যাত আবু বকর আল বোগদাদী বনে গেছে মুসলিমদের নেতা। তার সংগঠন ইসরাইল ছাড়া আর সব দেশেই ইসলামের নামে চালাচ্ছে সহিংস কর্মকা-। কাজেই আহমদ শফি সাহেব কোন ভাবধারার অনুসারী সেটা নির্ধারণ করতে গেলে আবার আর এক বিপত্তির জন্ম নিতে পারে। কাজেই বাংলা নববর্ষের উৎসব পালন ইসলামিক নাকি অনৈসলামিক- সে আলোচনা থাক। আমরা বরং ওনার দ্বিতীয় আপত্তিটা নিযে কথা বলতে পারি।
উনি বলেছেন এ অনুষ্ঠানমালা নাকি বিজাতীয় সংস্কৃতি। আমাদের জাতীয়তাটা আসলে কী? আবার বিজাতীয় বলতেই বা কী বোঝানো হয়? যা এ জাতির নয়, তাই তো? তাহলে তো অন্য প্রশ্ন আসে। আসলে আমরা কোন জাতি? কী আমাদের জাতীয়তা? আমরা কি বাঙালি, বাংলাদেশি, মুসলিম নাকি বাঙালি (বাংলাদেশি) মুসলিম? এসব প্রশ্নের নিরসন কি ১৯৭১ সালেই একবার হয়ে যায়নি? ১৯৪৭ সালে মোহাম্মদ আলি জিন্না হুজুগ তুলেছিলেন এ উপমহাদেশে নাকি দুটি জাতি- হিন্দু আর মুসলিম। তার ওই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতেই ভারত আর পাকিস্তান হয়েছিল। পাকিস্তানের দুই অংশেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম ছিল। তাহলে এক অংশের ওপর অপর অংশের শোষণটা কেন ছিল? ত্রিশ লাখ মানুষের জীবনও কি প্রমাণ করতে পারেনি যে, জাতি হিসেবে আমরা বাঙালি? আমাদের সেই মীমাংসিত জাতীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস এসব অর্ধশিক্ষিত জোব্বাধারীরা পায় কোথায়?
বাঙালি জাতির জন্য বিজাতীয় উৎসব অন্য কিছু হতে পারে, পয়লা বৈশাখ বা মঙ্গল শোভাযাত্রা নয়। এ উৎসবগুলো অন্য কোনো দেশ থেকে আমদানি করা নয়, এ ভূখ- থেকেই উৎসারিত। যা কিছু এ ভূখ- থেকে, এ ভূখ-ের মানুষের কাছ থেকে এসেছে, সেসবই এ জাতির বৈশিষ্ট্য। এর বাইরে যা কিছু আছে, সবই বিজাতীয়। আরবি উর্দুু মিশিয়ে ওনারা যে ভাষায় কথা বলেন, সেটা বিজাতীয়। যে মানসিকতার কারণে ওনারা নারী মাত্রেই তেঁতুলের উদ্দীপক অনুভূতি প্রাপ্ত হন, সেটা বিজাতীয়।
আমাদের টেলিভিশনে এক রিপোর্টার আছেন, মিরাজ হোসেন গাজী। অন্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে কাজ করেন। মাস কয়েক আগে ওর করা বেশ কয়েকটা রিপোর্ট দেখলাম। খুবই মর্মান্তিক বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন। মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে সৌদি আরবে কিভাবে বাংলাদেশের নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন পরিচালিত হচ্ছে- তা নিয়ে। মেয়েরা তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছে, কিভাবে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে- তা কিছুটা রাখঢাক করেই বলছে। প্রতিবেদনগুলো দেখতে যেয়ে রীতিমতো গা গুলিয়ে আসে।
মনে হয় মুসলিম নামধারী সৌদির ওই লোকগুলো বুঝি মানুষই নয়, পশু কেবল। শুধু টেলিভিশনেই নয়, এ নিয়ে একাধিক পত্রপত্রিকাতেও অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে আমাদের মেয়েদের এ নির্যাতিত হওয়ার বিষয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে।
অনেকে বলেছেন মেয়েদের সেখানে আর পাঠানোই উচিত নয়। সেসব খবরই আমি পত্রিকায় দেখেছি। কিন্তু যে খবরটা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি, সেটা হলো- আমাদের কোনো ইসলামী সংগঠন বা তার নেতা কর্তৃক এসব ঘটনার জন্য দায়ী সৌদি বা মধ্যপ্রাচ্যের ওই পশু প্রবৃত্তির লোকগুলোর আচরণের সমালোচনা। দুঃখের সঙ্গে মানছি, সেই আগ্রহ এখনো পূর্ণতা পায়নি। দেখিনি সে ধরনের কোনো সমালোচনা। ওই পশুদের নিন্দা করে তারা কোনো কথা বলেননি।
কেন তারা এ বিষয়ে কোনো বিবৃতি দেন না? ওই পশুগুলো মুসলিম নামধারী বলে? ওরা আরবিতে কথা বলে- সেই কারণে? নাকি ওদের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ সাহায্য পাওয়া যায় বা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে-তাই?
তবে এতটুকু নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, ওই পশুপ্রবৃত্তির লোকগুলোর কাছ থেকেই আমাদের এ হুজুরদের মধ্যে তেঁতুল তত্ত্বের বিস্তার ঘটেছে। নারী মাত্রেই তাদের কাছে লালা সৃষ্টিকারী তেঁতুল। তাই তারা মঙ্গল শোভাযাত্রায় নারী পুরুষের সম্মিলিত মিছিল দেখে আতঙ্কিত হয়। লালা ঝরতে থাকে। কিন্তু তাদের কী করে বোঝানো যাবে যে, এ মিছিলে নারী-পুরুষ সবাই বাঙালি, এদের মধ্যে তেঁতুল তত্ত্ব কাজ করে না। গত কয়েক বছরে বৈশাখী উৎসবে অঘটন যে দু-একটা ঘটেছে সেসব ওই তেঁতুল তত্ত্বে প্রভাবিত ব্যক্তিদের দ্বারাই। ওরা বাঙালি নয়, ওরা নববর্ষের আনন্দ উৎসবে যোগ দিতে যায়নি, বরং তেঁতুলের স্বাদ নিতে গিয়েছিল।
ইসলাম নামধারী একটা সংগঠন বলেছে, পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় ছেলেমেয়েরা নানা ধরনের মুখোশ পরে থাকে। ফলে কারও চোখ দেখা যায় না, মুখ দেখা যায় না। চোখ মুখ দেখা না যাওয়ার কারণে তাদের মনে কি আছে সেটাও টের পাওয়া যায় না। ফলে এখানে মেয়েদের হেনস্তা হওয়ার ভয় থাকে, আশঙ্কা থাকে আরও বড় দুর্ঘটনার। কী হাস্যকর কথা!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে এ মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম বের হয় সেই ১৯৮৯ সালে। সেই থেকে এ পর্যন্ত, ২৭ বছরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় নারী-পুরুষে কোনো অঘটন হয়েছে বলে আমি শুনিনি। তবে হয়নি বলে যে কখনো হবেই না, তা অবশ্যই বলা যায় না। হতেই পারে। কেবল মঙ্গল শোভাযাত্রায় কেন, যেকোনো জায়গাতেই হতে পারে। তবে কোথায় কখন হবে সেটা যতটা না নির্ভর করবে পরিবেশের ওপর, তার চেয়েও অনেক বেশি নির্ভর করবে অপকর্মটি যে বীর পুঙ্গব করবে তার উপস্থিতির ওপর।
মঙ্গল শোভাযাত্রায় অঘটন না হলেও বৈশাখী আয়োজনে কিছু কিছু ঘটনার কথা জানা যায়। সেসব ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং মর্মান্তিক ছিল কোনটি? কোনো সন্দেহ নেই সবাই সেই রমনার বটমূলের বিস্ফোরণের ঘটনার কথাই বলবেন। আর সেটির সঙ্গে জড়িত ছিল কারা? ওই ইসলাম নামধারী কোনো না কোনো সংগঠনই তো! এ দেশে চৈত্রসংক্রান্তি বা নববর্ষ যেমন উদ্্যাপিত হয়, তেমন থার্টিফার্স্ট বা নিউ ইয়ারও তো পালিত হতে দেখি। ইলিশ পান্তা নিয়ে হুজুরদের যে আপত্তি, ততটা কিন্তু পাঁচতারা হোটেলে রাতভর শরাব-নৃত্যের অনুষ্ঠান নিয়ে দেখি না। ওনারা যাকে বেলাল্লাপনা বলেন, সেটা তো ওই রঙিন আলোয় ভরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বলরুমেই হয়। তাহলে এখন কি হুজুরগণ আবদার করবেন- থার্টিফার্স্টের রাতে হোটেলগুলোর বলরুমে তাদের একজন করে পর্যবেক্ষক বসাতে? যেন তারা বলতে পারেন ঠিক কখন উদ্্যাপনকারীরা শরিয়তের বেড়া অতিক্রম করে যাচ্ছেন।
আসলে সংস্কৃতি বলুন আর উৎসব বলুন- এসব আইন কিংবা বিবৃতি দিয়ে যেমন শুরু করা যায় না, তেমনি বন্ধও করা যায় না। এসব স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে, ঘোষণা দিয়ে আনা যায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম যখন শুরু হয় তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল স্বৈরাচারী এরশাদ। মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে স্বৈরাচারবিরোধী একটা চেতনাও কাজ করেছে। বিষয়টা এরশাদও বুঝেছেন। তিনি সেটা বন্ধ করার চেষ্টা কী করেননি? করেছেন, কিন্তু সফল হননি। পাকিস্তান আমলেও রবীন্দ্রসংগীত বন্ধের ঘোষণা এসেছিল রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে। বন্ধ কি করা গিয়েছিল? সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক উৎসব বিষয়টাই এ রকম।
প্রথমে বৈশাখী উৎসব, পরে মঙ্গল শোভাযাত্রা- এ দুটিই এই মাটির সৃষ্টি। সরকারি কোনো আনুকূল্য ছাড়াই এ সাংস্কৃতিক উৎসব টিকে থেকেছে, বেড়ে উঠেছে। মানুষ যত দিন এ অনুষ্ঠানের সঙ্গে তার জীবনের সামঞ্জস্য খুঁজে পাবে, তারা পালন করবে। সরকার কী বলল, আর তেঁতুল হুজুর কী বিবৃতি দিলেন, তাতে কিছু আসে যায় না।
মাটির বাঁধ দিয়ে প্রমত্তা নদীর প্রবাহ থামানো যায় না, কৃত্রিমভাবে চরও তৈরি করা যায় না, যখন হয় তা প্রাকৃতিক নিয়মেই হয়। বিবৃতিতে কাজ না হলে হুজুররা হয়তো দু-একটা বোমা ফাটাতে পারবেন, তাদের উন্মাদ ভক্তদের পাঠাতে পারবেন ঝামেলা সৃষ্টি করাতে, কিন্তু সেসব বিশাল সমুদ্রে ক্ষুদ্র একটা ঢিলের চেয়ে বেশি আলোড়ন তুলতে পারবে বলে তো মনে হয় না।
তবে আমি এটা মানি, বৈশাখী উৎসব পালন নিয়ে কিছু বাড়াবাড়ি হয়তো আছে। এটা সব কিছু নিয়েই হয়। কী নিয়ে বাড়াবাড়ি নেই? কোরবানি নিয়ে কি বাড়াবাড়ি নেই এ দেশে? বাড়াবাড়ি যারা করার, তারা সব কিছুই নিয়েই করে। বিশাল বিশাল গরু কিনে, গলায় মালা পরিয়ে ব্যান্ড বাজিয়ে, কত লাখ টাকা দিয়ে কেনা হলো সেটা বলতে বলতে যারা বাড়িতে নিয়ে আসে- তাদের আচরণে আর যা-ই হোক ধর্মটা নেই।
এ দলের লোকেরাই আবার বৈশাখে পান্তা-ইলিশের নাম করে নিজস্ব সম্পদের প্রদর্শন করে। আগেরটা যেমন ধর্ম নয়, এটাও তেমনি বাঙালিয়ানা নয়। আগেরটাকে যেমন ধর্মের উদাহরণ হিসেবে দেখানো যাবে না, তেমন এটিকেও বৈশাখী উৎসবের মূল ধারা হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না।
আবার বিপরীত দিকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রা করার সরকারি নির্দেশনাকেও আমি অভিনন্দন জানাতে পারছি না। এর কোনোই দরকার ছিল না। যারা অনুভব করবে, মনের ভেতর থেকে তাগিদ অনুভব করবে, তারা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। আবার মনের ভেতর থেকে আগ্রহ অনুভব করা সত্ত্বেও অনেকে হয়তো পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে করতে পারবে না, সেটাও তাদের ব্যাপার। এখানে রেজিমেন্টেশন বিষয়টা থাকা ঠিক নয়। কিন্তু সরকারি নির্দেশনার মাধ্যমে যেন সেটাই হলো। এ রকম হয়, আগেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে।
যখন কোনো একটি ঘটনা সফলতা পেয়ে যায়, মানুষ যখন কোনো বিষয়কে তার আত্মার বিষয বলে মনে করতে থাকে, তখন সরকার চেষ্টা করে তার ক্রেডিটটা নিজে নিয়ে নিতে। সরকার এত দিন কিছু বলেনি, কিন্তু যে-ই না ইউনেস্কো এ মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় নিয়ে নিল, অমনি সরকার এতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। নির্দেশনা দিল দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটি পালনের।
যদিও এর কোনো দরকার ছিল বলে আমি মনে করি না, তারপরও বলব, সরকার যখন একটা নির্দেশনা দিয়েই ফেলেছে তখন এটির যথাযথ বাস্তবায়নের দায়িত্বও কি তারই নেওয়া উচিত নয়? ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে মোল্লাদের এ বিবৃতি, লম্ফঝম্প কি হুমকির কারণ নয়? এ প্রতিবন্ধকতা নিরসনে সরকার কি এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে? তারা তো এতটুকু অন্তত বলতে পারত যে, সরকারি নির্দেশনার বিপরীতে এ ধরনের বিবৃতি বা হুমকি দেওয়া ঠিক নয়।
বিবৃতিদাতাদের সঙ্গে সরকার বসতে পারত, তাদের জানাতে পারত যে সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে কী পরিণতি হতে পারে। প্রশাসনিকভাবে কেউ কিছু না বললে, দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য তো বাড়তেই থাকবে।
মাসুদ কামাল : লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
ঢাকাটাইমস/১১এপ্রিল/এমকে/টিএমএইচ

মন্তব্য করুন