স্মরণে রাখার মত কী করে গেছেন আনিসুল হক?

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৪:৪৯

কদিন আগেই চলে গেলেন গুণী শিল্পী বারী সিদ্দিকী। সেই শোক কাটিয়ে না উঠতেই জাতিকে শুনতে হল আরেকটা দুঃসংবাদ। আনিসুল হককেও আমরা ধরে রাখতে পারলাম না। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পরে অবশেষে নিশ্চিত মৃত্যুর খবর জানা গেল আনিসুল হকের। কত মানুষই তো মারা যায়, সাধারণ মানুষ আফসোস করে না। এমনকি বর্তমান বাংলাদেশে বড় বড় রাজনীতিবিদ মারা গেলেও মানুষের মনে খুব একটা অভিঘাত সৃষ্টি হয় না। অথচ আনিসুল হক নিয়ে মানুষের যেন আফসোসের শেষ নেই। আনিসুল হককে এভাবে স্মরণ করছে কেন মানুষ? কী জন্য এতো আফসোস।

আনিসুল হক কী এমন কাজ করে গেছেন যে, তাঁকে এমন করে স্মরণ করতে হবে? মানুষের মনের কথা জানতে অত্যন্ত কৌশলে ফেসবুকে এমন একটা পোস্ট দিয়েছিলেন সাংবাদিক সোলায়মান নিলয়। কাঙ্ক্ষিত সব উত্তরও এসেছে এ প্রশ্নের।

সাংবাদিক নিলয়ের ফেসবুক ফ্রেন্ড নাজিরুল ইসলাম নাদিম কমেন্ট করেছেন, ‘আমি আপনার মতই ভাবতাম। এরপর মাঝে মাঝে গাবতলী দিয়ে যাওয়া আসা শুরু করলাম, মোহাম্মাদপুরে থাকা শুরু করলাম। ব্যাস,উত্তর পরিষ্কার হয়ে গেল’। বিবিসির সাংবাদিক রাকিব হাসনাত সুমনের মন্তব্য খুবই বস্তুনিষ্ঠ। তিনি লিখেছেন, ‘পুলিশ আর নেতাদের হাতে দখল হওয়া গাবতলীর রাস্তা,তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড এবং গুলশান বনানীর ফুটপাত মানুষকে ফিরিয়ে দেয়া........ঢাকার আকাশ বিলবোর্ড সন্ত্রাস থেকে মুক্ত করা...আর গণপরিবহন (বাস)... ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ..’।

জনপ্রিয় টেলিভিশন সংবাদ উপস্থাপক ফারাবি হাফিজ লিখেছেন, ‘বহু কিছু। আমার পারসোনাল লাইফে তার সাথে সখ্যতা সেটা একটা। আর গুরুত্বপূর্ণ একটা হচ্ছে আমার বাসার সামনের একলেনের ভাঙা রাস্তাকে উনি চারলেনের বিশাল হাইওয়ে বানিয়ে দিয়েছেন। যেটা মূলত অন্যদের দখলে ছিল’।

সদ্য সাবেক সেলিব্রিটি সাংবাদিক, জনপ্রিয় ব্লগার শরিফুল হাসান নিলয়ের পোস্টে লিখেছেন, ‘ট্রাক চালক মা‌লিক, সিএনজি চালক, মা‌লিক, টেন্ডারবাজ এরা নিজে‌দের মাস্তান ম‌নে ক‌রে। নেতারা সেই মাস্তান‌দের ক্ষেপান না কারণ সাহস নেই বা স্বার্থ আছে। আনিস ভাই সেই সাহস দে‌খি‌য়ে‌ছি‌লেন’।

রাজধানীর কূনিপাড়া এলাকায় সংস্কার প্রসঙ্গে জেসমিন পাপড়ি নামের একজন কর্মজীবী নারী লিখেছেন, ‘দীর্ঘদিন কুনিপাড়ায় অফিস করতে গিয়ে যত যন্ত্রণার শিকার হয়েছি তাতে এটা আমার কাছে অনেক বড় একটা ব্যাপার’। মাইনউদ্দিন আহাম্মেদ সেলিম লিখেছেন, ‘যাহা সরকার, প্রশাসন করতে সাহস করেনি আনিসুল তা করে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন, সে জন্য ঢাকা উত্তর সিটিতে যারা বসবাস করছেন এবং ভবিষ্যতে করবেন তারা তাকে স্মরণ করতেই হবে।

সাংবাদিক নিলয়ের আরেক ফেসবুক বন্ধু রাসেল আহমেদ লিখেছেন, ‘গুলশানে প্রতিবছর আইল্যান্ড বানানো বন্ধ করে স্থায়ী সমাধান দিয়েছেন। মার্কেটের সামনে হকার উঠিয়েছেন। এয়ারপোর্ট রোডে বনসাই লাগানোর বিরোধীতা তিনি শুরু করেছেন। আরো অনেক যা অন্যেরা বলেছেন’।

আরেক মন্তব্যকারী ফয়সাল আতিক লিখেছেন, ‘তিনি সাহস দেখিয়েছেন। তার জীবন ছিল উচ্চ গতির। বনায়ন, ঢাকাকে যানজটমুক্ত করার প্ল্যান, বর্জ্য অপসারণে আধুনিক ব্যবস্থা, পরিচ্ছন্ন টয়লেট… স্বল্প সময়ে এমন আরও অনেক কিছু। তিনি পরিকল্পনাগুলো কাগজে আঁকার পাশাপাশি মনেও রাখতেন সবসময়’।

আনিসুল হকের প্রভাব মানুষের উপর কেমন ছিল তার একটা উদাহরণ দিয়েছেন আরিফুল হক নামের আরেকজন ফেসবুক ব্যবহারকারী। তিনি লিখেছেন, ‘অন্তত স্বপ্ন দেখার সাহস তো দিয়েছিলেন! উত্তরার এক লোক বলছিলেন তিনি নিজের পারিবারিক কবরস্থানের জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন রাস্তা তৈরির জন্য, এবং একাজে তাকে কেউ বাধ্য করেনি!’

যারা কমেন্ট করেছেন, তাদের কেউই ঠিকাদার কিংবা দলীয় নেতা-কর্মী নন। সবাই শিক্ষিত ও কর্মজীবী মানুষ। বর্তমান সমাজে প্রশংসা বা কাজের স্বীকৃতি প্রায় উঠেই গেছে। প্রশংসার নামে যা আছে তা হল চাটুকারিতা। একে নিজেরা ভালো কাজ করতে ভুলে যাচ্ছি আমরা, অন্যদিকে অন্যের ভালো কাজের প্রশংসাও করতে পারি না। নির্মোহ প্রশংসা যেন সোনার হরিণ নয়, স্বপ্নের হরিণ হয়ে উঠেছে। এমন একটা সমাজে শিক্ষিত নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের তরুণ প্রতিনিধিরা যখন আনিসুল হকের জন্য দুঃখ করে, প্রশংসা করে, আফসোস করে তখন বুঝতে হবে আনিসুল হক অরাজকতার শহর ঢাকায় সত্যিকার অর্থেই এমন কিছু করেছেন যা মানুষের মনে রেখাপাত করেছে।

সবচেয়ে বড় কথা, আনিসুল হকের কথা ও কাজের মিল পেয়ে নগরবাসী তাঁকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। দেশের রাজনীতিবিদদের এমন অবস্থা, হাতে গোনা কয়েকজন রাজনীতিবিদ ছাড়া দেশের মানুষের কাছে অধিকাংশের কোনো গ্রহণযোগ্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এমন বিশ্বাসহীন এবং সন্দেহপ্রবণ একটি সমাজে মানুষের শ্রদ্ধা পাওয়া সহজ কথা নয়।

গাবতলি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন মহাসড়ককে ক্লিয়ার রাখা কি সহজ কাজ? শ্রমিক নেতা, শ্রমিক, পুলিশ, স্থানীয় নেতা-কর্মী সব মিলে যে দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে এই শহরে, সেখানে একজন অরাজনৈতিক মেয়রের পক্ষে এমন একটা কাজ করে ফেলা আদৌ সহজ কাজ নয়। আনিসুল হক পেরেছিলেন। তিনি পেরেছিলেন, কারণ এ শহর নিয়ে তাঁর স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছিল তীব্র ইচ্ছা ও উদ্যোগ। ঢাকা উত্তরের একাধিক সাংসদ, রাজনৈতিক ও নানা ক্ষেত্রের প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে ম্যানেজ করে ফুটপাত পরিষ্কার করা, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে উদ্যোগী হওয়া কিংবা অবৈধ হকারমুক্ত করার মত কাজ খুব কঠিন এই শহরে। যেমন তেজগাঁও অঞ্চলের বহুল আলোচিত অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড আর্মি ছাড়া কেউ উচ্ছেদ করতে পারবে, আমরা কেউই ভাবিনি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আনিসুল হক এ অসাধ্য সাধন করেছিলেন।

বারিধারায় কূটনৈতিক এলাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশের দূতাবাসগুলো অবৈধভাবে ফুটপাত দখল করে রেখেছিল। এতদিন এদিকটায় কেউ মনোযোগই দেননি। আনিসুল হক তাদের নোটিশ পাঠালেন। আইনি প্রক্রিয়ায় বাধ্য করলেন ফুটপাত ছেড়ে দিতে। অনেক শিক্ষিত, সাহসী, স্বাপ্নিক, উদ্যোগী এবং উদ্যমী না হলে এমন কাজ করা যায় না। আমরা নিজ বাসা-বাড়ির সামনে পড়ে থাকা একটা ইটের টুকরা পর্যন্ত সরাতে চাই না। এমন উদ্যোগহীন, উদ্যমহীন শহরে আনিসুল হক তাই একজন ব্যতিক্রম মানুষ ছিলেন।

ঢাকায় গণপরিবহন ব্যবস্থায় একটা আমূল পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন আনিসুল হক। সাম্প্রতিককালে ঢাকায় যানজট মানুষের সহ্যের বাইরে চলে গেলে আনিসুল হক কয়েক হাজার নতুন বাস নামানোর কথা বলেছিলেন। অসুস্থ না হয়ে পড়লে এ প্রক্রিয়ায় নিশ্চয় একটা অগ্রগতি হত। অথচ এই শহরে সব মন্ত্রী, এমপি, বেসামরিক-সামরিক সব বড় বড় আমলা, রাজনীতিবিদদের বসবাস। মানুষকে পেছনে ফেলে এই ভিআইপিরা যখন এসি গাড়িতে চলে যান, তখন এই নগরের ধুলাবালি, গরম, ঘাম তাদেরকে স্পর্শ করে না। মানুষের প্রতি অধিকাংশ নীতি-নির্ধারকের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। সেখানেই ব্যতিক্রম ছিলেন আনিসুল হক। তিনি শহরে ৪ হাজার বাস নামাতে চেয়েছিলেন। নতুন চার হাজার বাস নামলে, প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে, পাশাপাশি মেট্রোরেল চালু করা গেলে আমাদের ঢাকার চেহারায় অকল্পনীয় পরিবর্তন আসবে, এটি নিশ্চিত বলা যায়। ফুটপাতগুলো নতুন করে বেধে, পরিষ্কার রেখে, রাস্তাগুলো সংস্কার করে ঢাকা উত্তর এলাকায় বড়সড় পরিবর্তন আনতে শুরু করেছিলেন আনিসুল হক।

যতটুকু জানি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৫/৬ ঘণ্টা ঘুমান। বাকি সময়টা দেশের উন্নয়ন, পার্টি সামলানো ও বিদেশি বন্ধু/শত্রুদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা ইত্যাদি দায়িত্ব পালনে ব্যয় করেন। মেয়রের মত একটা লোভনীয় পদে অনেকেই যেতে চেয়েছিলেন নিশ্চয়। শেখ হাসিনা কিন্তু আনিসুল হককেই মনোনয়ন দিয়েছিলেন। জাতির পিতার যোগ্য কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে একটা সুন্দর অবস্থানে পৌঁছে দিতে দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আনিসুল হককে দিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ঢাকা শহরকে পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন। আনিসুল হকও তাঁর উপর প্রধানমন্ত্রীর আস্থার সম্মান দিতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু এর মধ্যেই তিনি চলে গেলেন। আনিসুল হকের বিকল্প পাওয়া কঠিন হবে। মেয়র হতে পারেন অনেকেই। কিন্তু আনিসুল হকের মত মেয়র সহসা আসবেন বলে মনে হয় না। যদি আসে, আলহামদুলিল্লাহ। আর যদি না আসে, তাহলে বুঝতে হবে একটা ভালো শহরে বাস করার স্বপ্ন আমাদের অপূর্ণই থেকে যাবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :