কুড়িগ্রামে বস্তা কেলেঙ্কারি: বদলি আতঙ্কে ঘুম হারাম!

মমিনুল ইসলাম বাবু, কুড়িগ্রাম
 | প্রকাশিত : ৩১ অক্টোবর ২০২০, ১৩:১৪

সরকারিভাবে ধান, চাল ও গম সংরক্ষণে কুড়িগ্রাম জেলা খাদ্য বিভাগে ছেড়া, ফাঁটা ও নিম্ন মানের প্রায় আট লাখ বস্তা কেনার দুর্নীতির অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় নতুন করে আরও ২৩ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিকে বদলির আদেশ জারি করেছেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মিজানুর রহমান।

বুধবার দিবাগত রাতে এ আদেশ জারি হলেও বৃহস্পতিবার কর্মস্থলে এসে কর্মচারিরা বিষয়টি জানার পর হতাশ হয়ে পড়েন। অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারিও এখন আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে। কখন বদলির আদেশ আসে, এই দুশ্চিন্তায় তাদের সময় কাটছে। এক কথায় ঘুম হারামের মতো পরিস্থিতিতে তাদের সময় কাটছে। নতুন বদলিকৃতদের ২ নভেম্বরে পদায়নকৃত কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

এর আগে একযোগে ১৪ জন কর্মকর্তা কর্মচারিকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে। এদের মধ্যে তিনজন ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তা (ওসিলএসডি) এবং ছয়জন পরিদর্শক রয়েছেন।

রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে গত ২১ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত পৃথক ছয়টি অফিস আদেশে এদের বদলি করা হয়। তাদেরকে ১ নভেম্বর পদায়নকৃত কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ফলে সবাই এখন দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

বদলি হওয়া কর্মচারীরা সবাই উপজেলা এলএসডির নিরাপত্তা প্রহরী। তারা হলেন, রাজারহাট এলএসডির ইসমাইল হোসেন ও ফারুক মন্ডল, নাগেশ্বরীর এলএসডির গোলাম রব্বানী, তৌহিদুল হক, মাহাবুর রহমান ও নুরুজ্জামান নয়ন, ফুলবাড়ীর এলএসডির আবু বকর ছিদ্দিক, নুর ইসলাম ও আব্দুল গফুর, রৌমারীর এলএসডির আবু জোবায়ের ও হাবিবুর রহমান, চিলমারীর এলএসডির মাঈদুল ইসলাম ও সোহরাব হোসেন দুদু, কুড়িগ্রাম সদর এলএসডির হেলিম উদ্দিন তালুকদার, মরিয়ম বেগম, মাহবুবা শবনম, জাহিদ হাসান, জিয়াউর রহমান, জেসমিন বেগম ও মোস্তাফিজার রহমান, উলিপুর এলএসডির নুরে আলম সরকার, ভুরুঙ্গমারী জয়মনিরহাট এলএসডির রমজান আলী এবং জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের নিরাপত্তা প্রহরী শাহ আলমকে বিভিন্ন উপজেলা এলএসডিতে বদলি করা হয়।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মিজানুর রহমান বলেন, ইতিপূর্বে খাদ্য অধিদপ্তর ঢাকার প্রশাসনিক বিভাগ এবং আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক রংপুর কার্যালয়ের লিখিত নির্দেশনা এবং সর্বশেষ বুধবার আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুস সালামের টেলিফোনিক নির্দেশনায় রাতেই এ বদলি আদেশ জারি করা হয়।

দুই বছরের বেশি সময় যারা একই কর্মস্থলে অবস্থান করছিল তাদের বদলি করা হয়েছে। এটি রুটিন ওয়ার্ক। জনস্বার্থে এ আদেশ জারি করা হয়েছে। এর আগে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক রংপুর কার্যালয় থেকে একযোগে ১৪ কর্মকর্তা-কর্মচারিকে বদলি করা হয় বলে স্বীকার করেন। তবে ঠিক কী কারণে তাদের বদলি করা হয়েছে তা তিনি জানাতে পারেননি। বস্তা কেনার দুর্নীতির সঙ্গে এই গণবদলির সম্পর্ক আছে কি না তা জানাতে রাজী হননি তিনি।

উল্লেখ্য, আগের বদলি হওয়া কর্মকর্তারা হচ্ছেন, কুড়িগ্রাম সদর খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমা, ভুরুঙ্গামারী খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা প্রণব কুমার গোস্বামী, ফুলবাড়ি খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা হামিদুল ইসলাম, চিলমারী উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক মাইদুল ইসলাম মাহি, উলিপুর উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক গোলাম মোস্তফা, নাগেশ্বরী উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক রবিউল আলম কাজল, ফুলবাড়ী উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক মনোয়ারুল ইসলাম, রাজারহাট উপজেলা খাদ্য পরিদর্শক নুর মোহাম্মদ, কুড়িগ্রাম সদর খাদ্য পরিদর্শক (কারিগরী) মিজানুর রহমান।

এছাড়া আছেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী ইউসুফ আলী, কম্পিউটার অপারেটর আলমগীর হোসেন, স্প্রেম্যান নবিউল ইসলাম ও জিয়াউর রহমান, নিরাপত্তা প্রহরী আরিফ মিয়া। তাদেরকে লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ে বদলি করা হয়।

রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য কর্মকর্তা আব্দুস সালামের দেয়া আদেশে তাদেরকে ১ নভেম্বরের মধ্যে স্ব স্ব কর্মস্থলে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয়। অন্যথায় পরদিন থেকে তাদেরকে কর্মবিমুক্ত বলে গণ্য করা হবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বোরো মৌসুমে কুড়িগ্রামের জন্য প্রায় আট লাখ নতুন বস্তা কেনার জন্য একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে খাদ্য বিভাগের চুক্তি হয়। ওই প্রতিষ্ঠান বস্তা সরবরাহের সময় চুক্তি ভঙ্গ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে আট লাখ পুরনো নিম্নমানের ও ছেঁড়া-ফাটা বস্তা কুড়িগ্রাম সদর, ফুলবাড়ি ও ভুরুঙ্গামারী খাদ্যগুদামে সরবরাহ করে।

এই সময় রংপুর ও নীলফামারীতে বস্তার সংকট দেখা দিলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কুড়িগ্রাম সদর খাদ্য গুদাম থেকে সদ্য কেনা দুই লাখ বস্তা সেখানে পাঠানো হয়। ওই বস্তা রংপুর ও নীলফামারীতে পাঠানোর পর পুরাতন বস্তা রিসিভ না করে সংশ্লিষ্ট এলএসডির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিম্নমানের ছেঁড়া-ফাঁটা বস্তা উল্লেখ করে লিখিত চিঠি দিয়ে ফেরত পাঠায়। ফলে দুর্নীতির ঘটনা ফাঁস হয়।

এই সূত্রধরে বিভিন্ন মিডিয়ায় ২৫ সেপ্টেম্বর কুড়িগ্রাম খাদ্য বিভাগের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়। শুরু হয় খাদ্য বিভাগে তোলপাড়। স্থানীয়ভাবে গঠন করা হয় দুটি তদন্ত কমিটি। এ কমিটি দুর্নীতির সত্যতা নিশ্চিত করে রিপোর্ট দাখিল করে।

বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে গত পাঁচ-আট অক্টোবর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মজিবর রহমানের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি সরেজমিন তদন্ত করেন। এর পর বস্তা কেনায় দুর্নীতির অভিযোগে গণবদলির আদেশ জারি করা হয়।

অভিযোগ উঠেছে, নতুন বস্তার টেন্ডারে দর ছিল ৩০ কেজির বস্তা ৬০ টাকা এবং ৫০ কেজির বস্তা ৮০ টাকা। কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাইরে থেকে ১৫-১৬ সালে ব্যবহৃত পুরাতন বস্তা ১০-১২ টাকা দরে কিনে নেয়। আর এসব বস্তা উল্টে স্টেনসিল ব্যবহার ও ক্যালেন্ডার করে নতুন বস্তা হিসেবে সরবারহ করে। বস্তার গায়ে নতুন করে লেখা হয় ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ’।

সংশ্লিষ্ট গুদাম কর্মকর্তারা ওই সব পুরাতন ছেঁড়াফাটা বস্তা গ্রহণের সময় নতুন হিসেবে প্রত্যয়নপত্র দিয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বস্তা প্রতি ১৬- ২০ টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন। এতে মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মোট এক কোটি ৩০ লাখ টাকার ঘুষ বাণিজ্য করে বলে অভিযোগ ওঠে।

এদিকে এই গণবদলির খবর ফাঁস হবার পর খাদ্যবিভাগে ব্যাপক চাঞ্চল্য ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বস্তা কেনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার পরেও অনেকের বিরুদ্ধে এখনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আবার ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকলেও কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারি এমনকি নিরাপত্তা প্রহরীদের গণহারে বদলি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এমনকি জেলা খাদ্য বিভাগ গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি প্রাথমিক তদন্তের দুর্নীতি হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন দিলেও রহস্যজনক কারণে সেই তদন্ত কমিটির দুই পরিদর্শককেও বদলি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কারো কারো ঘাড়ে ঘটনা ফাঁস হওয়ার দায় চাপানো হয়েছে বলে খাদ্য বিভাগের একটি সূত্র জানায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে।’ কারণ এ দুর্নীতির সঙ্গে খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কাজের সম্পর্ক। এর বাইরে অন্যদের কোনো সম্পৃক্ততার সুযোগ নেই। কিন্তু বদলি করা হচ্ছে গণহারে। বাদ যায়নি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিরাও। এতে করে ভুল বার্তা যাচ্ছে সবার কাছে।

(ঢাকাটাইমস/৩১অক্টোবর/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

৫০০ কোটি টাকা হাতানোর চেষ্টা প্রতারক চক্রের, এনএসআই ও পুলিশের যৌথ অভিযানে গ্রেপ্তার ৯

বিল বকেয়ায় সংযোগ বিচ্ছিন্ন, অবৈধ বিদ্যুতে চলছে ইউপি কার্যালয়

কেজি দরে অপরিপক্ব তরমুজ, পিস চাইলে দাম আকাশ ছোঁয়া

লক্ষ্মীপুরে যুবলীগ নেতার চোখ উপড়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা

ফেনী সরকারি কলেজে শিক্ষার্থীদের গণইফতারে ছাত্রলীগের হামলা, আহত ১০

মধ্যরাতে ফের মিয়ানমারের গুলির শব্দে কেঁপে উঠল টেকনাফ সীমান্ত

উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক, দুর্ঘটনা তদন্তে ৪ সদস্যের কমিটি

বরগুনা প্রেসক্লাবের নামে ভুয়া কমিটি গঠনের অভিযোগ 

ঝিনাইদহে বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিকারের অভিযান, ৩ প্রতিষ্ঠানে জরিমানা

যারা ট্রেনে আগুন দেয় তারাই ভাড়া বৃদ্ধির গুজব ছড়ায়: রেলমন্ত্রী

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :