ওসমানী কেন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ছিলেন না?

১৯৭১ সাল। ১৬ ডিসেম্বর। বৃহস্পতিবার। রেসকোর্স ময়দান। পাশাপাশি বসে আছেন পূর্ব রণাঙ্গনে ভারত ও বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। তাদের সামনে একখানা টেবিল। তার উপরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব-ফারজ-রাফায়েল জ্যাকবের প্রস্তুত করা একটি নথি। ঘড়িতে বিকেল চারটা বেজে ৩১ মিনিট হতেই এর দুপাশে দুটি দস্তখত পড়ে।
বিনোদিত-মনে ভারত আর বাংলাদেশের হয়ে একটি করেন অরোরা। অন্যটি পরাজয়ের ঘøানি নিয়ে নিয়াজি। স্বাক্ষর শেষে দুজনায় উঠে দাঁড়ান। আর আত্মসমর্পণের প্রচলিত রীতি অনুসরণ করে জেনারেল নিয়াজি নিজের রিভলবারটি কাঁপা কাঁপা হাতে জেনারেল অরোরার হাতে তুলে দেন। এভাবেই পৃথিবীর বুকে চিরস্থায়ী জায়গা করে নেয় নবীন এক রাষ্ট্র বাংলাদেশ। লাল-সবুজের বুকে সোনালি মানচিত্র খচিত পতাকা হাতে আনন্দ মিছিলে মেতে উঠে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রায় সবাই।
‘‘আমি তখন কোলকাতায়। ১৬ ডিসেম্বর সকালের দিকে কিছু কাজে বাইরে গেছিলাম। ফিরলাম বেলা দশটার দিকে। ফিরে দেখি আমার জন্য কিছু লোক অপেক্ষা করছেন। তাদের কাছেই জানলাম পাকিস্তানি বাহিনী সেদিন বিকেলে যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। সেজন্য ঢাকার রেসকোর্সে একটি ছোট্ট অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান হবে। আর আমাকে সে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করতে হবে।’’
এই স্মৃতিচারণ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকারের।তবে বিজয়ের ৪৫ বছর পরও আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ওসমানীর না থাকার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আছে। আছে অনেক গুজব, গুঞ্জন। কেউ কেউ বলছেন এটা ভারতের ইশারায় হয়েছে। কারও কারও অভিযোগের আঙুল তখনকার মুজিবনগর সরকারের দিকে। সমালোচকরা পুরো ঘটনায় ওসমানীর প্রতি বিমাতা আচরণ দেখছেন। তাকে অবমূল্যায়ন করার বিষয়টি সামনে আনছেন। অথচ ইতিহাস বলে অন্য কথা। ওসমানীর না থাকার পেছনে কারও হাত ছিলো না। এটা নিছক একটা কাকতাল।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) একে খন্দকারের বিবরণ:
‘‘ভারতীয় সামরিক বাহিনীর লিয়াজোঁ অফিসার কর্নেল পি এস দাস অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর ব্যক্তিগত সচিব ফারুক আজিজ খানের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে অনুষ্ঠেয় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমপর্ণের খবর জানান। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীর খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারেন যে কর্নেল ওসমানী, ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত (ভারতীয় বাহিনী) এবং লেফট্যানেন্ট কর্নেল আব্দুর রব মুক্ত এলাকা পরিদর্শনে সিলেট গেছেন। কর্নেল ওসমানী ১৩ ডিসেম্বর সিলেটের মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনের পরিকল্পনা করেন। যাত্রার আগে তাঁকে আমি বলেছিলাম, স্যার আপনার এখন কোথাও যাওয়া ঠিক হবে না। দ্রুতগতিতে যুদ্ধ চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে।’ কর্নেল ওসমানী তার পরিকল্পনা পরিবর্তন না করে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান।’’গত ৪৫ বছর শুধু নয়, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে ওসমানীর না থাকার বিষয়টি ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকেই আলোচিত হয়। এ নিয়ে নানা গুজব ডালপালা মেলে। ১৮ ডিসেম্বর ওসমানী সিলেট থেকে সদর দপ্তরে ফিরে এসে এসব শুনতে পান। এতে তিনি ক্ষুব্ধ হন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তার না থাকার বিষয়টিতে যেমন অনুশোচনা ছিলো না। তিনি বরং গুজবকারীদের প্রতি বিরাগ ছিলেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে না থাকার বিষয়ে তখন কিছু যুক্তি তুলে ধরেন ওসমানী। শোনা যাক সেই বয়ান- “দেখুন আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে যাচ্ছি। কিন্তু দুঃখ হলো স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে কোনো চেতনা এখনও জন্ম হয়নি। আমাকে নিয়ে রিউমার ছড়ানোর সুযোগটা কোথায়? কোনো সুযোগ নেই। তার অনেক কারণ রয়েছে। নাম্বার ওয়ান- পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কবে আত্মসমর্পণ করবে আমি জানতাম না। আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব এসেছে।
নাম্বার টু- ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই সশস্ত্র যুদ্ধ ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের অধীনে হলেও যুদ্ধের অপারেটিং পার্টের পুরো কমান্ডে ছিলেন ভারতীয় সেনাপ্রধান লেফট্যানেন্ট জেনারেল স্যাম মানেকশ। সত্যি কথা হচ্ছে আমি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানও নই। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ নয়।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল মানেকশকে রিপ্রেজেন্ট করবেন লে. জে. অরোরা। জেনারেল মানেকশ গেলে তার সঙ্গে যাওয়ার প্রশ্ন উঠতো। সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আমার অবস্থান জেনারেল মানেকশর সমান। সেখানে তার অধীনস্থ আঞ্চলিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার সফরসঙ্গী আমি হতে পারি না। এটা দেমাগের কথা নয়। এটা প্রটোকলের ব্যাপার। আমি দুঃখিত, আমাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের বড় অভাব।
ঢাকায় ভারতীয় বাহিনী আমার কমান্ডে নয়। জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল অরোরার কমান্ডের অধীন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে যৌথ কমান্ডের ভারতীয় বাহিনীর কাছে। আমি সেখানে (ঢাকায়) যাবো কি জেনারেল অরোরার পাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখার জন্য? হাও ক্যান আই! আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করবেন জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আর পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী। এখানে আমার ভূমিকা কি? খামোখা আমাকে নিয়ে টানা হ্যাচড়া করা হচ্ছে।’’
এখানে দেখা যাচ্ছে, কেনো মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেনি তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন ওসমানী। তার মতে, যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক নীতিমালা আছে যার অন্য নাম জেনেভা কনভেনশন। নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নয় বলে সেই নীতিমালা মানতে মুক্তিবাহিনী বাধ্য ছিলো না। তাই বন্দী পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা করলে বা তাদের উপর অত্যাচার করলে বলার থাকতো না কিছু। পাকিস্তানিরা জেনেবুজেই সে ঝুঁকি নেয়নি। এছাড়া ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দীকে খাওয়ানো, পড়ানো আর তদারক করার মতো একক ক্ষমতাও তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ছিলো না। সব দিক বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান যেভাবে হয়েছে, তা নিয়ে কোনো আক্ষেপ ছিলো না মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মহম্মদ আতাউল গনী ওসমানীর। বরং সেই অনুষ্ঠান তার কাছে দারুণ গ্রহণযোগ্য ছিলো। এবার কী মতলববাজরা থামবেন?ঢাকাটাইমস/১৫ডিসেম্বর/টিএমএইচ

মন্তব্য করুন