বাংলাদেশের সক্ষমতার মূর্ত প্রতীক পদ্মা সেতু

ড. এ কে আব্দুল মোমেন
| আপডেট : ২৬ জুন ২০২২, ১৩:৪২ | প্রকাশিত : ২৬ জুন ২০২২, ১০:৪০

বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় অবিস্মরণীয় এক নতুন সংযোজন স্বপ্নের পদ্মা সেতু। অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব বিবেচনায় এ সেতু বাংলাদেশের উন্নয়নের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতারও এক উজ্জ্বল নজির পদ্মা সেতু। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে স্থাপিত দেশের দীর্ঘতম এ সেতু এখন বাংলাদেশের গর্ব।

বাংলাদেশের আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থায় এ এক বিস্ময়কর অগ্রগতি। পদ্মা সেতুর স্বপ্নটা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করলেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর হাতেই উদ্বোধনের অপেক্ষায় উচ্ছ্বসিত হয়ে আছে গোটা জাতি। পদ্মা সেতু পাড়ি দেওয়া এখন অপেক্ষা কেবলই সময়ের।

পদ্মা বহুমুখী সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্রই বদলে দেবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবন ও কর্মের ওপর ফেলবে নানা ইতিবাচক প্রভাব। দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখবে। সামগ্রিকভাবে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি করবে। আরও বিশদভাবে বলতে গেলে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের পুরো জীবনযাত্রাই পালটে যাবে।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বহুকাল ধরে কৃষিতে উন্নত। কিন্তু নানা ধরনের কৃষিপণ্যের প্রাচুর্য থাকার পরও সঠিক বাজারজাতকরণের সমস্যায় ভুগত এ অঞ্চলের কৃষি উৎপাদনকারীরা। পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেলে এ অঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য খুব সহজেই ঢাকা হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। সঠিক দামে কৃষিপণ্য বিক্রির সুযোগ বাড়বে কৃষকের।

পদ্মা সেতুর ফলে মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পুরো দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। কোনো বিনিয়োগের ১২ শতাংশ রেট অব রিটার্ন হলে সেটি আদর্শ বিবেচনা করা হয়। এই সেতু হলে বছরে বিনিয়োগের ১৯ শতাংশ করে উঠে আসবে। কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি, শিক্ষা, বাণিজ্যÑ সব ক্ষেত্রেই এই সেতুর ভূমিকা থাকবে বিরাট।

তবে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে এমন একটি সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজটি কোনোভাবেই সহজ ছিল না। বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী উদ্যোগ ও দৃঢ়চেতা মনোবলের কারণেই এমন একটি ব্যয়বহুল প্রকল্প হাতে নেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছে বাংলাদেশ।

বহু বছর বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থা ছিল নদীনির্ভর। নৌপথই ছিল যোগাযোগের প্রধান পথ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর সড়ক যোগাযোগ গুরুত্ব পেতে থাকে। এ ক্ষেত্রেও বাধা ছিল নদ-নদী। যেকোনো সড়ক তৈরি করতে গেলেই ছোট-বড় নদী অতিক্রম করতে হতো। অনেক ফেরি চালু ছিল। ধীরে ধীরে সেই অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুর উদ্বোধন করা হয়। সে সময়েই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের সুবিধার জন্য পদ্মায় সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৯৮ থেকে ২০০০ এই সময়ে পূর্বসম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়। এরপর ২০০১ সালে জাপানিদের সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই হয়।

২০০৪ সালে জুলাই মাসে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সুপারিশ মেনে মাওয়া-জাজিরার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার শপথ নিয়েই তাদের নিয়োগ দেয়। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতু করার চূড়ান্ত নকশা করা হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার অনুসারে বাঙালির স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয় শেখ হাসিনার সরকার।

শুরুতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক, জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়নে এগিয়ে এসেছিল। পরবর্তী পর্যায়ে পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ঘুষ-দুর্নীতির কাল্পনিক অভিযোগে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলারের অঙ্গীকার থেকে সরে যায় এবং একে একে এডিবি, জাইকা, আইডিবিও চলে যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তো হেরে যাওয়ার মতো ব্যক্তিত্ব নন। দৃঢ়কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেন, পদ্মা সেতু হবে, এবং সেটা দেশের নিজস্ব অর্থায়নে। বিভিন্ন দাতা গোষ্ঠীর পশ্চাৎপসরণে সৃষ্টি হওয়া জটিল পরিস্থিতি ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তায় মোকাবিলা করেন বাংলাদেশের উন্নয়নের রূপকার দেশরত্ন শেখ হাসিনা। স্পষ্ট জানিয়ে দেন, বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় নয়, দেশের নিজস্ব অর্থায়নেই হবে আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতু!

১২ ডিসেম্বর ২০১৫, সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে পদ্মা সেতুর মূল অংশের নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনে সেতু ও নদীশাসনের উদ্যোগ গ্রহণ ও কাজ তদারক করার জন্য আন্তর্জাতিক ঠিকাদার নিযুক্ত করেন। ২০১৪ সালে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা দেশের যে দুটি উন্নয়ন প্রকল্পকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেন, তার মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্প একটি। শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় পদ্মা সেতু বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ববাসীর সামনে আজ দৃশ্যমান! এখন শুধু কাক্সিক্ষত সময়ের অপেক্ষা।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন না করার ঘোষণা দেওয়ার পর, জাপান প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। সেটিও একটি সফল কূটনৈতিক কার্যক্রমেরই অংশ।

পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাসমূহের প্রাক্কলন অনুযায়ী পদ্মা সেতু দেশের প্রতি বছর ১ দশমিক ৯ শতাংশ হারে দারিদ্র্য হ্রাসে ভূমিকা রাখবে। পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার ৩১ বছরের মধ্যে জিডিপি ৬ হাজার মিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পাবে এবং ২০৩২ সালের পর বার্ষিক রিটার্ন ৩০০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি উপকূলীয় জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ শক্তিশালী হবে বা অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হবে। ফলে ওই অঞ্চলের কৃষি, যোগাযোগ, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, জীবনমান বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের সার্বিক উন্নয়ন ঘটাবে।

বিসিআইএমের রুটের সঙ্গে কানেক্ট থাকায় আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। পদ্মা সেতু ও উভয় পাড়ের পর্যটন থেকেই প্রতি বছর কয়েক শ কোটি টাকা আয় হবে। পদ্মা সেতু নির্মাণকালীন নদীশাসনের ফলে ১৫৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের ৯ হাজার হেক্টর জমি নদীভাঙন থেকে রেহাই পাবে। পাশাপাশি বন্যার কবল থেকেও রক্ষা পাবে কয়েক লক্ষ মানুষ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে চালু রাখা ফেরি সার্ভিস চালু রাখার প্রয়োজন পড়বে না।

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ায় এ সেতু থেকে আদায়কৃত টোল সম্পূর্ণরূপে সরকার পাবে। ফলে প্রতি বছর সরকারের আয় বাড়বে প্রায় ৪ হাজার মিলিয়ন ডলার। দক্ষিণাঞ্চলের জেলাসমূহের সঙ্গে বিভিন্ন জেলার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ শ্রমের গতিশীলতা বাড়বে। পদ্মা সেতুর সুফল হিসেবে ২ কোটির বেশি বেকারের কর্মসংস্থান ঘটবে বলে আশা করা যাচ্ছে । সেতুর উভয় পাশেই ব্যাপক হারে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ ঘটবে, যা সচল রাখবে দেশের অর্থনীতির চাকা।

পদ্মা সেতুকে ঘিরে পদ্মার দুই পাড়ে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলার বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা করছে সরকার। পদ্মার দুই তীরে আধুনিক নগর গড়ে তোলার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মহলের সঙ্গে এরই মধ্যে পরামর্শ শুরু করেছে সরকার। পদ্মা সেতুকে ঘিরে পর্যটনে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। আধুনিক মানের হোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠবে এখানে। এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হবে, সে ক্ষেত্রেও এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। স্বপ্নের এই সেতুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা খুলনা-যশোর অঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়নের সম্ভাবনা দেখছেন। এর সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি রয়েল বেঙ্গল টাইগার-সমৃদ্ধ সুন্দরবন ও সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের অভাবনীয় সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে বিশাল পর্যটনশিল্প। শিল্পায়ন ও পর্যটনকে কেন্দ্র করে দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে আধুনিক নগরায়ণ। পদ্মাপারে গড়ে উঠবে বিশ্বমানের প্রজাপতি জাদুঘর, সিঙ্গাপুরের আদলে অলিম্পিক ভিলেজ। সেতুর পাশেই ক্রীড়াপল্লি ও অলিম্পিক কমপ্লেক্স নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মার চরে সব রকম সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ক্রীড়াপল্লি নির্মাণসহ সুবিশাল অলিম্পিক কমপ্লেক্স গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে আমাদের ক্রীড়া প্রশিক্ষণ আরও এগিয়ে যাবে।

স্থানীয়রা পদ্মাপারে আধুনিক শহর গড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। এছাড়া সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কারণে বাস্তুচ্যুত ক্ষতিগ্রস্তরা পুনর্বাসনকেন্দ্রগুলোতে আধুনিক শহরের সুবিধা ভোগ করছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণকে আশপাশের এলাকাবাসীর জন্য আশীর্বাদ বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

পদ্মার ওপারে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের ১৬ জেলা, ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, পোপালগঞ্জ জেলাসহ মোট ২১ জেলার ৩ কোটি মানুষ এ সেতুর ফলে সরাসরি উপকৃত হবে। বদলে যাব দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার অর্থনৈতিক চিত্র। এর ফলে বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পদ্মার ওপারে বিনিয়োগের ক্ষেত্র উন্মোচিত হবে। গার্মেন্ট, পাট, হিমায়িত খাদ্য, পর্যটনশিল্পে বিনিয়াগের দুয়ার খুলে যাবে।

পদ্মা সেতুর ওপারে সংযোগ সড়ক থেকে ভাঙ্গা উপজেলা থেকে তিন দিকে তিনটি রাস্তা চলে গেছে। এর একটি বরিশাল, একটি খুলনা অংশে, আরেকটি রাজবাড়ী, যশোর, বেনাপোলে। এ তিনটি সড়ক যুক্ত হবে মোংলা, পায়রা সমুদ্রবন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে। ফলে তিন বন্দর দিয়েই আমদানি পণ্য দ্রুত ঢাকাসহ শিল্পাঞ্চলগুলোয় প্রবেশ করতে পারবে। এতে রপ্তানি পণ্যের লিড টাইম (ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি করে তা দিয়ে পণ্য তৈরির পর রপ্তানি করতে যে সময় লাগে) কমে যাবে। ফলে দ্রুত ব্যবসার রিটার্ন বা মুনাফা পাওয়া যাবে। এতে অর্থের চলাচল বাড়বে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হবে বহুমুখী খাত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের মধ্যে খুলনা বিভাগ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে ৫২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট আমানতের ৬ শতাংশ। ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের সাড়ে ৩ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে মোট আমানতের পরিমাণ সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট আমানতের সাড়ে ৪ শতাংশ। মোট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩ শতাংশ। পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হলে ওপারে বিনিয়াগ বাড়লে ঋণের চাহিদা বাড়বে, তখন ঋণের প্রবাহও বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানসহ অর্থনৈতিক সূচকগুলো বেশি সচল হবে এবং নতুন নতুন খাত যুক্ত হলে মানুষের আয় বাড়বে। তখন সঞ্চয়ও বাড়বে, যা জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়ক হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, পদ্মা সেতু চালু হলে ২০২২ সালে প্রতিদিন গড়ে যানবাহন চলাচল করবে প্রায় ৩৫ হাজার। এ থেকে রাজস্ব^ আয় হবে ৮২২ কোটি টাকা। ২০২৫ সালে যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে ৩৯ হাজারে দাঁড়াবে। রাজস্ব আয় হবে প্রায় হাজার কোটি টাকা। ২০৩০ সালে তা আরও বেড়ে ৫৮ হাজার যানবাহন চলবে। রাজস্ব আয় হবে ১ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। ২০৩৫ সালে তা আরও বেড়ে ৬৬ হাজার যানবাহন এবং রাজস্ব আয় হবে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। এভাবে ২০৫০ সালে যানবাহনের সংখ্যা বাড়বে ৭৬ হাজার। রাজস্ব আয় বাড়বে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় পদ্মা সেতুর সংযোজন শেখ হাসিনা সরকারের এক অবিস্মরণীয় অবদান। সব ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে, নানা মহলের নানা অপচেষ্টা ধূলিসাৎ করে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু সফলতার সঙ্গে স্থাপন করে শেখ হাসিনা দেখিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের শক্তি। বাংলাদেশ আর কারও হাতের দিকে চেয়ে বসে থাকা দেশ নয়। এ দেশ যে এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখে গেছে, পদ্মা সেতু সে কথাই জানিয়ে দিচ্ছে গোটা বিশ্ববাসীকে। এ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিরাট ভূমিকা রাখবে পদ্মা সেতু। দেশের তরুণ সমাজের সামনে উপস্থাপিত হবে এক নতুন বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশের গল্প হবে কেবলই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি। জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে সেই পথেই এগিয়ে চলছে আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ।

পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। আমরা আমাদের পদ্মা সেতু করতে গিয়ে বহু রকমের ষড়যন্ত্র, বহু রকমের বাধার সম্মুখীন হয়েছি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা, রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা না হলে অন্য কেউ সাহস করে পদ্মা সেতুর উদ্যোগটা নিতে পারত না। কারণ, মার্কিন এবং বিশ^ব্যাংকের ষড়যন্ত্রের মূল ছিল পদ্মা সেতু না, মূল ষড়যন্ত্র ছিল শেখ হাসিনা সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলা। এ জন্য যা যা করার দরকার তারা মনে করেছে, তার সবই করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ঘোষণা দিলেন যে, পদ্মা সেতু আমাদের নিজেদের টাকায় হবে, তখন জনগণ অনেক খুশি হয়েছিল। আমি একটা ছোট্ট ঘটনার কথা উল্লেখ করি। তখন নিউ ইয়র্কে থাকি, কাজ করি জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে। আমার গাড়ির চালক, যিনি সারাজীবন চাকরির পর অবসরে গেছেন। তার প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকাই আমার হাতে তুলে দিতে চাইলেন। বললেন, ‘এই টাকা পদ্মা সেতুর ফান্ডে দিয়ে দেন।’ এমন অনেক লোক ছিল, যারা টাকা দিতে চাইলেন। আমি তখন সেই সময়ের অর্থমন্ত্রী আমার বড় ভাই আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে বললাম, ‘কী করব।’ তিনি বললেন, ‘তুমি ফান্ড কালেকশন করো না, আমরা জানাব কী করতে হবে।’

আমরা অনেক ভাগ্যবান জাতি যে, দুর্দিনে শেখ হাসিনার মতো নেতা পেয়েছিলাম। পদ্মা সেতু নিজের টাকায় করে আমরা বিশ^ব্যাংককে দেখিয়েছি, আমরা পারি। তারা যে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছিল, তার জন্য আজ তারা ধিকৃত। তারা যে মিথ্যা অপবাদ দিলো, এর জন্য আমাদের কাছে তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত।

বিশ^ব্যাংক বা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ফান্ড না পাওয়াতে আমাদের একটা সুবিধাও হয়েছে। অন্যান্য অনেক দেশ অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। জাতিসংঘে থাকাকালীন আরেকটা ঘটনার কথা উল্লেখ করি। সরকার আমাকে বলেনি কিছু, তবুও আমি কয়েকটা দেশের কাছে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করলাম। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের বিষয়ে তারা পর্যবেক্ষণ করছিল। আমাকে একটি দেশ বলল, পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করতে পারবে না, তবে অন্য প্রকল্পে দ্বিগুণ সহযোগিতা তারা দিতে চায়।

পদ্মা নদীর তলানিতে পানি অতি জোরালোভাবে প্রবাহিত হওয়া এবং সেখানকার মাটি অত্যন্ত নরম হওয়ার কারণে আমাদের পাইলিং সিস্টেমটা অত্যন্ত স্ট্রং ও টেকনিকালি হ্যান্ডেল করতে হয়েছে। এই সেতু কোনো সাধারণ সেতু না। আমাদের জিডিপির অনেক উন্নতি হবে এ পদ্মা সেতু চাল ুহওয়ার পর। অনেক ষড়যন্ত্রকারী শুধুমাত্র শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় বলে এই সেতু নির্মাণে অনেক বাধা দিয়েছে। কিন্তু আমরা বাধা পেরিয়ে এখন সাফল্য অর্জন করেছি। ষড়যন্ত্রকারীরা শুধু পিছেই পড়ে থাকবে।

শেখ হাসিনা পুরো বিশ্বকে প্রমাণ করে দিয়েছেন, আমরা জাতি হিসেবে কতটা শক্তিশালী। কোভিডের সময়ও তিনি আমাদের দেশের জনগণকে সুরক্ষিত রাখা জন্য সব সম্ভাব্য পদক্ষেপ নিয়েছেন। এনার্জি ক্রাইসিস, ফাইনেনশিয়াল ক্রাইসিস- সব সমস্যা থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা আমাদের দেশকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

শেখ হাসিনা একজন ভিশনারি লিডার। কোভিডের ভ্যাক্সিন দেশে আনার ব্যাপারে তিনি খুবই দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছেন যাতে সবার প্রথম দিকে ভ্যাক্সিন আসে। ধনী-গরিব সবার মাঝে তিনি সমপরিমাণে ভ্যাক্সিন বিতরণ করছেন। বাংলাদেশে এত জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও আমরা মিনিমাম ক্যাসুয়াল্টি মেইনটেইন করেছি। খবুই কম রিসোর্স থাকা নিয়েও আমরা কোভিড পার করতে সক্ষম হয়েছি। শুধু আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বের কল্যাণে।

এই পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী দেখিয়ে দিয়েছেন যে আমরা দুর্বল নই। আমাদের শাসনব্যবস্থা আছে বলেই পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প আমরা করতে পেরেছি। শাসনব্যবস্থা আছে বলেই কোভিডের সময় লক্ষ লক্ষ মানুষের সব ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থাসহ খাদ্য ও সাহায্য দিতে পেরেছি। আমরা চাই সারা বিশ্ব আমাদের সন্বন্ধে ভালো একটা ভিউ রাখুক, জানুক যে আমরা পারি।

পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। যেকোনো উদ্যোগ নিলে তা করে দেখাতে পারিÑ এমন সাহস তৈরি হয়েছে। বিশ্ববাসী বাংলাদেশের সাফল্য দেখেছে। বাংলাদেশকে সহযোগিতার জন্য অন্যান্য দেশ ও উন্নয়ন সংস্থা এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের স্বীকৃতি মিলেছে বিশ্বব্যাপী। তাই বাংলাদেশের নেতৃত্ব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে থাকাই নিরাপদ।

লেখক: পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :