ছাত্রলীগের বেশিরভাগ সভাপতি-সম্পাদক আ.লীগে নেই!

সোহেল সানি
  প্রকাশিত : ৩০ অক্টোবর ২০১৯, ১০:১৭| আপডেট : ৩০ অক্টোবর ২০১৯, ১০:৫৪
অ- অ+

আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৯০ পর্যন্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের বেশিরভাগই বর্তমান আওয়ামী লীগে নেই। তাদের অনেকে নিজে দল গড়েছেন, কেউ অন্য দলে যোগ দিয়েছেন আবার কেউ কেউ বিএনপি-জাতীয় পার্টির মন্ত্রী হয়েছিলেন।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সবচেয়ে প্রাচীন এ ছাত্র সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ছাত্রলীগ বাংলাদেশের বিভিন্ন অধিকার সংক্রান্ত আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্র আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন- এককথায় দেশের ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা অনবদ্য।

৭১ বছরের এই পথচলায় অসংখ্য নেতা-কর্মী ছাত্রলীগে যোগ দিলেও দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় শুরুর দিকে যারা সংগঠনটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেইসব সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনেকে পরে আর রাজনীতিতে থাকেননি কিংবা আওয়ামী লীগের ঠাঁই হয়নি।

বঙ্গবন্ধুর সময়কার মন্ত্রী হওয়া ওবায়দুর রহমান পরবর্তী সময় বিএনপির মহাসচিব হয়েছিলেন। শাহ মোয়াজ্জেম জাতীয় পার্টির মন্ত্রী হওয়ার পর পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দেন। আ সম আব্দুর রব জাসদ গঠন করেন। শেখ শহীদুল ইসলাম জাতীয় পার্টির মন্ত্রী হয়েছেন।

ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা কে কোথায়

৫৫ সালে ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি দবিরুল ইসলামকে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। দ্বিতীয় সভাপতি কুষ্টিয়ার কামরুজ্জামান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি আমরণ আওয়ামী লীগ করেছেন।

‘৫৪’ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে সভাপতি হন আব্দুল মমিন তালুকদার। সাধারণ সম্পাদক পদে দ্বিতীয় মেয়াদেও নির্বাচিত হন এম এ ওয়াদুদ। এম এ ওয়াদুদ (শিক্ষা মন্ত্রী ডা. দীপুমনির পিতা) আওয়ামী লীগে সক্রিয়ভাবে কাজ না করলেও ইত্তেফাকের কর্মাধ্যক্ষ হিসাবে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন।

বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিমন্ত্রী মরহুম আব্দুল মমিন তালুকদার ছাত্রলীগের দুই মেয়াদে সভাপতি ছিলেন। তার দ্বিতীয় মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এম এ আউয়াল। দুর্নীতির অভিযোগে আদমজী জুট মিলের ব্যবস্থাপকের পদ থেকে বরখাস্ত করেন। পরে তিনি জাসদে যোগ দেন এবং ৭৩ এর নির্বাচনে ঢাকার একটি আসনে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে জামানত হারান।

৫৭ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে সভাপতি হন রফিকউল্লাহ চৌধুরী। সিএসপি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে আমলাজীবন বেছে নেন। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁকে মুখ্যসচিব পদে নিয়োগ দেন, কিন্তু তিনি জ্যেষ্ঠতা ক্ষুণ্ন হবে মত দিয়ে কেবল সচিব হিসেবে নিয়োগ নেন। রফিকউল্লাহ চৌধুরী (স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর পিতা) বঙ্গবন্ধু হত্যার পর চাকরি হারান তিনি।

৬০ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে শাহ মোয়াজ্জেম সভাপতি এবং শেখ ফজলুল হক মনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

শাহ ৭০ সালে জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ৭৩ সালের নির্বাচনের পর চিফ হুইপ নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী এবং তার সঙ্গে মিলে ডেমোক্রেটিক লীগ গঠন করেন। পরবর্তীতে জেনারেল এরশাদের দলে যোগ দিয়ে উপপ্রধান মন্ত্রী হন। জাতীয় পার্টির মহাসচিব হওয়া শাহ মোয়াজ্জেম এরশাদকে ত্যাগ করে পাল্টা জাতীয় পার্টি গঠন করেন এবং সর্বশেষ বিএনপিতে যোগ দেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী। স্বাধীনতার পর নানা মান অভিমান নিয়ে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। পরে রাজনীতির মূল স্রোতের বাইরে গিয়ে প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন।

নূরে আলম সিদ্দিকীর সময়ে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শাজাহান সিরাজ। দেশ স্বাধীন হওয়ার ছয় মাসের মাথায় ছাত্রলীগে ভাঙন দেখা দেয়। ‘মুজিববাদী’ হিসেবে পরচিতি অংশ নিয়ে থেকে যান নূরে আলম সিদ্দিকী। আর শাজাহান সিরাজের অংশটি ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী’পন্থী হিসেবে পরিচিত হয়। এই অংশটি পরবর্তী সময়ে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ নামে আত্মপ্রকাশ করে।

শাজাহান সিরাজ জাসদের টিকিটে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর যোগ দেন বিএনপিতে। অষ্টম সংসদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

শাজাহান সিরাজ বহিষ্কার হওয়ার পর ইসমাত কাদির গামা সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। তিনিও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অবস্থান করে নিতে পারেননি।

আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনি ৭৫ এর ১৫ আগস্ট অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীসহ নিহত হন।

৬৩ সালের সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হওয়া কে এম ওবায়দুর রহমান বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী হন। জেনারেল জিয়ার আমলে মন্ত্রী এবং পরে খালেদা জিয়ার আমলে বিএনপির মহাসচিব পদ থেকে বহিষ্কৃত হন। জনতা দল নামে দল গঠন করলেও ৯৬ সালে বিএনপিতে আবার বিলীন হন।

স্বাধীনতার অন্যতম নিউক্লিয়াস খ্যাত ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা। ৭২ সালে তার অনুপ্রেরণায় আসম আব্দুর রব ও শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের একাংশ পাল্টা ছাত্রলীগ গঠন করে। যারা জাসদ ছাত্রলীগ হিসাবে পরিচয় লাভ করে। অপরদিকে নূরে আলম সিদ্দিকী ও আব্দুল কুদ্দুস সমর্থিত ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে যায়।

৬৬ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হন ফেরদৌস আহমেদ কোরেশি এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক। ডাকসু ভিপি ফেরদৌস আহমেদ কোরেশি আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে দূরে সরে পড়েন স্বাধীনতার আগেই। জিয়ার শাসনামলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হলেও লাইমলাইটে আসতে পারেননি। ওয়ান ইলেভেনে একটি দল গঠনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।

মুজিব বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক আব্দুর রাজ্জাক স্বাধীনতাত্তোর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। রাজ্জাক বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কারাগারে থেকেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আব্দুল মালেক উকিল সভাপতি হলেও রাজ্জাকই ছিলেন সর্বেসর্বা।

৮১ সালে শেখ হাসিনা সভাপতি এবং আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৮৩ সালে তিনি বাকশাল পুনরুজ্জীবিত করলেও ৯২ সালে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ৬৭ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনেও আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। যখন সভাপতি মাজহারুল হক বাকী। মাজহারুল হক বাকী রাজনীতিতে খুব একটা সক্রিয় ছিলেন না।

৬৮ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হন আব্দুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী। আব্দুর রউফ বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে সংসদের হুইপ ছিলেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই পেলেও ডাকসাইটে নেতা হয়ে উঠতে পারেননি। ৭০ এর নির্বাচনে বিজয়ী খালেদ মোহাম্মদ আলী ৭৩-এ এমপি হন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনিও ডাকসাইটে নেতারূপে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি।

৬৯ এর শেষ দিকে ছাত্রলীগের সভাপতি হন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ। তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক আসম আব্দুর রব। আসম আব্দুর রব সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর ডাকসু ভিপি হন। স্বাধীনতাত্তোর তিনি সিরাজুল আলম খানের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নেন এবং ছাত্রলীগের পাল্টা নেতৃত্ব সৃষ্টি করেন। তিনি জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক।

৮৮ সালে এরশাদের ভোটারবিহীন নির্বাচনে গিয়ে বিরোধী দলের নেতা হন। ৯৬ সালে শেখ হাসিনার ঐকমত্যের সরকারের মন্ত্রী হন। বর্তমানে ড. কামাল হোসেনের ঐক্যফ্রন্টে রয়েছেন।

৭২ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হন শেখ শহীদুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক হন এম এ রশীদ। শেখ শহীদ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান। পরে জেনারেল এরশাদের মন্ত্রী হন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জেপির তিনি মহাসচিব। এম এ রশীদ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অবস্থান পাননি।

৭৪ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে সভাপতি হন মনিরুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শফিউল আলম প্রধান। মনিরুল হক চৌধুরী এরশাদের জাতীয় পার্টির চিফ হুইপ ছিলেন। বর্তমানে বিএনপি নেতা। মরহুম শফিউল আলম প্রধান ৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত সেভেন মার্ডারের দায়ে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হন এবং ১৪ বছর সাজা লাভ করেন। জেনারেল জিয়ার আমলে মুক্তি পেয়ে জাগপা গঠন করেন। মৃত্যু পর্যন্ত এ দলেই ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাত্তোর ছাত্রলীগের সম্মেলনে কারাগারে থেকে সভাপতি হন আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক হওয়া বাহালুল মজনু চুন্নু আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কোনো অবস্থানে নেই। ৮২ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হন ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক আখম জাহাঙ্গীর হোসাইন। এই দুই নেতা সাবেক এমপি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তারা দীর্ঘদিন থাকলেও বর্তমানে নেই।

ঢাকাটাইমস/৩০অক্টোবর/এমআর

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
মানিকগঞ্জের সাবেক এমপি মমতাজ গ্রেপ্তার
কুষ্টিয়া-মেহেরপুর আঞ্চলিক মহাসড়কে অনিয়মের প্রমাণ পেল দুদক
কোতয়ালী এলাকায় বিশেষ অভিযান, মাদক কারবারিসহ গ্রেপ্তার ১৫
ফরিদপুরে মাদক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা