দুই যুগ আগে বন্ধ সুতা কল আজ বিধ্বস্ত পুরাকীর্তি

খাইরুল ইসলাম বাসিদ, পাবনা
 | প্রকাশিত : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ০৯:১৪
ফাইল ছবি

৭০ দশকের শেষ দিকে পাবনায় শিল্পায়নের অত্যতম প্রতীক হয়ে ছিল ‘ক্যালিকো কটন মিল’। কিন্তু মালিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আর নানা কারণে দুই যুগ ধরে বন্ধ হয়ে আছে কারখানাটি। চুরি গেছে কারখানার প্রায় সব যন্ত্রপাতি। আর এ কারণে ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ সুদে আসলে বাড়তে ১০ গুণেরও বেশি হয়ে গেছে। এই অবস্থায় ব্যাংকের ঋণ আদায় নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

কারখানাটি চালু থাকার সময় সাত থেকে আটশ শ্রমিক কাজ করতো এখানে। আবার পরোক্ষভাবে আয় করতো আরও কয়েক হাজার মানুষ। শ্রমিকদের দেনা পাওনা না মিটিয়ে হঠাৎ কারখানাটি বন্ধ করে দেয়ার পর দুঃসহ পরিস্থিতিতে পড়ে তারাও।

৭০ ও ৮০ দশকের জমজমাট মিলটি এখন যেন এক বিধ্বস্ত পুরাকীর্তি। পাবনা শহরে প্রবেশের মুখেই চোখে পড়বে দৃশ্যটি। সবুজ ঘাসে ছেয়ে থাকা ঢাকা-পাবনা মহাসড়কসংলগ্ন বিশাল মাঠের মধ্যে মাথা তুলে আছে কয়েকটি ভাঙা ইটের দেয়াল আর কংক্রিটের খুঁটি। ওপরের দিকে খাঁজকাটা আকৃতি দেখে বোঝা যায়, কোনো একটি কারখানা ছিল এককালে।

কারখানা ভবন এবং জমির নিরাপত্তার জন্য এলাকায় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আনসার সদস্য এবং মালিকপক্ষ থেকে কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকলেও লুটপাট হয়ে গেছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এখন খুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভবনের ইটও।

পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে পাবনা-ঢাকা মহাসড়কের পাশে রাজাপুরে তিন ব্যবসায়ী ১২০ বিঘা জমির ওপর ‘ক্যালিকো কটন মিল’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি নিবন্ধিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। ১২০ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত কারখানাটিতে উৎপাদন শুরু হয়েছিল পরের বছর, ১৯৬৮ সালের ১১ নভেম্বর থেকে। এখানে ৪৮০ জন নিয়মিত শ্রমিকসহ প্রায় ৮০০ শ্রমিক কাজ করত।

কারখানা ভবন ছাড়াও ছিল তুলা ও সুতা রাখার গুদাম, প্রশাসনিক ভবন, কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের আবাসিক ভবন, মসজিদ, শহীদ মিনার ইত্যাদি ছিল।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই লাভজনক কারখানাটি ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৮৩ সালে সরকার ৪৯ শতাংশ শেয়ার রেখে ৫১ শতাংশ মালিকপক্ষকে দিয়ে দেয়। পরে মালিকপক্ষ নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লে মিলে স্থবিরতা নেমে আসে। এক পর্যায়ে শ্রমিকদের বেতনভাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিক অসন্তোষে মিলের কার্যক্রমে অচলাবস্থা দেখা দেয়।

১৯৯২ সালে মিলটি সচল করতে শ্রমিক-মালিক উভয় পক্ষ অগ্রণী ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়। সে সময় বিটিএমসির আড়াই কোটি টাকা ঋণসহ মিলটি বেসরকারি উদ্যোক্তা মালিকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর মিলটি সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

ওই বছরই ৮ এপ্রিল অগ্রণী ব্যাংক পাবনা শাখা পাঁচ কোটি ১২ লাখ টাকার ঋণ অনুমোদন হয়। এর মধ্যে তিন কোটি ৭৭ লাখ টাকা দেয়া হয়। কিন্তু মালিকদের দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব এবং শ্রমিকদের অসন্তোষের কারণে ১৯৯৩ সালে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ সময় শ্রমিকদের বকেয়া বেতনের ২৫ লাখ টাকা এবং ভবিষ্য তহবিলের (প্রভিডেন্ড ফান্ড) ৫০ লাখ টাকা নিয়ে পাবনা ছাড়েন মালিকপক্ষ। এরপর কারখানাটি আর চালু হয়নি।

২৪ বছর আগে নেয়া ঋণের সুদ বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় ৪৭ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। তবে মিল মালিকদের দাবি, ব্যাংক তাদের কাছে পাবে তিন কোটি ৭৭ লাখ টাকা।

অগ্রণী ব্যাংক তাদের পাওনা আদায়ের দাবিতে অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করে। আদালত ২০০৩ সালের ৭ মে দুই কোটি ৯০ লাখ ৫৯ হাজার টাকা পরিশোধে মিল মালিকদের নির্দেশ দেয়। অগ্রণী ব্যাংক এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করে কিন্তু আপিল খারিজ হওয়ায় ব্যাংক পুনরায় রিভিউ করেছে।

১৯৮৩ সালে মিলটি পরিচালনায় ছিল নয়জন পরিচালক। এদের মধ্যে সাতজন পরিচালক মারা গেছেন। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং একজন পরিচালক জীবিত আছেন। মিলের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তারা বলেন, আদালতে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না।

ব্যাংকের বিরুদ্ধে সময়ক্ষেপণের অভিযোগ এনে দুই মালিক বলেন, তাদের কারণে কারখানার শত কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে। মূল ভবনে বড় বড় মেশিনসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদের আজ কিছুই নেই। মেশিনের খুচরা যন্ত্রাংশ পর্যন্ত চুরি হয়ে গেছে। ভবনের টিন, জানালা দরজা কিছুই আজ নেই।

অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, মিলটির নিরাপত্তার জন্য বন্ধের পর ১৯৯৬ সাল থেকে সময়ভেদে ২২ থেকে সাতজন পর্যন্ত আনসার নিয়োগ করা আছে। আর এ আনসারদের বেতনভাতা বাবদ ২২ বছরে প্রায় এক কোটি টাকা দেয়া হয়েছে।

ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, মিলের সব সম্পদ চুরি ও লুটের বিষয়ে পাবনা থানায় মামলা করা হয়েছে। তা এখন বিচারাধীন।

একাধিক আনসার সদস্য জানান, বিদ্যুৎব্যবস্থা না থাকায় তাদের পক্ষে এখানে নিরাপত্তা তো দূরের কথা, নিজেদের থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। রাত হলেই এখানে শুরু হয় অসামাজিক কার্যকলাপ। একাধিকবার কারখানার মূল ভবনের ভেতর থেকে অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ক্যালিকো কটন মিল শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক এক শ্রমিক নেতা জানান, মিলটি বন্ধ হওয়ার পর প্রায় অর্ধশত শ্রমিক অনাহারে-অর্ধাহারে মারা গেছেন। আর ৭০০ শ্রমিক পরিবার অভাবের তাড়নায় অতি কষ্টে দিন পার করছেন।

ঢাকাটাইমস/০৪ডিসেম্বর/প্রতিনিধি/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :