পথ কি শুধুই যাওয়ার?

মিজানুর রহমান খান
  প্রকাশিত : ২২ জানুয়ারি ২০২০, ০৯:২৯
অ- অ+

বড় রাস্তা থেকে আমাদের গাঁয়ে যাওয়ার পথটা ছিল কমপক্ষে সাত থেকে আট মাইল। কিন্তু আমার কখনো অতো দীর্ঘ মনে হয়নি, এতটুকুও ক্লান্ত লাগেনি কোনোদিন। বাস থেকে নেমে, পায়ে হেঁটে রওয়ানা দেওয়ার পর, কখন যে বাড়িতে পৌঁছে যেতাম ঘুর্ণাক্ষরেও টের পাওয়া যেতো না।

ওই পথ ছিল আমার পূর্বপুরুষের। আমার পিতা-পিতামহ-প্রপিতামহের পদচিহ্ন পড়ে আছে ওই ধুলোমাখা পথে। এই পথ ধরেই অন্য এক গ্রাম থেকে একদা এসেছিলেন আমার পিতামহী। তাদের দুজনই আজ এই গ্রামের শীতল মৃত্তিকার তলে ঘুমিয়ে আছেন। নীরবে নিভৃতে।

তাদের হাত ধরে ওই পথে বহুবার হেঁটে গেছি আমি, আজও যাই, তবে একা। তখন নির্জন কবর থেকে, তারাও পদধ্বনি শুনতে পান তাদেরই রক্তের, জানতে পারেন তাদের রেখে যাওয়া সাক্ষর, এই নশ্বর পৃথিবীর বুকে, আজও কদম ফেলে ফেলে এগিয়ে চলেছে।

পথ কি শুধুই যাওয়ার? মানুষ কি ফেরে না কোনো পথে?

রাস্তার দুপাশে কিছু দোকান পড়তো প্রথমে। একটু শহুরে শহুরে ভাব। কোনোটা থেকে শোনা যেতো সেলাই মেশিনের ঘর ঘর খটাং খটাং আওয়াজ, দেওয়ালে ঝুলতো ফুলতোলা লাল রঙের কামিজ, হয়তো উঠতি কোনো কিশোরীর। আবার কোনো দোকান থেকে ভেসে আসতো গরম গরম খাস্তা বিস্কুটের সুবাস, যেন এই মাত্র আগুনের চুল্লি থেকে নামানো হয়েছে। আহা, কী যে অপূর্ব নেশা ধরানো ওই গন্ধটা!

শুধু এই টুকুন পথ ছিল ইট বিছানো, তার পর ছোট্ট একটা ব্রিজ পার হলে পুরোটা রাস্তাই ধুলো মাটির, আমার বোনের মাথার সিঁথির মতো আকা বাঁকা সেই পথ। লাল মাটির উঁচু রাস্তাটার একপাশে ছিল সরু খাল। বর্ষাকালে তর তর করে নৌকা চলতো তার বুকে। আষাঢের নতুন জলে রাস্তা থেকে ঝাঁপ দিতো চঞ্চল শিশুরা। কোথাও কোথাও কেউ জাল ফেলে মাছও ধরতো। বৈশাখ মাসে যখন অল্প পানি থাকতো, শীর্ণ খালে হাঁটু অবধি নেমে চাষিরা হাত মুখ ধুয়ে, ঘাড় থেকে গামছা নামিয়ে, মুছতে মুছতে, উপরে উঠে আসতো, তারপর রাস্তায় বসে বিড়ি ধরাতো।

কিরে, কহন রওনা দিলি ঢাহাত্তে?

ওই ভোরে, ফজরের পর।

এতো দিরুং অইলো আইতে!

আর বলবেন না চাচাজান, ফেরিতে অনেক জ্যাম।

শহরে নাহি মেলা গণ্ডগোল?

হ চাচা।

এরশাদ কি থাকতে পারবো গদিতে?

কী জানি, ছাত্ররা খেপে গেছে, বলা যায় না কি হয়!

আর্মিরা নাহি গুলি করছে?

এগারো জন মারা গেছে চাচাজান, রক্তে শহর ভেসে গেছে!

রাস্তার অন্য পাশে নিচু হয়ে বিস্তীর্ণ ধূ ধূ জমি। শুকনো সময়ে তাতে থাকতো ফুলকপি, বেগুন, মরিচ, টমেটো, তরমুজ, তামাক, সরিষা। কখনো চাষিরা কাদা মাটির উপর ঝুঁকে ধানের চারা রুইয়ে দিতো। আবার কখনো লক লক করে বেড়ে ওঠা ধানের শীষের উপর দিয়ে ঢেউ খেলে যেতো হেমন্তের লিলুয়া বাতাস।

রাস্তাটা যেখানে যেখানে বাঁক নিতো সেসব মোড়ে ছিল নানা জাতের বৃক্ষ- হিজল, বট, ছাতিম, নিম, শিমুল কিংবা মান্দার গাছ। ছাতিম ফুলের গন্ধে ম ম করতো চারিধার।

এক সময় একটা হিন্দু পাড়ার ভেতর দিয়ে গেছে ওই পথ। দুপাশে ছিল বড় বড় পানের বাগান। সাদা ধুতি ও শাড়ি পরিহিত বৃদ্ধ বৃদ্ধারা কাজ করতো ওই বাগানে। কেউ একজন হাক ছেড়ে ডাক দিতো।

কে যায়, মুন্সি বাড়ির নাতি বুঝি?

আজ্ঞে, কাকা বাবু।

শহরে থেকে এলে নাকি?

হুম, আর কোত্থেকে আসবো, ওটাই তো আমার ঠিকানা।

তা সাহেব, কতো দিন থাকা হবে এবার, শুনে দেকি।

এক সপ্তাহ কাকা।

মোটে এক হপ্তা! তোমার অতো তাড়া কিসের?

স্কুল খুলে যাবে যে।

তোমরা শহরে থাকো, পড়াশোনা করে বড় বাবু হবে একদিন, তা একটু জিরিয়ে যাও বাড়িতে।

আজ আর হবে না। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আরেকদিন আসবো নে।

ওমা, এ কেমন কতা, একটু নাডু খেয়ে গেলে ভালো হতো। না হয় একটু জলই মুখে দিয়ে গেলে।

ওই বাড়ির পাশে ছিল খোলা মাঠ, ওখানে আড়ং বসতো সকালে। দুধ, গুড়, বাতাসা, সন্দেশ আরও কতো কী উঠতো বাজারে। পূজার মণ্ডপ ছিল। ছিল মাটির কলসি, খড় আর বাঁশ দিয়ে বানানো মূর্তি। ওই আড়ং থেকে নানা ভাই একবার আমাকে একটা ঢোল-গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। মাটির পাতিল দিয়ে বানানো গাড়ি। উপরে একটা পর্দার মতো, তারও উপরে একটা কাঠি লাগানো। পাতিলের নিচে ছিল কাঠের গোল গোল চাকা। গাড়িটা যখন দড়ি দিয়ে টেনে নিতাম তখন পর্দার ওপর জোরে জোরে ওই কাঠির বাড়ি পড়তো। আর গুড়গুড় গুড়গুড় করে বেজে উঠতো চারপাশে।

আড়ং পেছনে ফেলে একটা প্রাইমারি স্কুল, গুনাইঘর বাজার, তার পর দুটো সাঁকো পার হয়ে আমাদের বাড়ি। সেই বাড়ির বৈঠক খানায়, মাটিলেপা মেঝের ওপর, রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে, ভূমিষ্ঠ হয়েছিল এক শিশু।

যুদ্ধের সময়।

ওই মাটি আমি উপুড় হয়ে চুম্বন করেছিলাম।

লেখক: সাংবাদিক

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
জামায়াত-শিবিবের হামলায় গুরুতর আহত ছাত্রদল নেতার পাশে তারেক রহমান
গোপালগঞ্জের সংঘর্ষে নিহত বেড়ে ৪
গোপালগঞ্জে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ যুবক ঢামেকে ভর্তি, অবস্থা আশঙ্কাজনক
ডেঙ্গুতে ২৪ ঘণ্টায় আরও দুজনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৩২১
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা