ধর্ম যার যার, উৎসব সবার

প্রভাষ আমিন
  প্রকাশিত : ০৮ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:১০
অ- অ+

অসাম্প্রদায়িক চেতনাই আমাদের অন্তর্নিহিত শক্তি। হাজার বছর ধরে আমরা মিলেমিশে আছি। যখনই ধর্ম আমাদের জাতীয়তাকে ছাড়িয়ে যায়, তখনই শান্তি নষ্ট হয়। এ কারণেই ধর্মকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা পাকিস্তান রাষ্ট্র টিকতে পারেনি। আর পাকিস্তান ভেঙে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ গড়ে উঠেছিল ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার ভিত্তিতে। এই চেতনাকে ভিত্তি ধরেই বিকশিত হয়েছে বাংলাদেশ। এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। কিন্তু বাংলাদেশ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র নয়। এখানে সব ধর্মের মানুষের স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করার অধিকার আছে। এখানেই বাংলাদেশের সৌন্দর্য। কিন্তু এই সৌন্দর্যে মাঝেমধ্যে কালি পড়ে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির নানা অপতৎপরতায়। আর এই অপশক্তিকে মদদ দেয় রাজনীতিবিদরা। জনবিচ্ছিন্ন এরশাদ জনসমর্থন পেতে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনলেও জনসমর্থন হারানোর ভয়ে বহাল রেখেছে রাষ্ট্রধর্ম। যদিও আজকে যারা ক্ষমতায় সেই আওয়ামী লীগসহ অধিকাংশ বিরোধী দল তখন ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার বিরোধিতা করেছিল।

এরশাদ যখন ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন, তখন প্রতিবাদী মিছিল থেকে উঠে এসেছিল অসাধারণ এক সেøাগানÑ ‘যার ধর্ম তার কাছে, রাষ্ট্রের কী করার আছে।’ আসলেই ধর্ম একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার। একে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে যত দূরে রাখা যায়, ততই মঙ্গল। ইদানীং আরেকটি অসাধারণ সেøাগান আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে তুলে ধরছেÑ ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’ তবে এই সেøাগানটি নিয়েও কেউ কেউ বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা করছেন। কদিন আগে শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় ফেসবুকে এক সাংবাদিক বন্ধুর স্ট্যাটাস দেখে চমকে গিয়েছিলাম। তিনি লিখেছেন, ‘কোরবানি ঈদের সকালে আমার এক হিন্দু বন্ধুকে ডেকেছিলাম। গরুটা বড় বলে জবাইয়ে তার হেল্প চাইলাম। আসতে পারবে না বলে জানালো। বললাম, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এখন সেই ডায়ালগ কই দোস্ত?’ কেউ কেউ এই স্ট্যাটাসকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু এটা হাস্যকর নয়, রীতিমতো ভয়ংকর। একজন হিন্দুকে গরু জবাই করতে ডাকা উসকানিমূলক।

আসলে আমরা একটা বিষয় গুলিয়ে ফেলছি। ধর্মীয় উৎসবের দুটি অংশÑ ধর্ম এবং উৎসব। ঈদে নামাজ এবং কোরবানি ধর্মীয় অংশ। কিন্তু এরপর দিনভর ঘুরে বেড়ানো, খাওয়া-দাওয়া, আড্ডাÑ সবই উৎসবের অংশ। তেমনি শারদীয় দুর্গোৎসবে দেবী দুর্গার পূজা যেমন আছে; তেমনি আছে আলোকসজ্জা, ঘোরাঘুরি, আনন্দ, খাওয়া-দাওয়া, নাচগানের উৎসবমুখরতাও। ধর্মীয় অংশটুকু যার যার ধর্মের, উৎসবটুকু সবার। আমি আমার কোনো হিন্দু বন্ধুকে গরু জবাইয়ে সাহায্য করতে ডাকব না। তেমনি পূজা দেখতে গিয়ে আমি শুধু উৎসবটাই উপভোগ করব, দুর্গা দেবীকে পূজা করব না। প্রবারণা পূর্ণিমায় ফানুস উড়ানো দেখতেও আমার ভালো লাগে, তেমনি ভালো লাগে রঙিন ক্রিসমাস ট্রি।

আমার হিন্দু বন্ধুরা যখন শারদীয় দুর্গোৎসবে মেতে থাকে, তখন কি আমরা মুখ গোমড়া করে বসে থাকব? বা আমরা যখন ঈদে আনন্দ করেছি, তখন কি আমার হিন্দু বন্ধুটি মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিল? আমি নাড়– খাওয়ার জন্য সারা বছর মনে মনে পূজার জন্য অপেক্ষা করি। আবার আমার অনেক হিন্দু বন্ধুর ঈদের সেমাই আর শবেবরাতের হালুয়া পছন্দ। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কিন্তু আমি শূকরের মাংস বা কাছিমের মাংস খাব, একজন হিন্দু গরুর মাংস খাবে; তা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা হলো সবাই নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে এবং অপরের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করবে।

এ অঞ্চলে বরাবরই অসাম্প্রদায়িক চেতনা ঊর্ধ্বে ছিল। ঢাকার দুটি ঐতিহ্যÑ তাজিয়া মিছিল আর জন্মাষ্টমীর মিছিল। এমনও হয়েছে, একই দিনে রাস্তার একপাশে তাজিয়া মিছিল হয়েছে, আরেক পাশে জন্মাষ্টমীর মিছিল গেছে। তাতে কারো কোনো অসুবিধা হয়নি। যেমন এবার বিজয়া দশমীর পরদিনই পালিত হয়েছে পবিত্র আশুরা। পুরান ঢাকার এমন অনেককে আমি চিনি, যারা প্রতিমা বিসর্জনের মিছিলেও ছিল, পরদিন তাজিয়া মিছিলেও ছিল। এখানে যতটা না ধর্ম, তার চেয়ে বেশি ঐতিহ্যের দায়। আবার পবিত্র আশুরার চারদিনের মাথায় একইদিনে পালিত হয়েছে লক্ষ্মী পূজা এবং প্রবারণা পূর্ণিমা। গত কদিন ধরেই শরতের বাতাসে উৎসবের আবির ছড়ানো। এই আমাদের বাংলাদেশ- সম্প্রীতির, সৌহার্দ্যরে।

প্রভাষ আমিন: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
একই ঘটনায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে মামলা: কার চাপে মামলা নিল খুলশী থানা?
সংস্কারের কথা সবার আগে আমরাই বলেছি: মির্জা ফখরুল
গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনায় জনতা ব্যাংকে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত
আন্তর্জাতিক এমএসএমই দিবস উদযাপন করল শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক 
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা