ডাক্তারদের উপর এতো ক্ষোভ কেন আমাদের?
সাহিত্যিক ম্ঈনুল আহসান সাবের সকাল সকাল একটা কৌতুক শোনালেন-
বীরবলকে নিয়ে সম্রাট আকবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসে ছিলেন। বললেন, এটা কি তুমি জানো বীরবল, একসময় বলা হতো, এদেশে কবির সংখ্যা বেশি ...। আকবরের কথা শেষ হওয়ার আগে বীরবল বললেন: সম্রাট, এখন কিন্তু ডাক্তারের সংখ্যা বেশি।
আকবর অবাক, বললেন, ‘কি বলো তুমি, তেমন কিছু তো চোখে পড়ল না’।
: অধিকাংশ দক্ষ ডাক্তার এই পেশায় কর্মরত নয় বলে এটা আপনার চোখে পড়েনি।
: সে কী কথা! দক্ষ যারা তারাই কর্মরত নন! তো, কী করেন তারা?
বীরবল বললেন: তারা সবাই সাংবাদিক।
সাবের ভাইয়ের কৌতুকের ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। গত ১৮ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আফিয়া আক্তার মারা গেছেন ভুল চিকিৎসায় বলে যে খবর গণমাধ্যমে এসছে তার যথার্থতা দিকেই আঙুল তুলেছেন তিনি। এবং এই আঙুল তোলাটা একেবারেই অনর্থক নয়, বরং খুবই যৌক্তিক। আফিয়া আক্তারের প্রতি সম্পুর্ণ সমবেদনা রয়েছে আমার। এরকম একটি তরতাজা প্রাণ এমন অকালে ঝরে যাবে এটা কারোরই কাম্য নয়।
আফিয়ার মৃত্যু দুঃখজনক। তার মৃত্যুতে সহপাঠীরা কষ্ট পাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই উত্তেজিত ছাত্ররা সেদিন যা করেছে সেটা মোটেই কাম্য নয়। হাসাপাতালে ভাঙচুর করা, ডাক্তারদের মারধর করা কোনো দায়িত্বপূর্ণ আচরণ নয়। কেননা হাসপাতাল কারো পৈত্রিক সম্পত্তি না। আর হাসপাতালে সেদিন আফিয়াই একমাত্র রোগী ছিলেন না। সেখানে আরো অসংখ্য রোগী ছিলো যাদের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়েছিলো এই উত্তেজিত তরুণদের ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার কারণে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো গণমাধ্যম এই পুরো ঘটনাটাকে প্রচার করল, ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুতে ছাত্রদের প্রতিক্রিয়ার ঘটনা হিসেবে। কাজটা ঠিক হয়নি। কেননা ওইদিন ওই অবস্থায় কোনোভাবে নিশ্চিত হওয়ার উপায় ছিলো না যে আফিয়ার মৃত্যু ডাক্তারের ভুল চিকিৎসাতেই হয়েছে। তার অসুখ এতোটাই জটিল ছিলো যে তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে নিশ্চিত হবার কোনো উপায় ছিলো না। তবুও গণমাধ্যমে ঘটনাটা এভাবেই আসলো। উপরন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা চাপ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রসাশনকে হুড়োহুড়ি করে মামলা করতে বাধ্য করলো। পুলিশ মামলা নিয়ে হাসপাতালের পরিচালককে গ্রেপ্তার করল।
এই ঘটনায় মামলা করা হয়েছে আট জন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। তার মধ্যে অন্যতম আসামি হচ্ছেন অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ। ২০১৬ সালে একুশে পদক পাওয়া চিকিৎসক। উনার লেখা ছয়টা বই আছে, যেগুলো পড়ে শুধু বাংলাদেশের চিকিৎসকরাই না, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ডাক্তাররা তাদের উচ্চতর ডিগ্রি হাসিল করেস। তার ছাত্ররা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি পড়ান। ডাক্তারদের ভুল হরহামেশাই হয়। সেই ভুলে রোগী মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। আবার ডাক্তার ঠিকঠাক চিকিৎসা করলেও রোগী মারা যেতে পারেন। এটা অসম্ভব কিছু না। কিন্তু আফিয়া ডেঙ্গুতে মারা গেছেন না ব্লাড কান্সারে, তার চিকিৎসায় কোনো ভুল হয়েছিলো কি হয়নি সেই বিচারের ক্ষমতা কারো নেই। না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের, না প্রক্টরের, না সাংবাদিকের, না পুলিশের নেই। কারো নেই।
ডা. আব্দুল্লাহ ভুল করেছেন নাকি করেননি সেটার বিচার করতে পারবেন একমাত্র ডাক্তাররাই। আর এ ভারটা তাদের উপরই ছেড়ে দেয়া উচিৎ, কেননা বাকি কারো এ যোগ্যতা আসলে নেই। থাকলে তাদেরকে অসুখ বিসুখে ডাক্তারের কাছে যেতে হতো না।
যদিও এ পেশায় দেশের সবেচেয়ে মেধাবীদের নিয়ে আসবার একটা চল ছিলো, কিন্তু প্রশ্নফাঁস আর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ছাত্র ভর্তির এ জামানায় ডাক্তাররা মেধার শ্রেষ্ঠত্বের দাবি খুবই শিগগির পুরোপুরি হারিয়ে ফেলবেন। আবার প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে থেকে ডাক্তার বেরুচ্ছে। তাদের মান জ্ঞান ইত্যাদি নিয়ে মন্তব্য করতে না যাওয়াই শ্রেয় হবে। কেননা যারা এ পেশায় জড়িত তারা নিজেরাও নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না চিকিৎসা পেশাজীবী হিসেবে তাদের মান আসলে কেমন হবে। সুতরাং অদূর ভবিষ্যতে ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসায় বহু রোগীর জীবন বিপন্ন হবে একথা বলতে হলে আপনাকে জ্যোতিষী হবার দরকার পড়বে না।
আবার এটাও সত্যি এই পেশায় মেধাবীদের মূল্যায়ন আমরা করিনি। কেন না এইদেশে রোগী ভালো হলে খোদার রহমত, ডাক্তার তখন হয়ে যায় অসিলা মাত্র। কিন্তু রোগী মরে গেলে সব দোষ ডাক্তারের। বিচারটা একপেশে হয়ে গেলো না?
মূল প্রসঙ্গে আসি। হাসপাতাল ভাঙচুরের ঘটনা এদেশে হরদম ঘটছে। বোঝাই যায় ডাক্তারদের প্রতি আমাদের ক্ষোভটা প্রবল। এটা নিয়ে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এ দায় কার? ডাক্তারদের একার? আমি বলবো- না। ডাক্তারদের একার দায় এটা কোনো ভাবেই হতে পারে না। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় আখড়া। একথা অস্বীকার করার অবস্থা কোনো ভাবেই খোলা রাখেননি এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের যে কোনো খাতের চেয়ে এখাতে ভুক্তভোগীর সংখ্যা এতো বেশি যে তাদের অভিযোগ যদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আসলেই শুনতে শুরু করে তাহলে হয়তো এজন্য তাদের একটা আলাদা অধিদপ্তর খুলতে হবে। অব্যবস্থাপনার কোনো বিশ্বরেকর্ডের সুযোগ থাকলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত এই রেকর্ড এমনভাবে গড়তো যে কেউ ভাঙার জন্য কাছাকাছি যাওয়ারও সাহস করতো না।
এর একটা অংশের দায় অবশ্যই ডাক্তারদের নিতে হবে। এ পেশায় যারা আছেন তারা অনেকবার অনেকভাবে নিজেদেরকে অমানুষ প্রতিপন্ন করেছেন। অহেতুক অজস্র পরীক্ষা নিরীক্ষা লিখে দিয়ে, ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ৩০-৫০% কমিশন নিয়ে, ভুল রোগ নির্ণয় করে ভুল চিকিৎসা দিয়ে, ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির কাছ থেকে উপহার নিয়ে, কমিশন নিয়ে নিম্নমানের ওষুধ লিখে দিয়ে, না লাগলেও খামাখা ওষুধ দিয়ে, চিকিৎসার উপকরণের ব্যবসায় অনৈতিক সহযোগিতা করে, আইসিইউতে রোগীর মৃত্যুর পরও আটকে রেখে বাড়তি টাকা বিল করে, সেবার কথা ভুলে গিয়ে শুধু ব্যবসার কথা ভেবে এদেশের অজস্র অসংখ্য মানুষকে নি:স্ব করার পেছনে তাদের হাত রয়েছে। এ কথা অস্বীকার কোনো উপায় নেই।
অল্প কদিন আগেই কিছুদিন আগে বগুড়া মেডিকেলে ডাক্তার হতে যাওয়া ইন্টার্নির ছেলেমেয়েরা রোগী আর তার স্বজনদের সাথে কী করেছিল সেটা আমরা এখনো ভুলে যাইনি। দেশের ডাক্তাদের একটি অংশ সেই অনৈতিক আন্দোলনে সেই ইন্টার্নদের সাথে সংহতি জানিয়েছিলেন। এরকম ভয়ানক বাস্তবতার মুখোমুখি এদেশের মানুষকে কতবার হতে হয়েছে সেটা নতুন কর বলার কিছু নেই।
তার মানে কিন্তু এই না যে এদেশে ভালো ডাক্তার একজনও নেই। তারমানে কিন্তু এই না যে আমরা ঢালাও ভাবে সব ডাক্তারকে ‘কসাই’ বলবো। এরকমটা করলে সেই মানুষগুলোর প্রতি নিসন্দেহে অবিচার করা হবে যারা সত্যি সত্যি সেবার জন্য কাজ করে, অর্থ কিংবা খ্যাতির জন্য নয়। লেখক: জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ
মন্তব্য করুন