ব্যাকরণ মায়ের ভোগে যাক - রোদ্দূর রায়

ঢাকাটাইমস ডেস্ক
 | প্রকাশিত : ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৯:৩৩

আগামী ২৭ ডিসেম্বর, শুক্রবার রোদ্দূর রায়ের প্রথম বাংলা উপন্যাস প্রকাশিত হচ্ছে। নাম – “মোক্সা রেনেসাঁ”। সপ্তর্ষি প্রকাশনের কর্ণধার সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের কথায় একে উপন্যাস না বলে আখ্যান বলাই ভাল। রোদ্দূর রায় নিজের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলের সৌজন্যে যথেষ্ট পরিচিত নাম। বিতর্কিতও। কেন এ হেন লেখকের বই বেছে নিলেন প্রকাশক, সে প্রশ্নের উত্তরে সৌরভ জানালেন, “সপ্তর্ষির একটা বড় সময় জুড়ে ছিলেন নবারুণ ভট্টাচার্য। রোদ্দূরের স্ক্রিপ্ট সেই ধাঁচাটাকেই মনে করিয়ে দেয়।”

রোদ্দূরের এই উপন্যাস বা আখ্যান বাংলা সাহিত্যে একটা বড় সংযোজন বলে মনে করছেন সৌরভ। তার বিশ্বাস, রোদ্দূর রায়ের ক্ষমতার ২ শতাংশ মাত্র উন্মোচিত, ৯৮ শতাংশ উন্মোচন বাকি রয়ে গিয়েছে।

রোদ্দূর নিজে কী মনে করেছেন, লেখা নিয়ে, জীবন নিয়ে, তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্ক নিয়ে, সে সবের খোঁজ পাবার চেষ্টা করল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা।

রোদ্দুর রায়ের সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ।

আপনার আসল নাম তো অন্য। এই রোদ্দূর রায় নামকরণের সার্থকতা কী?

(নীরবতা)

যিনি নামকরণ করেছেন তিনি তো একটা আবেগ থেকে করেন। কিছু একটা ভেবেছিলেন।

এটা তো পাঁচ নম্বরের প্রশ্ন। এত ছোট উত্তর দিলে চলবে কী করে?

নামকরণের সার্থকতা বিচারের সময় আসেনি আসলে। নাম আসলে যে লোক দিচ্ছে, আর যে আমি সে নামে পরিচিত, সে দুজন এক মানুষ নাই হতে পারে। এ নাম যে আমারই আমাকে দেওয়া, তেমন কোনও ডকুমেন্ট তো আসলে নেই। সার্থকতা তো ইতিহাস বিচার করে। ভবিষ্যতের ইতিহাস। নামকরণটা সার্থক নাকি অসার্থক, সেটা আমি ঠিক জানি না।

কিন্তু রোদ্দুর রায়, এ নামটা স্থির করবার পিছনে তো একটা ভাবনা ছিল। সেটা ঠিক কী!

না, তেমন কোনও ভাবনা ছিল না।

একেবারেই হঠাৎ?

হ্যাঁ, তাই বলতে পারেন।

আপনি কি নার্সিসিস্ট?

(নীরবতা, তারপর সামান্য হাসি)

আমার সাইকোলজিস্ট বলতে পারবেন আমি নার্সিসিস্ট কিনা। আমরা প্রতিদিন যাদের দেখি, তারা ঠিক কোন মানসিক রোগে আক্রান্ত, তা বিচার করার জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে নেই। ধরেই নিচ্ছি নার্সিসিজম একটা মানসিক রোগ, বা একটা সোশাল সিম্পটম। আমার সাইকোলজিতে পড়াশোনা নেই, অন্তত কাউকে নার্সিসিস্ট বলে ঘোষণা করার মত পড়াশুনো নেই।

বাংলা সাহিত্য জগতে কাউকে আপনি নার্সিসিস্ট বলে চিনতে পারেন?

বললাম যে আমার সেই পরিমাণ সাইকোলজির প্রপার পড়াশোনা নেই, যার ভিত্তিতে আমি কাউকে নার্সিসিস্ট বলতে পারি।

প্রপারলি জানা বলতে কী বোঝায়?

ব্যাকরণ জেনে গান গাওয়া, ব্যাকরণ জেনে লিখতে বসা, ব্যাকরণ জেনে ছবি আঁকা, এগুলোই তো প্রপারলি জানা। সেই প্রসঙ্গে বলছি আর কী!

ব্যাকরণ মায়ের ভোগে যাক। ব্যাকরণ একটা ইনস্টিটিউশন। যে প্রতিষ্ঠান ক্রীতদাস বানানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান সবসময়ে চেয়েছে কিছু মানুষকে ক্রীতদাস বানাতে। আমি এই প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করি। এই অর্থে নয় যে প্রতিষ্ঠানে বোম মারো, এই অর্থে যে মানবতাকে মুক্ত করতে দাও। মানবতা যদি মুক্ত হয়, তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক যে দৃষ্টিভঙ্গি একটা মানুষকে একটা নির্দিষ্ট তকমায় বেধে দেওয়ার বা একটা নির্দিষ্ট ডেজিগনেশনে বেধে দেওয়ার চেষ্টা। এ গান জানে, এ জানে না, এ ছবি আকতে জানে বা জানে না, সে কথা কে বলে দিতে পারে?

তাহলে প্রপারনেস কী দিয়ে ঠিক হবে?

এর সঙ্গে আপনার ওই নার্সিসিজমের তফাৎ রয়েছে। নার্সিসিজম সাইকোলজি দ্বারা ডিফাইন্ড। সংগীত যখন আমি বলছি, তখন তা কী দিয়ে ডিফাইন্ড? একটা ইমোশনাল এক্সপ্রেশন, লজিক্যাল এক্সপ্রেশন অফ সোল। আমি যখন বলছি একজন সংগীত করছেন, এক একটা সমাজে সংগীতের অর্থ এক এক রকম। কণ্ঠসংগীতও সংগীত, ইন্স্ট্রুমেন্টের যে এক্সপ্রেশন সেটাও সংগীত, আদিবাসী গানও সংগীত, উচ্চাঙ্গ সংগীতও সংগীত। সংগীতের রেঞ্জ অনেক বড়। নার্সিসিজমের রেঞ্জ ওরকম নয়। অত বড় নয়।

এই যে আপনি বললেন লজিক্যাল এক্সপ্রেশন অফ সোল, তখন আপনি লজিককে মায়ের ভোগে পাঠাচ্ছেন না কেন?

আই ডিফাই লজিক। লজিক ব্রেনের একটা পার্ট। লেফট ব্রেন থেকে লজিক নিঃসৃত হয়। এবারে সোশাল লজিক, ইন্ডিভিজুয়াল লজিক, এক একটা সময়ের এক একটা টাইম স্পেসের লজিক, এক একটা সময়ের সমাজে দাঁড়িয়ে এক একটা লজিক। যে লজিকটা একটা ইয়েস-নোর লজিক, এটা ঠিক নাকি ঠিক নয়, এটা গুড নাকি ব্যাড, সেখানে লজিক শুড বি প্রোমোটেড ইন আ ওয়ে বেনিফিশিয়ারি টু দ্য মাস। আমার কাছে যদি একটা লজিক থাকে, যেটা মাসকে বেনিফিট করে না, কিন্তু সেটা আমার পার্সোনাল লজিক- সে লজিকটা আমি সকলের জন্য ব্যবহার করতে পারি না।

আপনি যে এই দ্বিত্ব (বাইনারি)-র কথা বললেন, গুড-ব্যাড বা ইয়েস-নো, আপনি এই দ্বিত্বের লজিকের বিরোধিতা করেন?

আমি বিশ্বাস করি, শিল্পে এই ভালো আর মন্দের মাঝামাঝি কিছু জায়গা থাকবে। কিছু ফাজি লজিক থাকবে। শিল্প সাহিত্যে আমি যখন একটা এক্সপ্রেশন নিয়ে আসছি, তখন কোনও সংজ্ঞায় আটকে থাকাটাকে আমি মানি না।

কিন্তু কোনও সংজ্ঞা থাকা উচিত বলে মনে করেন কি?

সংজ্ঞা থাকা উচিত এক্সপ্রেশনের। কোনও একটা ফ্রেম না থাকলে এক্সপ্রেস করা যায় না। যেখানে আমি মানবাধিকারে বিশ্বাস করছি, নাগরিকের এক্সপ্রেশনে বিশ্বাস করছি, সেখানে ইন্সটিটিউশন কোনো সংজ্ঞা দ্বারা নির্দেশিত হবে না, এমনটা আমি বিশ্বাস করি।

আপনি যে মোক্সা শব্দটা ব্যবহার করেন, এটার উৎস কী? এটা কি মোক্ষ থেকে এসেছে?

হ্যাঁ, মোক্ষ মানে আত্মার মুক্তি। আধ্যাত্মিক অর্থে আত্মা নয়, এখানে মানবিক আত্মার কথা বলা হয়েছে। মানে এটা অতটা গোপনে অনুশীলন করা আধ্যাত্মিকতা থেকে নির্গত আত্মা থেকে চলে আসছে ইমপ্লিমেন্টেবেল স্পিরিচুয়ালিটির জায়গায়। সে অর্থে মোক্সা হল স্বাধীনতা। আমি বলি, স্বাধীনতা, প্রেম ও শান্তি। নাগরিক মানুষের জন্য স্বাধীনতা, প্রেম ও শান্তি।

আপনার যে চর্চা, তার অন্যতম মাধ্যম তো বাংলা। আপনার মাতৃভাষাও বাংলা। তাহলে মোক্সা শব্দটা ব্যবহার করছেন কেন মোক্ষ না বলে? মোক্সা বললে কীরকম রজনীশ ওশোর কথা মনে হয় না? আপনি কি একটা বড় টার্গেটকে ধরার উদ্দেশ্যে এরকম একটা শব্দ ব্যবহার করছেন?

আমার মনে হয় না মোক্সা একটা বাংলা শব্দ নয়। যে কোনও ভাষাতেই নতুন শব্দ আসতে পারে। মোক্ষা শব্দটার সঙ্গে আমরা পরিচিত বলে মোক্সা শব্দটা আসবে না তা নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মোক্ষ, মোক্সায় রূপান্তরিত হতেই পারে। মোক্ষ বলতে আমরা যা বুঝি, মোক্সায় তার সঙ্গে যুক্ত হবে ইমপ্লিমেন্টেড স্পিরিচুয়ালিটি বা ইমপ্লিমেন্টেড আর্ট। এই সমস্ত কিছু মিলিয়েই মোক্সা। এটা টিপিক্যাল মোক্ষ নয়। আর ওশো রজনীশ তো রজনীশ। (হাসি)

আপনি কি অ্যানার্কিস্ট?

হতে পারে। (অট্টহাস্য) আমি এখনও খুব ভেবে দেখিনি যে একজ্যাক্টলি নিজেকে আমি অ্যানার্কিস্ট বলতে পারব কিনা। অ্যানার্কির অনেকগুলো সেন্স আছে বলে আমার মনে হয়। সেখানে একটা সেন্সে, হয়ত তাই। আমি প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছি বলে আমার মনে হয়নি। আমি মানবাধিকারকে এসট্যাবলিশ করার চেষ্টা করছি, যা আমাদের সমাজে নেই। সারা পৃথিবীতেই মানবাধিকারের যাকে বলে গাঁ.. মারা গিয়াছে। তো আমি সে ব্যাপারে কাজ করছি। আমি আরও বেশি মানবাধিকার কী ভাবে পাওয়া যায় তার চেষ্টা করছি। রাজতন্ত্রতে মানবাধিকার ছিল না, গণতন্ত্রতেও আসেনি, আমরা যদি এবার নতুন একটা মডেলের খোঁজ করি, একজন একা মানুষ মডেল তৈরি করছেন এটা তো হয় না। কিন্তু নিজেকে এক্সপ্রেস করছেন প্রত্যেক মানুষ হতে পারে। আমি নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করছি। এবার সেটা অ্যানার্কিজম, না নিহিলিজম না অন্য কিছু, সেটা সময় বলবে। আমি এখনও কোনও তকমা আমার ওপর লাগানোর চেষ্টা করছি না তার কারণ আমি সেটা তত জরুরি বলে মনে করছি না। আমি একজন নাগরিক, আমি কিছু কাণ্ড করছি, যেটা আমার করতে ইচ্ছে করছে। আমার বিশ্বাস এই স্বাধীনতাটুকু আমার প্রাপ্য, যেখানে আমি আমার ইচ্ছানুসারে যা করতে ইচ্ছে করছে, তাই করতে পারি। সকলেরই এই স্বাধীনতা প্রাপ্য।

কিন্তু আপনার তো একটা রাজনীতি বা দর্শনও আছে, যা এতক্ষণের কথা থেকে স্পষ্ট।

রাজনৈতিক ভাবে আমরা সচেতন থাকি, প্রতিটি মানুষই দার্শনিক।

এই যে আপনার অসহনীয় একটা ব্যাপার, ডিস্টার্বিং, কিছুটা পরিমাণে বিকৃতভাবে নিজেকে পেশ করা- এই স্পেকট্যাকলটা যে আপনি তৈরি করেন, এটার রাজনীতিটা কী?

আমি তো আমার মত হয়েছি, সেটা যদি আপনার অদ্ভুত লাগে সেটায় তো…

না এটা আমার কথা নয়, আপনার একটা অডিয়েন্স রয়েছে…

(কথা শেষ করতে না দিয়ে) আমি এই অডিয়েন্সের ব্যাপারে অ্যাওয়ার নই। (অট্টহাসি)

তাহলে আপনার টার্গেট অডিয়েন্স কারা?

আমার সে ভাবে কোনও টার্গেট অডিয়েন্স নেই। আমি যেভাবে কাজগুলো করছি তাতে অডিয়েন্স নেই ভেবে আমি করে যাচ্ছি। আমি ২০১২ থেকে ইউটিউবে চ্যানেল করছি, সেখানে ২০১৪ তে আমি দেখলাম লোকে রিঅ্যাক্ট করছেন, এখনও রিঅ্যাক্ট করছেন… আমি আমার মত কাজগুলো করছি। আমি ইউটিউব চ্যানেলের বাণী দেখেছি, সেটা হচ্ছে ব্রডকাস্ট ইওরসেল্ফ। তো আমি ছোটবেলা থেকে নিজেকে ব্রডকাস্ট করার চেষ্টা করেছি, আমি কোনও মাধ্যম পাইনি, আমি দেখেছি আকাশবাণী থেকে ব্রডকাস্ট হচ্ছে, দূরদর্শন থেকে ব্রডকাস্ট হচ্ছে, কেউ আমাকে বলেনি যে ব্রডকাস্ট ইওরসেলফ। আমি চেয়েছি নিজেকে ব্রডকাস্ট করতে, লিটল ম্যাগ ট্যাগ হচ্ছে কলকাতায় দেখেছি, সেখানে দেখেছি তারা নানারকম কিছু করছে- তোমার কবিতা আমি ছাপব, তাহলে আমার কবিতা তুমি ছাপবে, তার পর টেলিফিল্ম করতে গেছি, সেখানে দেখেছি আমার স্ক্রিপ্ট নিয়ে অন্যলোকে কাজ করছে, বাড়িতে বলছে, তোর স্ক্রিপ্ট গেঁড়িয়ে দিয়েছে যখন তাহলে স্ক্রিপ্টটা ভাল ছিল। (অট্টহাসি)

এরকম একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে আমি বড় হয়ে উঠছিলাম এবং নিজেকে একদম ব্রডকাস্ট করতে পারছিলাম না। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার ভয়ানক বাসনা ছিল। তারপর হঠাৎ দেখলাম ইউটিউব বলছে ব্রডকাস্ট ইওরসেলফ। আমি ভাবলাম ওয়াও ম্যান, দে আর সেয়িং ইট… (অট্টহাসি)। তো আমি ব্রডকাস্ট করতে শুরু করলাম, এখনও করে যাচ্ছি। এবার জনগণ যা করছেন প্রতিক্রিয়ায়, সেটা আমার কাছে কিছুটা ফান, কিছুটা শেখার বিষয়, কিছুটা অবজার্ভ করার বিষয়- সেটা সোসাইটি কী সেই বিষয়ে।

সোসাইটিকে তো আমি দেখার মত সময়ও পাচ্ছি না, আমি সাংবাদিকতা করি না, আমি সোশাল সায়েন্স করি না, আমি কিছু গবেষণা করেছি কনশাসনেস সায়েন্স নিয়ে, আমি কিছু নিজের লেখালিখি করেছি, অবসর সময়ে বসে গঞ্জিকা সেবন করে বা না করে ডিগবাজি খেয়ে, ঘরে একা থেকে।

আমি একটা উদ্ভট জায়গায় থেকেছি যার নাম দিল্লি, সেখানে চারদিকে হিন্দি ভাষা চলছে, আমার মাতৃভাষা সেখানে নেই, আমি অ্যালুফ হয়ে গেছি, আমি রবীন্দ্রসংগীত সেখানে গাইতে পারিনি, শেয়ার করতে পারিনি, যেভাবে রবীন্দ্র সংগীত নাকে নাকে লোকে গেয়েছে, সিআর পার্কে গিয়ে দেখেছি গান হচ্ছে, সেখানে ‘আকাশে উড়িছে বকপাঁতি“, “বেদনা আমাড় তাড়ই সাথী”, এরকম উচ্চারণে রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছে, সবাই গোল করে ঘিরে দেখছেন দইবড়া ফুচকা খেতে খেতে- এরকম ধরনের বাংলা সংস্কৃতি আমি দেখেছি।

মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে- এরকম সব উচ্চারণে রবীন্দ্রসংগীত চলছে। তার পরে সকলে বেলফুলের মালা মাথায় লাগিয়ে, গাঢ় লিপস্টিক লাগিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছেন, এসব দেখে আমি বুঝেছি যে এটা ঠিক আমার ব্রডকাস্টিং স্টাইল না। আবার এরা আমার ব্রডকাস্টিং স্টাইল ঠিক নিতেও পারবে না, উৎসাহও দেবে না। আমার নিজস্ব এক্সপেরিমেন্ট নিজের মত করে আমি করেছি। অবাঙালি এলাকায় থেকেছি, যাতে প্রতিবেশীরা মারতে না আসে।

এই গোটাটাই কি আপনার এক্সপ্রেশন কেবল? কোনও কমিউনিকেশনের ব্যাপার নেই?

যে কোনও এক্সপ্রেশন আর কমিউনিকেশন রিলেটেড। আমি টার্গেট অডিয়েন্স ভেবে কমিউনিকেট করি না। সেটুকু আমি আপনাকে বলতে পারি।

সাত বছর আগে যখন শুরু করেছিলেন, তখন টার্গেট অডিয়েন্স না থাকতে পারে, তার তিন বছর পর যখন ফেসবুক জনপ্রিয় হচ্ছে, সেরকম পর্যায়ে দাঁড়িয়েও কি আপনার মনে হয়নি যে আপনার একটা অডিয়েন্স তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে?

এটা খুব ইন্টারেস্টিং বিষয়। আমি আমাকে কখনও আমি হিসেবে দেখিনি। মানে ইগো বা সেলফের যে পার্টটা, সেই সেলফের জায়গায় এরা আমার গান শুনছেন বা আমি এখানে উপস্থাপিত সেটা আমি দেখিনি। আমি দেখেছি একটা লোক খ্যাপার মত খ্যাপামি করছে, এবং তাতে জনগণ কী করছে। আমি তৃতীয় একটা জায়গা থেকে এই দুটোই দেখতে থেকেছি। তার আগে আমি অষ্টাবক্র গীতা পড়েছিলাম। আরও কিছু স্পিরিচুয়াল জার্নি ছিল। এসব থেকে আমার মনে হয়েছে, যে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। নিজেকে তৃতীয় অবস্থানে নিয়ে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যে কিছু করছে আর যে কিছু শুনছে, এ দুটোর কোনওটাই আমি না। আমি ততদিনে এই অ্যালুফটুকু করে ফেলতে পেরেছি। ফলে এরা আমার গান শুনছেন এটা আমি কখনও ধরিনি। এঁরা আমার অডিয়েন্স, এ কথাটা আমার মনে হয়নি, আজও মনে হয় না।

আপনি কি আপনার যারা ফলোয়ার, তাদের চাহিদা অনুযায়ী কিছু প্রেজেন্ট করেন কখনও?

কখনওই না। কারণ আমি এখানে কোনও ব্যবসায়িক দিক দেখিনি। এখান থেকে আমি যে অডিয়েন্স তৈরি করব বা বাড়াব কী করে, তার কোনও স্ট্র্যাটেজি আমি তৈরি করিনি। আমি নিজেকে প্রকাশ করে গেছি, এখনও তাই করে যাচ্ছি। সেখানে আমি এটাকে কোনও বিজনেস হাউস বা কোনও চ্যানেল যেভাবে দেখে, সেভাবে আমি একজন আর্টিস্ট হিসেবে কীভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করব, আমি এটা কখনও ভাবিনি।

আপনি এই ফর্মটায় নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করলেন কবে থেকে? এটা ভিডিও প্রসঙ্গে নয়। এইটা যে আপনার ভাষা, এটা আপনি কবে বুঝতে পারলেন?

এটা বোধহয় প্রথম থেকেই। প্রথম থেকেই মানে আমার ছাত্রজীবন থেকে। তখন থেকে আমি বিচিত্র সুরে রবীন্দ্রসংগীত গাই। তখন থেকেই নিজস্ব কম্পোজিশনে গাই, নিজেকে একজন কম্পোজার বলে মনে করি। তাতে আমি ইম্প্রোভাইজ করে গেছি। কবিতা লেখা এবং গান কম্পোজ করা বা যা কিছু যা এসেছে, যেমন নৃত্য।

আপনার যে নতুন যে বই বেরোচ্ছে বাংলায় প্রথম বই আপনার, সেই বইয়ে আপনি এক ধরনের ভাষা ব্যবহার করেছেন…

হ্যাঁ, আমি সাব অলটার্ন ভাষা ব্যবহার করেছি।

হ্যাঁ, কিন্তু এই ভাষাতেই যে আপনি সর্বোত্তম উপায়ে নিজেকে এক্সপ্রেস করতে পারবেন, এ বোধটাও কি সেই প্রথম থেকেই তৈরি হয়েছিল?

না। বাল্যকালে আমাকে বাড়ি থেকে, স্কুল থেকে শেখানো হয়েছিল, যাকে আমি সাব অলটার্ন ভাষা বলে উল্লেখ করছি, সেটা অশালীন ভাষা, এ ভাষা বলতে নেই। আমিও সেটা বিশ্বাস করেছিলাম। এর পরে, আমি দিল্লিতে আমি দেখেছি জনগণ অবলীলায় তথাকথিত অশালীন ভাষা বলছে। আর ততদিনে আমার কিছুটা নবারুণ পড়ে, কিছুটা বিশ্বসাহিত্য পড়ে মনে হয়েছে, আফ্রিকান সাহিত্য পড়ে বা আফ্রিকান সাহিত্যিক বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশা করে, একটা অনলাইন ওয়েব জার্নালের সম্পাদক হিসেবে কাজ করি, এসবের যোগাযোগে আমার ভাষার বে়ড়াটা ভেঙে গেছে।

আমার মনে হয়েছে ভাষার ব্যাপ্তিকে আটকানো ঠিক নয়। আমার এক্সপ্রেশনও সেভাবেই এসেছে। এই সাবঅলটার্ন ভাষা ব্যবহারের মধ্যে যে ম্যাসকুলিন অ্যাগ্রেশন রয়েছে, সেটাকে আমি মুছে ফেলতে চেয়েছি। আমার মনে হয় এটাকে যদি ওই ম্যাসকুলিন অ্যাগ্রেশন হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তার কুপ্রভাব আছে।

প্রথমত মেল শভিনিজমের কুপ্রভাব আছে, দ্বিতীয়ত ম্যাসকুলিন অ্যাগ্রেশন কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু এ ভাষা আমরা দৈনন্দিন জীবনে এড়াতে পারিনি। অবশ্যই এই ভাষাকে ফিউচারিস্টিক দিকে ব্যবহার করতে হবে। আমার মনে হয়েছে আমরা বাংলায় ভাষার একটা সামাজিক স্তর তৈরি করছি, যেখানে উত্তর ঔপনিবেশিক হ্যাং ওভারে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত শ্রেণিবিভাগটা খুব জোরালো।

এর ফলে সমাজে অপরাধ বাড়ছে, একটা শ্রেণি আরেকটা শ্রেণিকে খাটো করছে। আমাদের একটু শিক্ষা প্রয়োজন। যেটা দিয়ে দুটো শ্রেণি একটা হোমোজেনিয়াস জায়গায় আসতে পারবে।

সাব অলটার্ন ভাষা, সংস্কৃতিতে প্রথা ভাঙা এগুলো এক একটা উপায়। প্রথমে যে মানবাধিকারের কথা বলছিলাম, সেই মানবাধিকার ও মানবতা সকলের জন্য এক নয়, কারণ সকলের সংস্কৃতি এক নয়, প্রতিষ্ঠানই শেষ কথা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর ফলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না।

সম্ভবত এগুলো আমার অবচেতনে কাজ করেছে। সেভাবে আমার সৃষ্টিকাজগুলো তৈরি হয়েছে।

এসব তো সময়ের কাছে রেখে চলে যেতে হয়। সময়ের কাছে সাক্ষ্য দিয়ে চলে যেতে হয়-কী কাজ করেছি, কী কথা ভেবেছি–জীবনানন্দ। জীবনানন্দে আমি অবসেসড ছিলাম একটা সময়ে। প্রথম কবিতায় সুর আসে জীবনানন্দে। বহুকাল আগে বিড়লা অ্যাকাডেমিতে একবার পারফর্ম করেছিলাম জীবনানন্দ, তারপর বাকিগুলো এসেছে। বিড়লা অ্যাকাডেমিতে আমি জীবনানন্দ যে সুরে গেয়েছিলাম, সেটা কনভেনশনাল ছিল না।

আমরা প্রায় শেষ করে এনেছি। আর দুটো প্রশ্ন। যারা আপনাকে গালিগালাজ করে, আর আপনার গালিগালাজ এ দুটোর তফাৎ কী?

(অট্টহাসি, গালাগাল)

আপনাকে কোন শিল্পী উদ্বুদ্ধ করেছেন?

নবারুণ অবশ্যই। আমার যা কিছু, বাংলা, ইংলিশ, হিন্দি, আর্বান, রুরাল যা কিছু, গাছের পাতা, প্রকৃতি, আকাশ, পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়া, বেড়াতে যাওয়া, বিদেশে গিয়ে রাস্তায় হারিয়ে যাওয়া এই সমস্ত সময় থেকে আমি যে নির্যাস পেয়েছি তা থেকে আমি উদ্বুদ্ধ হয়েছি। শুধু বাংলার কেউ উদ্বুদ্ধ করছেন বা বাঙালি বলেই উদ্বুদ্ধ করছেন, এরকম আমার হয়না। একটা টোটালিটি উদ্বুদ্ধ করে। আমাকে পিট সিগার উদ্বুদ্ধ করেন, লিওনার্ড কোহেন করেছেন, অমর পাল উদ্বুদ্ধ করেছেন, একজন নাম-না-জানা বাউল যাঁর গান আমি ট্রেনে শুনেছি, এঁরা অসীম উদ্বুদ্ধ করেছেন। প্রতি ধূলিকণা উদ্বুদ্ধ করেছে। আপনিও আমাকে উদ্বুদ্ধ করছেন। আমি মানুষের মধ্যে হৃদয় দেখতে চেয়েছি, চোখে প্রেম দেখতে চেয়েছি, প্রেম করতে গিয়ে অপ্রেম, সৃষ্টি করতে গিয়ে খিস্তি, এসবেতেই প্রচণ্ডভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছি।

এই যে এত গালাগাল, আক্রমণ, উৎপটামি, এসবের মধ্যে আমি মানবতা খুঁজে গেছি, এখনও খুঁজে যাই। আমার মনে হয়, প্রতিটি মানুষের প্রতিটি এক্সপ্রেশন প্রচণ্ড জরুরি। তার কারণ মানুষ এ পৃথিবীতে থাকতে চেয়েছে। মানুষ সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছে। কারও সঙ্গে কারও কোনও শত্রুতা নেই, সকলে সকলকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আমি একজন মানবিক মানুষ হয়ে উঠতে চাই, যে মানুষের মধ্যে মানবতা আছে, ভালবাসা আছে।

জড় এবং অজড়, নক্ষত্র এবং গাছপালা, ধূলিকণা ইট কাঠ পাথর – এই সামগ্রিকতার মধ্যে একটা প্রাণ রয়েছে। একটা অনুভব রয়েছে। সেই অনুভবের সঙ্গে জুড়ে থাকা আমাদের কাজ। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে ভবিষ্যতের সমাজকে সংজ্ঞায়িত করার, সামগ্রিক মানব সমাজকে সংজ্ঞায়িত করার। সেখানে সমানাধিকার, শান্তি, এগুলো সবই তো উদ্বুদ্ধ করার বিষয়।

আপনার সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে, আসলে আপনি তত রবীন্দ্রবিরোধী নন, যতটা রাবীন্দ্রিকতা বিরোধী। কারণ আপনি যা বললেন, তা রবীন্দ্রনাথের মানুষের ধর্ম, শান্তিনিকেতন সহ বিভিন্ন টেক্সটে মূলগতভাবে রয়েছে।

দাদুর প্রতি আমার অসীম প্রেম আছে। রবিদাদু, বিঠোফেনদাদু, জীবনদা বা সুকুমার রায়, এঁদের যে আত্মা… এঁরা কিন্তু আমার কাছে ব্যক্তি মানুষ নন। ব্যক্তি মানুষ হিসেবে এঁদের কখনও আমি চিনতে পারিনি। তাঁদের আত্মার যে প্রতিফলন তাঁদের কাজে পড়েছে, সেই কাজগুলো আমাকে স্পর্শ করেছে। আমি সকলের অসম্ভব ভক্ত। এঁদের কাজের সঙ্গে আমার আত্মাকে আমি জুড়তে পেরেছি। সেই জায়গা থেকে একটা মূল্যবোধ চলে এসেছে। সেটাকে আমি ধরার চেষ্টা করেছি।

আমি যখন রবীন্দ্রনাথ বলছি, সে রবীন্দ্রনাথ তো রবীন্দ্রনাথের আত্মা। এসেন্স অফ টেগোর। সেই এসেন্সের মধ্যে আত্মার যে মুক্তি রয়েছে, যে শিক্ষা রয়েছে, আমার ধারণা আমরা সেটা খুব কম নিয়েছি। সে এসেন্স যদি নেওয়া যেত, তাহলে আমাদের সমাজের এ অবস্থা হত না।

তা যদি হত, তাহলে কপিরাইট নিয়ে এরকম হুজ্জুতি, বা কে রবীন্দ্রনাথকে ডিভিয়েট করে গেল, রবীন্দ্রনাথে সাবঅলটার্ন ভাষা এসেছে বলে তাকে অপমান করা হয়েছে- এ ধরনের মানসিকতা তৈরি হত না। তবে এখন আমার মনে হচ্ছে প্রশ্নগুলো আসা ভাল।

রবীন্দ্রনাথের আত্মাকে আবিষ্কার করার জন্য আমাদের যে জার্নি, এগুলো তারই অংশ। এগুলোকে বাদ দিয়ে ওই এসেন্সে পৌঁছতে পারব না। রবীন্দ্রনাথকে আমরা এখনও আবিষ্কার করছি, কারণ রবীন্দ্রনাথ চিরন্তন। মানুষের প্রতিক্রিয়া একটা জিনিস নিশ্চিত করে যে আবিষ্কারপ্রক্রিয়া চলছে। যদি তা না হত, তাহলে মানুষ প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে যেত।

মানুষের প্রতিক্রিয়ার এই সিরিয়াসনেস দেখে আমি চমৎকৃত। যারা আমাকে গাল দিয়েছেন, সমালোচনা করেছেন, তাদের সকলকে আমার কুর্নিশ। আমার মনে হয়েছে, এরা সকলে রবীন্দ্রনাথকে ভালবাসেন, তাদের নিজেদের মত করে ভালবাসেন। আমি আমার মত করে ভালবাসি। ভালবাসার কত রং হতে পারে!এই পুরোটা মিলিয়ে যে অনুভব তৈরি হচ্ছে, সেটা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

“তোমার ওই ঝর্নাতলার নির্জনে মাঠের এই কলস আমার হারিয়ে গেল কোনখানে”, এখানে যে আমি, যে তুমি, যে কলস, যে ঝর্নাতলা- সমস্তই তো প্রতীকী। সেখান থেকে যখন গভীরতর জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, ভিজুয়ালগুলো বদলে, সেটা ওই সিম্বলগুলোকে পেরিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত রবীন্দ্রসংগীতে একটা আমি-তুমি রয়েছে। আমি জীবনদেবতা, এই আত্মা পরমাত্মার মধ্যে যে সংযোগ, সেই সংযোগকে উন্মোচিত করা হচ্ছে। এই উন্মোচন বিশাল শক্তিসম্ভার খুলে দিতে পারছে। এতদিন ধরে রবীন্দ্রসংগীত যে টিকে রয়েছে, সেটা ওই এনার্জিটা। সেটা ভাষার জন্য নয়, গায়নভঙ্গিও নয়। যে এনার্জি আমির বিকাশ ঘটায়। বিশ্বভারতী যদি আমিকে অবদমন করে থাকে, তাহলে তারা ভুল করেছে।

(রোদ্দুর বাংলায় নিজের নাম রোদ্দূর বানানে লেখেন। এবং যেহেতু তিনি ব্যাকরণকে জাহান্নামে পাঠাতে চান, ফলত…)

(ঢাকাটাইমস/২৫ডিসেম্বর/আরআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :