বন্যহাতির ভয়ে নির্ঘুম রাত কাটছে সীমান্তের মানুষের

সুজন সেন, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১৪ আগস্ট ২০১৭, ১৬:৫৬

গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে শেরপুরের সীমান্ত এলাকায় বন্যহাতির আক্রমণে দুইজনের মৃত্যুর ঘটনায় সীমান্তজুড়ে চরম হাতি আতঙ্ক বিরাজ করছে। মানুষ নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। পাহাড়ি অঞ্চলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা না থাকার সুযোগে হাতির দল খাদ্যের সন্ধানে এখন প্রায় প্রতিরাতেই হানা দিচ্ছে বিভিন্ন গ্রামে। আর তাণ্ডব চালিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে বসতভিটা, খেয়ে নিচ্ছে গোলায় জমানো ধান, তছনছ করছে ফল বাগান আর পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট করছে রোপা-আমানের বীজতলা। বসতভিটা হারিয়ে অনেকেই বাস করছে খোলা আকাশের নিচে।

স্থানীয়রা জানায়, জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার ভারতের সীমানা সংলগ্ন প্রায় ৪২ কিলোমিটার এলাকার পাশের গ্রামগুলোতে এখন প্রায় প্রতিদিনই বন্যহাতির আক্রমণ ও তাণ্ডব চলছে। কোনোভাবেই বন্যহাতি ও মানুষের লড়াই থামছে না। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। বিনষ্ট হচ্ছে ক্ষেতের ফসল এবং লণ্ডভণ্ড হচ্ছে ঘরবাড়ি আর নষ্ট হচ্ছে গাছপালা। পাহাড়ি অঞ্চলে বিদ্যুৎব্যবস্থা না থাকার সুযোগে হাতির দল খাদ্যের সন্ধানে হানা দিচ্ছে বিভিন্ন গ্রামে। ৪০ থেকে ৫০টির বন্যহাতির দল একসাথে হামলে পড়ছে ওইসব উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। এলাকাবাসী একত্র হয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করলেই উল্টো তাণ্ডবলীলা চালাতে শুরু করে হাতির দল।

গত ১১ আগস্ট শ্রীবরদীর হালুহাটিতে হাতির দল আছড়ে ও পায়ে পিষ্ট করে হত্যা করে আব্দুল হাই নামে এক ষাটোর্ধ কৃষককে। এর আগে ২৯ জুলাই মধ্যরাতে ঝিনাইগাতীর ছোট গজনি গ্রামে হত্যা করে পলোদফ সাংমা নামে এক আদিবাসী যুবককে। এছাড়াও গত ২২ বছর ধরে কমবেশি শেরপুর সীমান্তে বন্যহাতির আক্রমণ চলছে। আর এ সময়ের মধ্যে কমপক্ষে ৬২ জন মানুষ বন্যহাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে আর হাজারো মানুষ আহত হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে বিস্ত্রীর্ণ জমির ফসল। আর হাতির আক্রমণের ভয়ে চাষাবাদের অভাবে পতিত পড়ে আছে হাজার হাজার একর জমি।

দীর্ঘদিন ধরে ওই তিন উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে বন্যহাতির তাণ্ডব অব্যাহত থাকলেও এ সমস্যার কার্যকর কোনো স্থায়ী সমাধান না হওয়ায় স্বজনহারা এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের অসন্তোষ দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।

শ্রীবরদীর একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সোবহান ঢাকাটাইমসকে বলেন, জেলার তিনটি উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে বিগত ১৯৯৫ সাল থেকে বন্যহাতির উপদ্রব শুরু হয়ে এখনো তা চলছেই। বন্যহাতির আক্রমণ দিন দিনই বাড়ছে। এই তিন উপজেলায় এখন সন্ধ্যা নামে বিভীষিকা হয়ে। বন্যহাতি ও মানুষের লড়াই চলছেই। সীমান্তে বসবাসকারী মানুষ মশাল জ্বালিয়ে, আবর্জনায় আগুন জ্বালিয়ে, পটকা ফাটিয়ে এবং সার্চ লাইট ব্যবহার করেও বন্যহাতির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে সীমান্ত অঞ্চলের লাখো মানুষ। বন্যহাতির তাণ্ডবে ক্ষেতের ফসল নষ্ট হচ্ছে। ভাঙছে ঘরবাড়ি, তছনছ হচ্ছে গাছপালা। মারা যাচ্ছে মানুষ।

ঝিনাইগাতীর কাংশা গ্রামের আব্দুর রৌউফ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কাংশা ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডেও মানুষ বন্যহাতির অত্যাচারে বসবাস করতে পারছে না। বন্যহাতির অত্যাচারে একটা লোকও বিবি বাচ্চা নিয়ে ঘরে শুইয়া থাকতে পারতাছে না। হাতি তাড়াতে সোলার ফ্যান্সিং (বৈদ্যুতিক বেড়া) এহানে করা হলেও সেটা আর কাজ করে না।’

শ্রীবরদীর হালুহাটি গ্রামের গৃহবধূ মাজেদা বেগম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘১১ আগস্ট শুক্রবার মধ্যরাইতে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে আমগর বাড়িত হাতি হামলা করে। আমার ঘরে রাখা আট মণ ধান খাইয়া সাবার করছে, ঘর ভাঙছে। এহন আমরা খোলা আকাশের নিচে বাস করতাছি। কেউ আমগরে খোঁজ লয় না।’

ওই গ্রামের আরেক গৃহবধূ আসমা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘হাতির দল ঘর ভাইঙ্গা আমার তিরিশ মণ ধান খাইয়া গেছে। আর বিছানাপত্তর আউলা ঝাউলা করছে। বিছানার নিচে একসাথে বান্ডিল কইরা রাখা ৭০ হাজার ট্যাহা শুঁড় দিয়া পেঁচাইয়া নিয়া গিইল্লা ফালাইছে। আমার সম্বল বলতে এহন আর কিছু নাই।’

দুধনই গ্রামের রিকশা চালক আক্কাস মিয়া বলেন, ‘সারা দিন আমরা কাজকাম কইরা বাড়িতে আসি। বাড়ি আসার পর সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গেই আমরা আতঙ্কা হইয়া যাইগা। হাতির জন্য আমগরে জীবনডা এহেবারে হাতের তলায় থাহে। হাতির ভয়ে অনেকেই এলাকা ছাইড়া অন্য জায়গায় চইল্লা গেছে।’

রানীশিমূল গ্রামের কৃষক ফটিক মিয়া বলেন, ‘আমগরে এই এলাকায় হাতি আইসা রোপা-আমন ধানের বীজতলা নষ্ট করতাছে এবং মানুষজন মারতাছে। বনের ক্ষতি করতাছে। এইডা (হাতি) প্রত্যাহার কইরা নেয়ার জন্য কোনো লোক নাই। আমরা সাহায্য পাই না। রাইতের পর রাইত মশাল ধরাইয়া হাতি ফিরানো হয়। কারোর চোখে ঘুম নাই।’

হালুহাটি গ্রামের কৃষানী ফুলজান বেওয়া বলেন, ‘পুনুরো কাঠা জুমিন আমগরে আর কোনো ক্ষেতখোলা নাই। সমুস্ত হাতিয়ে নষ্ট কইরা দিয়া গেছে। হাতি আমগরে মাইরবারি ধরছিল। ওই দিন রাইতে হাতি আক্রমণের পর না খাইয়া বুইরা মরুব্বি মানুষ নিয়া মরার নাহাল পইড়া আছি।’

পানবর গ্রামের কৃষানী সেজুতি মারমা বলেন, ‘হাতি আমার বাড়ি দুইবার ভাঙছে। আমার থাহার খুবই কষ্ট হইয়া গেছে গা। হাতির এলাকায় বসবাস করি আমি কোনো সহযোগিতা পাইলাম না।’

একই গ্রামের আদিবাসী কৃষক নিতন হাগিতক বলেন, ‘মানুষ ফসল কইরা খাইতে পাইতাছে না। খুব কষ্ট কইরা দিন কাটাইতাছে। সারা রাত ঘুম জাইগা থাকতাছে। বাড়িঘরে থাইকা শান্তি নাই। বাড়িঘরে আইয়া হাতি ভাঙচুর করতাছে মানুষ মারতাছে। আমরা খুউব কষ্টে দিন কাটাইতাছি। সরকার এর উদ্যোগ কোনো নিতাছে না।’

শ্রীবরদীর বালিজুড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘বনে এখন হাতির তীব্র খাদ্য সংকট চলছে। যে কারণে বন্যহাতি দল বেঁধে লোকালয়ে চলে আসছে। খাদ্য সংগ্রহ করতে হাতির দল মানুষের বাড়ি ঘরেও হামলা চালাচ্ছে। বাধা দিতে গেলে অনেকেই হাতির আক্রমণে আহত এবং নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। বন্যহাতির আক্রমণ থেকে বাঁচতে বন বিভাগ এর আগে ২৩টি হাতি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করলেও ওই প্রজেক্ট এখন বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে স্থানীয়রা স্বেচ্ছা শ্রমের মাধ্যমে রাত জেগে হাতির আক্রমণ ঠেকাতে গ্রাম পাহাড়া দিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘সাসস্টেনেবল ফরেস্ট লাইফ রিফোর্ট বা (সুফল) নামে একটি প্রকল্প পাশের জন্য ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সেটি পাস হলে আমরা বৃহৎ পরিসরে লোকাল কমিউনিটিকে নিয়ে হাতির আক্রমণ মোকাবেলায় কাজ করতে পারবো।’

এ সম্পর্কে শ্রীবরদীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খালেদা নাসরিন ঢাকাটাইমসকে জানান, শেরপুর সীমান্তের মোট ১১টি পয়েন্ট দিয়ে ভারত থেকে বন্যহাতি এ অঞ্চলে প্রবেশ করছে। তাই সীমান্তের করিডোরগুলো সব সময় খোলা রাখতে ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং-এ অনুষ্ঠিত এক সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এছাড়া বন্যহাতির হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের সবধরনের সরকারি সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

(ঢাকাটাইমস/১৪আগস্ট/প্রতিনিধি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :