করোনা ও আমাদের অতিরঞ্জিত মনোভাব

গোপাল অধিকারী
 | প্রকাশিত : ০৩ জুলাই ২০২০, ১০:১৬

বিশ্বব্যাপী এক প্রকার যুদ্ধই চলছে বলা যায়, যার এক প্রান্তে সব দেশের জনগণ আর অপর প্রান্তে করোনা। প্রথাগত যুদ্ধে তবু একটি স্বস্তির জায়গা থাকে, কিন্তু করোনার কাছে কেউ যেন স্বস্তি পাচ্ছে না। সবার মধ্যে কাজ করছে মানসিক চাপ। করোনার ভয়াল থাবার শিকার বিশ্বের প্রায় ২১০টি দেশ। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে করোনা ভাইরাসে মৃত্যুর সারি।

কয়েকদিন ধরে দেশে করোনা শনাক্তের সংখ্যা তিন হাজারের নিচে নামছে না যা চিন্তার বিষয়। এখন পর্যন্ত মৃত্যুসংখ্যাও পার করছে দুই হাজারের ঘর।

গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ার পর থেকেই চলছে করোনার তাণ্ডব।

করোনা বদলে দিচ্ছে জীবন ও জীবিকার ধরন। দীর্ঘসময় কর্মহীন মানুষ হয়ে পড়ছে অসহায়। প্রভাব পড়েছে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও অর্থনীতিসহ সবকিছুর উপর। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ঝরে পড়ছে বা পড়তে পারে শিক্ষার্থীর পড়ালেখা।

কিন্তু সবচেয়ে দুখজনক ব্যাপার হলো- করোনা রোগী নিয়ে চলছে এক অমানবিক আচরণ। করোনা নিরাময়যোগ্য নয় বা করোনা অর্থই যেন সে সমাজের নিকৃষ্ট এমন প্রবণতা লক্ষ্ করছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তেই একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পত্র-পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলে অনেক খবরই দেখছি যে, করোনা রোগীকে খাবার দিচ্ছে না। করোনা রোগীকে ঘর ভাড়া দিচ্ছে না। সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো করোনা রোগে কেউ মারা গেলে তার পরিবারের সাথে কেউ যোগাযোগ করছে না। এ কারণে অনেকে এই রোগে আক্রান্ত হলেও কাউকে বলছে না।

একজন করোনা আক্রান্ত রোগী মহাপাপীও না, অপরাধীও না। হোমকোয়ারেন্টাইনে থাকার অর্থ সে অপরাধী নয়। যে রোগের যে চিকিৎসা। করোনা রোগে কেউ আক্রান্ত হলে তাকে আলাদা রাখা উচিত, কারণ তার সাথে কারো সংস্পর্শ হলে রোগের বিস্তার ঘটতে পারে বা বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে রোগটি সংক্রমিত হতে পারে। রোগীর সুস্থ্যতা ও পরিবারের সুস্বাস্থ্য চিন্তা করে এই প্রতিকার। তাহলে কেন করোনা শনাক্ত হলেই তার সঙ্গে অমানবিক আচরণ করতে হবে? তাকে সমাজের নিকৃষ্ট মানুষ ভাবতে হবে?

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তেই এমন প্রচার-প্রচারণা বা প্রবণতা রয়েছে, বিশেষ করে গ্রামে এটি বেশি ভাবা হচ্ছে। এমন প্রবণতার কারণে অনেকের মধ্যে আতঙ্ক বা চাপ কাজ করছে। ফলে আগে থেকে অসুস্থ রোগীরা এই মনোবৃত্তি করতে করতে মারা যাচ্ছে বা যেতে পারে।

আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। করোনায় আক্রান্ত নয় বরং এই সংকটময় সময়ে যারা চাল চুরি বা জনগণের টাকা পকেটে রেখে পকেট ভারী করছে তাদের ঘৃণা করা উচিত। করোনা রোগীর সঙ্গে যারা অমানবিক আচরণ করছে তাদের ঘৃণা করতে পারি।

করোনা একটি রোগ এবং এই রোগ নির্মূল করা যাবে না তাও না। এই রোগ থেকে বিশ্বে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ সুস্থ হচ্ছে। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ৭০ হাজারের বেশি মানুষ।

বিবেচনায় বলে করোনায় রোগীকে এখন আমাদের বেশি মূল্যায়ন করা উচিত তার ও আমাদের সুস্বাস্থ্যের জন্য। সঠিক নিয়ম ও সর্তকতা অনুসরণ করলে করোনা বাংলাদেশে তেমন ক্ষতি করবে না বলে আশা করা যায়। চীনা গবেষণায় বলা হয়েছে, উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমের সময় করোনা ঝুঁকি কমে যাবে। উত্তর গোলার্ধ বেশ কয়েকটি দেশ রয়েছে। উইকিপিডিয়া বলছে, বাংলাদেশের অবস্থান উত্তর গোলার্ধে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশে করোনার ঝুঁকিটা কিছুটা হলেও কম হবার কথা।

কিন্তু অসচেতনতার কারণে আমাদের উল্টোযাত্রা। সাম্প্রতিক কয়েক দিনের পরিসংখ্যান থেকে মনে হয় করোনা সহজে মুক্তি দিবে না প্রিয় এই দেশকে। করোনার গতি ঊর্ধ্বগামী। ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মানছি না, নিরাপদে চলছি না। সকলের আচরণে মনে হচ্ছে করোনা আর বাংলাদেশে নেই।

প্রকৃতির এই ভয়াল ভাইরাসে কারো উপর দোষ না চাপিয়ে, করোনা রোগীকে ঘৃণা না করে সকলে মিলে আইন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। আইন না মানা একরকম গুরুতর অপরাধ। একসময় দেশে ক্যান্সার হলে, যক্ষ্মা হলে রক্ষা ছিল না। এখন এই মরণব্যাধিরও ওষুধ বের হয়েছে। যক্ষ্মারোগীকে কেউ আর আলাদা মনে করে না।

করোনা রোগীও আলাদা নয়। আমরা তাদের পরিবারের প্রতি সদয় হই, তাদের খোঁজ-খবর নিই। করোনা দূর করতে শক্তি ও সাহস দেই। পাশাপাশি করোনা যেন আমাদের মাঝে দূরত্বের সৃষ্টি না করে আমাদের সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

করোনা আমাদের শিখিয়ে যাচ্ছে রাগ-হিংসা-ঈর্ষা কোনোটাই আমাদের নয়। এই মন্দ অভ্যাসগুলো আমাদের কোনো ভালো কিছু করতে সাহায্য করে না। কেউ কি এমন সংবাদ পেয়েছেন কোনো এলাকায় কোনো মানুষের হিংসার কারণে করোনা থেকে মুক্তি পেয়েছে? এই যে সমাজের মন্দ অভ্যাস, আসুন আমরা করোনার সাথে দূর করি।

করোনা থেকে শিক্ষা নেই, সকলে মিলে হাতে হাত রেখে রোগীকে ভাল পথে সুস্থ জীবন গড়তে উৎসাহিত করি। সরকারের প্রতি অনুরোধ করোনা রোগীর সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা রক্ষায় সচেষ্ট থাকুন। করোনার গুজব বা আইন লংঘন বা ঘৃণা এগুলো কারোই কাম্য নয়।

মানুষের জীবন মানেই সুখ-দুঃখ, ব্যাধি-সুস্থতা সবকিছু মিলে। রোগ হলেই টেনশন বা দুশ্চিন্তা হওয়াটা স্বাভাবিক। আবার স্বস্তিও আছে- বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির কারণে কোনো রোগই আর রোগ নয়। স্বাস্থ্যবিধি মানলে, ওষুধ খেলে যেকোনো রোগই নিরাময় হয়। কিন্তু বিভিন্ন রোগে আমাদের অতিরঞ্জিত মনোভাব আমাদের ক্ষতির কারণ হয়। যেটা ঘটছে করোনারোগীর বেলায়।

আসুন, আমরা করোনা রোগীকে সাহস ও শক্তি দেই। সুস্থ হতে সহযোগিতা করিয়।কোভিড-১৯ অনিরাময় কোনো রোগ নয়। সচেতনতাই এর বিরুদ্ধে মূল অস্ত্র। করোনায় ঘৃণা নয়, সকলে সচেতন হই ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

( ঢাকাটাইমস/৩জুলাই/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :