রোহিঙ্গা সংকট-১

নিজভূমে নির্যাতিত পরভূমে আশ্রিত

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
| আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৭:৩৭ | প্রকাশিত : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৭:০৯

সাগরের পারে ঘুমিয়ে আছে তারা। ছোট ছোট হাত-পা, কালো হয়ে গেছে মুখগুলো। চোখ দুটো বুজে আছে চরম অভিমানে। আকাশের বিশালতার দিকে তাকাবে না, যেন এই পণ করেছে তারা। আকাশের দিকে তাকালে পরিচয় মেলে বিপুলা পৃথিবীর। অথচ এখানে এতটুকু আশ্রয় হয়নি নিষ্পাপ এই শিশুদের! অভিমান নয়, ঘৃণা নিয়েই সাগরে সলিল সমাধি হয়েছে নিষ্প্রাণ মুখগুলোর।

এই শিশুদের শিশু পরিচয়ের বাইরে বড় পরিচয় তারা রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের মানচিত্রে জুড়ে থাকা (আরাকানের) রাখাইন রাজ্যে জন্ম হয়েছিল তাদের। এই জন্মই যেন আজন্ম পাপ! মিয়ানমার তাদের দেশ। অথচ রাষ্ট্রযন্ত্র বলছে তারা সেদেশের কেউ নয়। তাদের অধিকার নেই সেখানে থাকার! তিন পুরুষের বেশি সময় ধরে যে মাটিতে তারা জন্ম নিয়েছে, সে মাটি নাকি তাদের নয়! নিজভূমে পরবাসী। গত ত্রিশ বছর ধরে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের নির্যাতন চলছে। শুধু নির্যাতন বললে ভুল হবে, অমানসিক নির্যাতন। চালাচ্ছে সেদেশের সেনা সদস্যরা। রাতে সবাই যখন ঘুমে তখন আগুন দেওয়া হচ্ছে ঘরে। ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন বাদ যাচ্ছে না কিছুই। সইতে না পেরে তারা দেশ ছাড়ছে। পাড়ি জমাচ্ছে বাংলাদেশে।

মিয়ানমারের সরকার বলছে এরা বাংলাদেশি। বাংলাদেশেই তাদের ফিরে যেতে হবে। অথচ যে মানুষজনকে নির্যাতন করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে তারা কখনোই বাংলাদেশের নাগরিক ছিল না। মিয়ানমার ধর্মীয় পরিচয় বিবেচনায় তাদের দেশের জনগণকে অন্যায়ভাবে এদেশে ঠেলে দিচ্ছে। এসব নিয়ে বাংলাদেশের কোনো প্রতিবাদকেই কানে তুলছে না দেশটি। দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। আর বিপাকে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

উত্তাল বঙ্গোপসাগর পার হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের চাইলেই ফিরিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আবার বাসস্থানের ব্যবস্থাও করা যাচ্ছে না। সাগরপার আর চট্টগ্রামের পাহাড়ি মানুষের জন্য রোহিঙ্গারা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের একটি সংস্থা সূত্র বলছে, গত ত্রিশ বছরে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। তারা কক্সবাজারের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটি বড় অংশ আছে জাতিসংঘ পরিচালিত শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তুলে দেওয়া অস্থায়ী ক্যাম্পে।

গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বরে সেনা নির্যাতন সইতে না পেরে রাখাইন রাজ্য ছেড়ে বাংলাদেশে চলে এসেছিল ৭৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে ফেরত পাঠানো গেলেও বাকিরা রয়ে গেছেন এদেশেই। এ বছরের ২৫ আগস্ট থেকে আবার রোহিঙ্গা ঢল নামল বাংলাদেশে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাত-দিন অভিযান চালিয়ে রাখাইন রাজ্য থেকে বের করে দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের। ঠেলে দিচ্ছে উত্তাল সমুদ্রের বুকে। মাছ ধরার ট্রলারে ভাসতে ভাসতে আসছে পরিবারগুলো। সন্তানসম্ভবা নারী, নবজাতক, বৃদ্ধ, যুবক কেউ বাদ যাচ্ছে না। সবার একই নিয়তি।

স্থানীয় প্রশাসন ও গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত ২৯ আগস্ট থেকে ৭ সেপ্টেম্বর সকাল পর্যন্ত ১০ দিনে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে রোহিঙ্গাবাহী ১৯টি নৌকা ডুবেছে। মারা গেছে ৯১ জন। এর মধ্যে টেকনাফ থেকেই ৮৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া উখিয়ায় নাফ নদী থেকে তোলা হয়েছে ৭টি মরদেহ। এর মধ্যে পাঁচটি শরীরেই গুলির দাগ ছিল। উদ্ধার হওয়া মরদেহের মধ্যে ৪৯টি শিশু, ২১ জন নারী এবং বাকিরা পুরুষ। সমীন্তরক্ষীরা বলছে, ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আটক ২ হাজার ৪০২ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তবে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়ে গেছে, যাদের ফেরত পাঠানো যায়নি।

টানা ৫৫ বছর সামরিক শাসন ছিল মিয়ানমারে। সামরিক জান্তার জাঁতাকলে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর। সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন হয়েছে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচন হয়েছে। জয়ী হয়েছে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। সু চিই এখন দেশটির স্টেট কাউন্সিলর। শান্তিতে নোবেল জয়ী এই নারী দীর্ঘদিন কারাগারে থেকেছেন জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের জেরে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আগে থেকেই অত্যাচার-নির্যাতন চলছিল। ধারণা করা হয়েছিল, সু চি দেশটির ক্ষমতায় আসার পর ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। আর যা-ই হোক, মানুষের ওপর অমানুষিক নির্যাতন বন্ধ হবে। সংখ্যালঘুরা তাদের অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারবে নিজভূমে। হয়েছে তার উল্টোটা। মানুষের আশার প্রতিফলন দেখা যায়নি। বরং সামরিক জান্তার চেয়ে আরও বেড়েছে বর্বরতা। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বেড়েছে। তাদের জোর করে বের করে দেওয়া হচ্ছে পৈতৃক নিবাস থেকে। বাপ-দাদারা যে মাটিতে জন্মেছেন, যে আলো-বাতাসে বড় হয়েছেন, সেখানে তাদের বলা হচ্ছে উদ্বাস্তু! নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে রাতের অন্ধকারে নীল সাগরের পানিতে ভাসাতে হচ্ছে জীবনতরী। [চলবে]

লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :