পায়ে ধরেছি, কেঁদেছি, অন্তর গলে নাই: তিতাসের মা

সাগর হোসেন তামিম, মাদারীপুর থেকে
| আপডেট : ২৯ জুলাই ২০১৯, ১৯:০৫ | প্রকাশিত : ২৯ জুলাই ২০১৯, ১৮:৩২
তিতাস ঘোষ

যুগ্ম সচিবের জন্য আটকে থাকা ফেরি ছাড়তে পায়ে পর্যন্ত ধরেছিলেন প্রাণ হারানো স্কুল ছাত্র তিতাস ঘোষের স্বজনরা। দেরি হলে ছেলেটি মারা যেতে পারে, এই আশঙ্কার কথা বারবার বলেছিলেন তারা। কিন্তু তাদের কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। তবে ছেলেটি মারা যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট সবাই এখন নানা যুক্তি দেখিয়ে নিজেকে বাঁচাতে চাইছেন।

গত বৃহস্পতিবার রাতে মাদারীপুরের শিমুলিয়া ফেরি ঘাটে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনা জানার পর সারাদেশে সমালোচনার ঝড় বইছে। স্বজনরা বলছেন, তিতাসকে বহনকারী অ্যাম্বুল্যান্স ছাড়তে ভেজা চোখে অনেক কাকুতি মিনতি করেছেন। পায়ে পড়েছেন! তবুও মন গলেনি ঘাটের দায়িত্বরতদের। তারা যুগ্ম সচিব আব্দুস সবুর মণ্ডলের গাড়ির অপেক্ষায় ছিলেন। তার জন্য প্রায় তিন ঘণ্টা ফেরি থামিয়ে রাখেন। এমন কি প্রতিকার মেলেনি জরুরি নম্বর ৯৯৯-এ কল করেও।

নড়াইল কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন। প্রথমে খুলনার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার তাকে আইসিইউ সম্বলিত অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হচ্ছিল।

রাত আটটার দিক মাদারীপুরের কাঠালবাড়ী ১নং ফেরি ঘাটে পৌঁছে অ্যাম্বুলেন্সটি। রাত ৯ টার দিক কুমিল্লা নামের ফেরিটি শিমুলিয়া থেকে কাঠালবাড়ি ঘাটে এসে গাড়ি আনলোড করছিল। এ সময় ওই রোগীর লোকজন ঘাটে কর্মরতদের তাদের রোগীর অবস্থা বললেও যুগ্ম সচিব আবদুস সবুর মণ্ডলের গাড়ি না আসা পর্যন্ত ফেরি ছাড়তে রাজি হয়নি।

তিতাস ঘোষের বড় বোন তন্নীসা ঘোষ জানান, উন্নত চিকিৎসার জন্য বৃহস্পতিবার রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে পাঠানোর কথা বলেন চিকিৎসক। তাই চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রেখে দ্রুত ঢাকায় পৌঁছতে ৫০ হাজার টাকায় ভাড়া করা হয় আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স। অ্যাম্বুলেন্সটি ঘাটে এসে থামে রাত ৮টার দিকে। ঘাটে ফেরি পারাপারের জন্য তাঁরা ঘাট কর্তৃপক্ষ ও দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কাছে সাহায্য চান। কিন্তু কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি।

তিন ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকার পরে রাত পৌনে ১১ টার দিকে ছাড়া হয় ফেরি। কিন্তু মাঝ নদীতেই থেমে যায় তিতাসের জীবনের যাত্রা। পরে শিমুলিয়া ঘাট থেকে আবারও ফেরিতে করে কাঁঠালবাড়ি ঘাট তারা তিতাসের মরদেহ নিয়ে নড়াইলে ফিরে যান।

কান্না জড়িত কণ্ঠে তন্নীসা বলেন, ‘আমার ভাইয়ের জীবন কেড়ে নিল ভিআইপি ওই ব্যক্তি। এ দেশে জীবনের দাম বেশি না, ভিআইপিদের দাম বেশি? সরকারের উচিত এই ভিআইপিকে আইনের আওতায় আনা। আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই।’

তিতাসের মা সোনামণি ঘোষের কান্নাও থামছে না। তিনি বলছিলেন, ‘তোমাগো কাছে বললে কি আমার পোলারে পামু? ওরা আমার পোলারে মেরে ফেলছে। আমি ফেরিওয়ালাগো পায় ধরছি, তবুও ওরা ফেরি ছাড়ে নাই। ফেরি ঠিক মতোন গেলে হয়তো পোলাডা বাঁইচা যাইত। আমাগো কান্না ওদের অন্তর গলে নাই।’

তিতাসের মামা বিজয় ঘোষ বলেন, ‘ফেরির লোকদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে ভিআইপি আসবে। আমাদের রোগী যে মরে যাচ্ছে, সেদিকে তাদের কোনো নজর নেই। কোনো সহযোগিতা না পেয়ে দিলাম ৯৯৯ কল। কিন্তু সেখানেও কোনো কাজ হলো না।’

গাফিলতির অভিযোগ অস্বীকার করে ঘাটে কর্তব্যরত বিআইডব্লিউটিসি কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যদের দাবি, তাদের কাছে রোগীর স্বজনরা রোগীর অবস্থা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে সকল ধরনের সহযোগিতা করা হয়। এ বিষয় বিআইডব্লিউটিএ-এর চেয়ারম্যান খোঁজ নিয়েছেন বলে কাঁঠালবাড়ি ঘাট ম্যানেজার আব্দুস সালাম দাবি করেন।

এ ঘটনায় মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। যাদের আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে হবে।

তবে বিআইডব্লিউটিসি কর্মকর্তাদের দাবি, তারা রোগীর কথা জানতে পেরেছেন পরে। আর এর ১০ মিনিটের মধ্যেই ফেরিটি যাত্রা শুরু করে। অতিরিক্ত সচিবের জন্য খুব বেশি দেরি করেনি ফেরিটি।

কুমিল্লা ফেরির মাস্টার ইনচার্জ মো. সামসুল আলম বলেন, ফেরিটি কাঁঠালবাড়ি ঘাটে আসার পর ভিআইপি যাত্রীর জন্য আমাকে খুব বেশি হলে আধঘণ্টার মতো অপেক্ষা করতে হয়েছিল। রাত আনুমানিক ১০ টার দিকে ফেরি ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই অ্যাম্বুলেন্সে থাকা রোগীর মৃত্যু হয় বলে জানতে পারি।

কাঁঠালবাড়ি ঘাটে সেই সময় কর্তব্যরত বিআইডব্লিউটিসির টিএস ফিরোজ আলম বলেন, ‘আমাকে সাংবাদিক ও রোগীর স্বজন পরিচয় দিয়ে একজন ফোন করে। এতে আমি পাশের ঘাট থেকে দ্রুত এসে অ্যাম্বুলেন্সটি ফেরিতে তুলে দেই। প্রায় ১০ মিনিটের মধ্যে ফেরিটিও ঘাট থেকে ছেড়ে যায়।

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শহীদুল হক পাটোয়ারীকে প্রধান করে শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান, এএসপি সার্কেল (শিবচর) আবির হোসেন, এজিএম (মেরিন) বিআইডব্লিউটিসি শিমুলিয়া ঘাট একেএম শাজাহানকে সদস্য করা হয়েছে।

ঢাকাটাইমস/২৯জুলাই/ইএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :