পর্ব-২

করোনায় হাসপাতালের দিনগুলো

মো. ইমরান শাহরিয়ার
 | প্রকাশিত : ১৬ জুলাই ২০২০, ১৬:৩০

আমরা স্ত্রী (মীম) যখন গফরগাঁও থেকে তার ভাইয়ের সাথে রওনা হয় সেই সময়টা ছিলো ভীষণ বেদনাদায়ক। মে মাসের ৩১ তারিখ মীম তার ডাইরিতে করোনার জন্য হসপিটালে ভর্তি হতে হলে কি কি সঙ্গে নিতে হবে এমন একটি লিস্ট করেছিলো, বিধিবাম এক সময় সেই লিস্ট ধরেই তাকে প্রস্তুত করে জুন মাসের ২৯ তারিখ আমার অচেনা একটি সরকারি হসপিটালে পাঠিয়ে দেবার মত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সিদ্ধান্তটি হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটালেও নিজেকে শক্ত করেছিলাম সেই সময় পরবর্তী এক লেখায় ওই তালিকাটিও প্রকাশ করবো ইনশাআল্লাহ।

মীম ভর্তি হবার পর যখন আমার আব্বার শরীর অবনতির দিকে যেতে থাকে। রাত ১০:৩০ মিনিটে উনিও হসপিটালে ভর্তির কথা বলেন। এমন করোনাকালীন সময়ে দোকানপাটও বন্ধ করে দেয় সন্ধ্যার ভিতর।

ওই সময় পরিচিত এক ওষুধ আর মুদির দোকানে ফোন দিয়ে একই লিস্ট ধরে তড়িঘড়ি করে আব্বার জন্য কিছু ওষুধ আর

নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী এনে রাত ১.৩০ মিনিটে আমি এম্বুল্যান্সে আব্বাকে নিয়ে রওনা দেই। আব্বাকে নিয়ে ঢাকা হসপিটালে যাচ্ছি এই খবর গফরগাঁও বাজারে ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই ফোন দেওয়া শুরু করে। বিশেষ করে আরেক ফুফাতো ভাই গফরগাঁও পৌরসভার মেয়র এস এম ইকবাল হোসেন সুমন ভাই ভোর চারটায় ভর্তি না হবার পূর্ব পর্যন্ত খোজ খবর নিতে থাকেন। উল্লেখ্য, উনিও কিছুদিন পূর্বে করোনা আক্রান্ত হয়ে আল্লাহর রহমতে ঢাকার কুর্মিটোলা হসপিটালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন।

এদিকে পথিমধ্যে গফরগাঁও ৬ নং রওনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. শাহাবুল আলম বায়না ধরে যে আমি যেন রাস্তায় অল্প সময়ের জন্য হলেও এম্বুল্যান্স থামিয়ে দূরত্ব মেনে আব্বাকে এক নজর দেখিয়ে নিয়ে যাই। তাকে যতই না করি কিন্তু সে তো নাছোড়বান্দা। বন্ধু শাহাবুল চেয়ারম্যান ঠিকই পথের মাঝে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থেকে রাত ২ টায় দেখা করে যায়।

পুরো রাস্তায় উৎকণ্ঠা নিয়ে ঢাকার দিকে যেতে থাকলাম। যেতে যেতে ভাবলাম মীমকে একা পাঠানোর পর কিছুটা সময় আমার কেমন শূন্য শূন্য লেগেছিলো। ঘরটা কেমন শূন্য হয়ে গিয়েছিলো আর এখন আমি আর আমার আব্বাকে এভাবে পাঠানোর পর আমার আম্মা যেনো কীভাবে এই কষ্ট সইছে?

উনারতো পুরো বাসাটায়তো শূন্য হয়ে গিয়েছে। কি বিষণ্ণতা জানি উনার মনে ভর করেছে? আব্বাকে ছাড়া ওই একা ঘরে পুরোটা রাত উনার কেমন করে কাটবে? আব্বার ফেলে যাওয়া ব্যবহার্য সামগ্রী আর এলোমেলো শূন্য বিছানা দেখে হয়তো উনার মনও হু হু করে কেঁদে উঠবে। এসব ভাবতে ভাবতে যখন কুয়েত মৈত্রী হসপিটালে পৌঁছায় তখন ভোর চারটা।

পৌঁছানোর সাথে সাথেই আব্বার অবস্থা দেখে হসপিটাল ভর্তি নিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে হসপিটালের সুপারিন্ডেন্ট সাহেবের আন্তরিক ভূমিকা ছিলো অনস্বীকার্য। উনার সরাসরি সহযোগিতায় আমার স্ত্রী, আব্বা এবং আমাকে একই রুমে চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়।

এখানে ভর্তির প্রক্রিয়াটা খুব জটিল মনে হয়নি। দূর থেকে একজন নাম ঠিকানা, বয়স জেনে নোট নিলো। সমস্যাগুলো জানলো। রোগীর অবস্থা দেখে বসতে বলল। একটুপর ভোর ৪.১৫ মিনিটে দুইজন ওয়ার্ড বয় এসে আমাদের মালামালগুলো ট্রলিতে করে আমাদের সাথে নিয়ে ওয়ার্ডে পৌঁছে দিলো।

ওয়ার্ডে পৌঁছে দেখি আমার স্ত্রী একটি বেডে জীর্ণ হয়ে শুয়ে আছে, রাত ভর ঘুমায়নি। ওয়ার্ডের সাথে তার অবস্থাও বিধ্বস্ত। এমন পরিস্থিতিতে মালামালগুলো এক পাশে রেখে আব্বাকে টয়লেট করিয়ে বিছানায় একটা চাদর পেতে ঘুমাতে দিলাম। কেউ সারারাত ঘুমায়নি। আব্বা, মীম সাথে সাথেই ঘুমিয়ে গেলো। আমি এর মাঝে ওয়ার্ড বয়কে দিয়ে রুমটা পরিষ্কার করে সব কিছু গুছিয়ে নিলাম।

এই অবস্থাটা একটু কঠিন। এখানে মন আর শরীরকে শক্ত রেখে কাজ সেরে নিতে হয়। আবার নিজেরও যত্ন নিতে হয়। আমি প্রথমেই বুঝে নিলাম এটা নেগেটিভ ওয়ার্ড তাই বেশীদিন রাখবেনা তাই কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ আর কিছু মালামাল বের করে রুমটা গুছিয়ে আশেপাশের পরিবেশটা চিনে নিলাম।

আব্বার আর আমার যেহেতু পেটে সমস্যা তাই বাথরুমটা দেখে পরিষ্কার করিয়ে নিলাম। এখানের ওয়ার্ডগুলোতে হাই কমোড নেই, কেবিনগুলোতে হাই কমোড আছে কিন্তু কেবিনে এক বা দুইটি বেড। আমরা তিনজন মানুষ পাশাপাশি আব্বা যথেষ্ট আনস্ট্যাবল। ওনার পাশেই সারাক্ষণ থাকা লাগে আবার মীমকেও একা রাখা যাবেনা। পুরো ওয়ার্ডটাই যেহেতু আমরা আছি আর সামনে খোলা বড় বারান্দা তাই সিদ্ধান্ত নিলাম- এখানেই থাকবো আর হাই কমোডের জন্য আমি বাসা থেকে প্যান চেয়ার সাথেই নিয়ে আসি। মীম আগেই এসে ভর্তি হওয়ায় এই তথ্যটা জানিয়ে দেয় যে, বাসা থেকে কমোড চেয়ার নিয়ে এসো।

এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, করোনা রোগের চিকিৎসার জন্য হসপিটালে ভর্তি হতে হলে মাথায় প্রথমেই একটা বিষয় সেট করে নিতে হবে যে আমাকে সুস্থ হয়ে বা যাকে নিয়ে ভর্তি হচ্ছি তাকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বেসরকারি দামী হসপিটালের মত হয়তো এখানে সবকিছু ঝকঝকে লাইটে চকচকে দেখায়না। তবে সরকারি হসপিটালে যে ট্রিটম্যান্ট হয় তা বেসরকারি হসপিটাল যে দিতে পারবেনা বা পারছেনা তা ইতিমধ্যে বেশ কিছু খবরে সবাই অবগত।

এছাড়া ২০১৬ সালে আম্মার লাম্বার স্পাইনে অপারেশনের জন্য আগারগাঁও এ নিউরো সাইন্স হসপিটালে এক মাস থাকার পর বুঝেছি সরকারি হসপিটালে প্রথম দিকে সাময়িক কিছু কষ্ট হলেও পরবর্তীতে তা মিটিয়ে নেওয়া যায় এবং ওরা ট্রিটম্যান্টটা চমৎকার করে। তাই ডা. বড় ভাই বলার সাথে সাথে এখানে ভর্তি হতে দেরি করেনি।

কিছুক্ষণ পর আব্বা আর মীম ঘুম থেকে উঠলে তাদেরসহ আমি নাস্তা ও ওষুধ খেয়ে নিজে ফ্রেশ হয়ে সবাইকে আবার আবার শোয়ালাম। আমি নিজেও শুয়ে শুয়ে পরিবারের কানেকটিং সদস্যদের পরিস্থিতি জানিয়ে নিজেও একটু ঘুমালাম।

আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন চাইলে পরবর্তী লেখায় কীভাবে চিকিৎসা শুরু এবং চিকিৎসার বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখবো ইনশা আল্লাহ। (চলবে.....)

লেখক: পরিচালক, ডেলটা হেলথ কেয়ার, যাত্রাবাড়ী লি.

ঢাকাটাইমস/১৬জুলাই/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :