‘ওষুধ বিপণনে কোনও নিয়মই অনুসরণ করা হচ্ছে না’

তানিয়া আক্তার, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২২ জুলাই ২০২০, ০৮:১৭ | প্রকাশিত : ২২ জুলাই ২০২০, ০৮:০১

বিশ্বের অধিকাংশ দেশে একটি নিয়মের মধ্যে ওষুধ বিপণন হলেও বাংলাদেশে তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। তবে সবচেয়ে ক্ষতিকর বিষয় হলো এখানে ওষুধ কোম্পানির কাছে ডাক্তাররা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তারা অনেকটা ‘চুক্তিবদ্ধ’ হয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ওষুধ রোগীদের প্রেসক্রাইব করছেন। আবার ডাক্তারের দেওয়া প্রেসক্রিপশন মনিটর করে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা। অর্থাৎ দেশে ওষুধ বিপণনের ক্ষেত্রে এভাবে একটা পুরো চক্র কাজ করছে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা টাইমসকে এসব কথা বলেন। একান্ত এই সাক্ষাতকারে ঔষধ প্রশাসনের সাবেক এই ডিজি এই অবস্থা থেকে উত্তরণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ঔষধ প্রশাসনকে একযোগে কাজ করতে হবে বলেও তাগিদ দিয়েছেন।

দেশের হাসপাতালগুলোতে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের উপস্থিতি বেড়েই চলেছে। তারা রোগীদের কাছ থেকে ডাক্তারের দেওয়া প্রেসক্রিপশনও ছবি তুলে রেখে দেয়। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি তাদের ওষুধের বিক্রি বাড়াতে ডাক্তারদের অনৈতিক উপটোকন দেয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এসব বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ওষুধ বিপণনের প্রয়োজনে ডাক্তারদের উপঢৌকন দেয়ার প্রক্রিয়াটি এখন ওপেন সিক্রেট বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বিপণন খরচের বড় অংশ অনৈতিকভাবে ব্যয় হচ্ছে।’

‘ওষুধ শিল্পের প্রচারণার বেশ গুরুত্ব রয়েছে। তবে দেশে ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রচারণার বাইরেও কিছু কাজ করে যা একেবারেই অনৈতিক। যেমন ওষুধ কোম্পানির লোকজন রোগীর কাছ থেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ছবি তোলে অফিসে কিংবা কোথাও সেটা দিয়ে দেয়। হয়তো ডাক্তারদের সঙ্গে একটা আঁতাত থাকে। ডাক্তাররা কোন কোম্পানির ওষুধ প্রেসক্রিপশন করেছেন সেটা প্রমাণের জন্য হয়তো এই ছবি তোলা হয়।’

প্রেসক্রিপশন একটা রোগের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয় উল্লেখ করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি বলেন, ‘কিন্তু তারা সেগুলো না মেনে নিজেদের স্বার্থে রোগীদের বিরক্ত করে সেই ছবিগুলো তুলছে। ফলে হাসপাতালের আউটডোর সার্ভিসগুলো প্রচন্ড রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারণ ওষুধ কোম্পানির লোকেদের ভিড় লেগেই থাকে। যেখানে হাসপাতালগুলোতে গী দাঁড়াতে পারে না ঠিক মতো সেখানে ওষুধ কোম্পানির লোকদের এত ভিড় চোখে পড়ার মতো।’

তিনি দায়িত্বে থাকার সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সোমবার আর বৃহস্পতিবার ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রচারণা করতে পারবে বলে সময় বেঁধে দিয়েছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান।

সে বিষয়টি টেনে তিনি বলেন, ‘বেঁধে দেওয়া সময়ের আগে কোনও ভাবেই তারা হাসপাতালে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই এই নিয়মটা মানা হয় না। ফলে ওষুধ কোম্পানির লোকেরা ডাক্তারদের এত বেশি ব্যস্ত রাখে যে রোগীরা সুযোগই পায় না। দায়িত্বে থাকাকালীন ঢাকা মেডিকেলে এরকম পরিস্থিতি দেখার পর আমি তাদের ফিল্ড ম্যানেজারকে ডেকে এনে তাদেরকে হ্যান্ডওভার করেছি।’

‘অথচ এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে প্রচারণার অনেকগুলো মাধ্যম আছে। কিন্তু তা না করে কোম্পানির মালিকগুলো নিয়মকানুনই সেগুলো মানছে না। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ওষুধ বিপণন একটি নিয়মের মধ্যে এলেও বাংলাদেশে তা অনুসরণ করা হচ্ছে না।’

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক এই ডিজি জানান, ঔষধ প্রশাসন থেকে রিটেইলার প্রাইসের সঙ্গে রিটেইলার বেনিফিট দেওয়া থাকে। রিটেইলার বেনিফিট হলো ১৪%। কিন্তু ছোট ছোট কোম্পানির ইনভেস্টমেন্ট কম। ফলে তারা প্রচুর ছাড় দিয়ে অর্থাৎ ৪০% ছাড়ে তাদের ওষুধ বিক্রি করে। যেটি বড় কোম্পানিগুলো করতে পারে না। ফলে দেখা যায় ছোট কোম্পানির বিক্রি ভালো হয় এবং প্রচারও বেশি হয়। যেহেতু তাদের রেজিস্ট্রেশন আছে ঔষধ প্রশাসন থেকে তাই তাদের বিরুদ্ধে কিছু করাও যায় না।

মোস্তাফিচুর বলেন, ‘আরেকটা অনিয়ম ঘটে কম মানের ওষুধ তৈরি ক্ষেত্রে। অর্থাৎ কেউ যদি প্যারাসিটামল বানাতে চায় তাহলে প্রথমে রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্টে দেবে। তারপর সেটি পাঠাবে কোয়ালিটি কন্ট্রোলে। তারপর তারা পাঠাবে কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্সকে। সেটি হওয়ার পর স্যাম্পল ব্যাচে তারা দেখে এটাতে কোয়ালিটি ঠিক আছে কি না। এরকম বিভিন্ন ধাপ শেষ হওয়ার পর বাণিজ্যিকভাবে কতগুলো ওষুধ তৈরি করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’

‘ফলে এতগুলো ধাপ সম্পন্ন করতে অনেক খরচের প্রয়োজন পড়ে। তবে গুণগতমান যাচাই হয়। কিন্তু দেশে বেশিরভাগ ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি সেই ধাপগুলো পুরোপুরি সম্পন্ন করে না। পুরো প্রসেসটাকে সংক্ষিপ্ত করে ফেলে। খরচ কমাতে গিয়ে এই প্রসেস সংক্ষিপ্ত করায় গুণগত মানও কম হয়ে পড়ে। কিন্তু সুবিধাটা হলো তাদের রেজিস্ট্রেশনটা থাকে। ফলে সেই সুযোগে তারা অধিক ছাড়ে বিক্রি বাড়িয়ে প্রচার নিয়ে মান কম হলেও বাজারে ভালো অবস্থায় থাকে।’

বিদেশি ওষুধগুলোর তুলনায় দেশীয় ওষুধগুলো গুণগতমানে রাতদিন পার্থক্য থাকে মন্তব্য করে ঔষধ প্রশাসনের সাবেক ডিজি বলেন, ‘ক্ষতিকর বিষয় হলো ল্যাবগুলোর সঙ্গে ডাক্তারদের যেরকম গোপন আঁতাত থাকে আবার ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও থাকে। আর সেই ডাক্তাররা ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখছেন কি-না রোগীর প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে সেগুলো মনিটর করে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা। এখানে অনেক ধরনের মানুষের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে যেমন ডাক্তার, মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ, ঔষধ কোম্পানি। এদের সবার কিছু না কিছু স্বার্থ থাকেই। এভাবে একটা পুরো চক্র কাজ করে।’

এ বিষয়টি সমাধানের ক্ষেত্রে ডাক্তাররা রোগীকে কোন ধরনের ওষুধ দিয়েছে এবং হাসপাতালে ওষুধ থাকার পরেও অন্য কোম্পানির ওষুধ লিখছে কি-না সেগুলো খতিয়ে দেখা জরুরি বলে মনে করছেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি।

এসব ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো প্রমাণ না থাকায় ব্যবস্থা নেওয়াটাও কঠিন হয়ে পড়ে উল্লেখ করে মোস্তাফিজুর বলেন, ‘তবে ভয়াবহ বিষয়টি হলো কারো কোনও ডকুমেন্ট পাওয়া যায় না। আর ডকুমেন্ট ছাড়া প্রমাণ করার পথও বন্ধ। তাই এই অনৈতিক বিষয়গুলো বন্ধ করতে হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঔষধ প্রশাসন সবার একযোগে কাজ করতে হবে।’

‘তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে যে হাসপাতালগুলো রয়েছে তাই তারা বেশি ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া কোনও ভাবেই মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা হাসপাতালে ঢুকতে পারেন না। এরপরও যদি কাউকে নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে হাসপাতালে পাওয়া যায় তাহলে ওই ওষুধ কোম্পানি বয়কট করা যেতে পারে কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে পারে।’

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যেহেতু দেশের ছোট বড় ওষুধ কোম্পানিগুলোর বড় প্রভাব পড়ে হাসপাতালগুলোতে। তাই ঔষধ প্রশাসন এই অস্বাস্থ্যকর প্রচার-প্রচারণাগুলো বন্ধ করতে পারে। যে প্রমোশন অফিসারগুলোকে ওষুধ কোম্পানিগুলো হাসপাতালে পাঠায় তাদের একটা নিয়মের মধ্যে এনে মনিটরিং করতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে সেই ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে ঔষধ প্রশাসনের কঠোর অবস্থান নিতে হবে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি বলেন, ‘কারণ ঔষধ প্রশাসন থেকে ঔষধ কোম্পানীর বিভিন্ন বিষয়ে অনুমতির প্রয়োজন পড়ে। যদি ওষুধ কোম্পানিগুলোর নতুন প্রোডাক্ট ঔষধ প্রশাসন ছাড় না দেয় বা দেরি করে বা ব্যাক লিস্টেড করে তাহলেই তারা নিয়মের পথে চলে আসবে।’

(ঢাকাটাইমস/২২জুলাই/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :