নির্বাচিত বব ডিলান
একদিন ভাবানুবাদের হিমালয় পাড়ি দেবে বিপুল হাসান
নির্বাচিত বব ডিলান বইটি যেদিন বন্ধুবর বিপুল হাসান অটোগ্রাফসহ দিলেন তখন এর পরিচ্ছন্ন ও চকচকে কাভার দেখে কেবলি মনে হচ্ছিল বইটি কখন পড়তে শুরু করব। ঈদুল ফিতরের ঠিক দুদিন আগে বইটি হাতে পেয়েছি বলে ঈদের ছুটিতে পড়ার জন্য গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু গ্রামে গেলে যা হয়, সময়ের অভাবে বইটি পড়া হয়ে ওঠেনি। ঈদ শেষে ঢাকা শহরের বিরক্তিকর জ্যামকে সুখময় করতে অফিসে যাবার সময়কেই মোক্ষম মনে হল নির্বাচিত বব ডিলানকে পড়তে।
শুরু করলাম বব ডিলান…।সাধারণত আমি যখন কোন বই পড়ি সেক্ষেত্রে ভাল কোন লেখক সাহিত্যিক না হলে এর ভূমিকা পড়া হয়ে ওঠে না। কিন্তু নির্বাচিত বব ডিলান শুরু করলাম একেবারে শুরু থেকে। ভূমিকা পড়ে বইটি পড়ার আগ্রহ আমার আরো বেগবান হল।বিপুল হাসান বব ডিলানকে শুরুতেই পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বব ডিলানের ভূমিকাকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত জর্জ্ হ্যারিসনের ’কনসার্ট্ ফর বাংলাদেশ’ এর যে অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান তাও উল্লেখ করতে ভুললেন না। জানতে পারলাম ওই কনসার্টে নাকি দর্শক শ্রোতারা বব ডিলানকে পেয়েছিলেন বাড়তি পাওনা হিসেবে। বব ডিলান একজন শিল্পী হয়ে সাহিত্যে কেন নোবেল পেলেন সেটাও অনেকে জানতে পারবেন বইটি থেকে। এরপরই মূলত ভাবানুবাদ করা হয়েছে বব ডিলানের নির্বাচিত ২২ টি গানের। নির্বাচিত এই ২২ টি গানই বব ডিলানের বিখ্যাত সব কাজ থেকে বাছাই করা হয়েছে। সেটা আপনারা অনুধাবন করবেন ২২টি গানের ভাবানুবাদ থেকেই।
নিজের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি যতই বইটির গভীরে প্রবেশ করেছি ততই আমি মোহাচ্ছন্ন হয়েছি। এই বইটি না পড়লে ডিলানের কালজয়ী অনেক আবিষ্কার সম্পর্কে তার ভক্তরা জানতে পারবেন না। কি গভীর মমতায় এবং কত সহজে বিপুল বব ডিলানের কঠিন কথার ভাবার্থ্ করেছেন সেটা নির্বাচিত বব ডিলান না পড়লে কেউ উপলব্ধি করতে পারবেনা। আমি নিজেও হয়তো বইটি না পড়লে জানতেই পারতাম না কবির সুমনের গাওয়া বিখ্যাত গান ‘কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়’ বব ডিলানের থেকে ধার করা হয়েছে। আবার বিখ্যাত সংগীত শিল্পী অঞ্জন দত্তের সেই নামকরা গান ‘তুমি না থাকলে আকাশটা এত মিষ্টি হত না’ বব ডিলানের ‘ইফ নট ফর ইউ’র ভাবানুবাদ! কি আশ্চর্য্! বব ডিলানকে আমরা বাংলাভাষায় শুনছি কিন্তু সেটা জানি না। হ্যা পাঠক আমাদেরকে সেটাই জানিয়েছে নির্বাচিত বব ডিলান বইটি।বইটির পরতে পরতে বিপুল হাসানের আন্তরিকতার যে ছোঁয়া রয়েছে সেটা তার নিন্দুকেরাও স্বীকার করবেন যদি তারা পড়ে থাকেন। এত দূর্বোধ্য শব্দকে যে পড়ার উপযোগী করা যায় সেটাই দেখিয়েছেন বিপুল হাসান।
শুধুই কি গান আর কবিতায় আচ্ছ্বাদিত বইটি? মোটেই না। বব ডিলানের ভক্ত যারা আছেন তারা যদি ব্যক্তি বব ডিলানকে বিন্দুমাত্র জানতে যান তবে অবশ্যই তাদের বইটি পড়া উচিত কারণ বইয়ের শেষের দিকটাতে বিপুল ব্যক্তি বব ডিলানকে উপস্থাপন করেছেন।বইটিতে এ যাবৎ বব ডিলানের উল্লেখযোগ্য সব কাজেরই ফিরিস্তি রয়েছে। মোটা দাগে বলতে গেলে কম কথায় কম কাগজে বব ডিলানকে উপস্থাপন করা হয়েছে। যাদের খুব বেশি বই পড়ার অভ্যাস নেই কিংবা কম পড়ে বেশি জানতে চান তাদের জন্য বইটি মোক্ষম হাতিয়ার। আর স্বল্প জ্ঞানে আমি মনে করি বব ডিলানকে যারা ভালোবাসেন তাদের অবশ্যই তার সম্পর্কে সামান্য হলেও জ্ঞান আহরণ করা উচিত। বইটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল এটি আপনি পড়া শুরু করলে শেষ করতে হবে। আপনি ছাড়তে চাইলেও বইয়ের কথামালা আপনাকে আবদ্ধ রাখবে শেষ না হওয়া পর্য্ন্ত।
বইটর উৎসর্গকৃত পাতায় দুটি লাইন আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে। লাইন দুটি উল্লেখ করার লোভ সামলাতে না পেরে দিয়েই দিলাম। ‘মেরুদণ্ড যদি থাকে উজানে সাতরাও, নয় কানা ভিখারির মত পথ হাতরাও।’ আর নিজের স্ত্রীকে বইটি উৎসর্গ্ করে বিপুল হয়ত ভাবীকে তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহারটিই দিয়েছেন।
লেখক: আফরিন জাহান
সাংবাদিক ও গবেষক
(ঢাকাটাইমস/১২জুলাই/এজেড)