আত্মীয়তা: অটুট হোক সব সুদৃশ্য বন্ধন

ফাহমিন আফরোজ
| আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০২২, ১৩:৫২ | প্রকাশিত : ১৭ অক্টোবর ২০২২, ১৩:১৪

মিসেস সান্তনা আক্তার শান্তি। বয়স চল্লিশোর্ধ। বাসায় যখন কোনো কাজ থাকে না বা স্বামী-সন্তানও বাইরে ব্যস্ত যখন, তখন উনার অতীতের কথা মনে পড়ে যায়। আবার বর্তমানে পরিবারিক বা সাংসারিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি ভাবতে থাকেন। মনের অজান্তেই যেন সব চলে। তিনি কেবল সাথী হয়ে থাকেন এমন ভাব আরকি। তাছাড়া ভবিষ্যতে কিভাবে চলবেন তাও ভাবেন বইকি। স্বামী যেমন ভবিষ্যতের চিন্তায় ছক কেটে চলার চেষ্টা করেন, সন্তান যেমন চাঞ্চল্যকর উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ভবিষ্যতের বহু পরিকল্পনা বলে চলে, তখন তিনি ভাবেন। মিসেস সান্তনা তখন সংসারের লোকদের পরিকল্পনা আর ছকের সফল ও সঠিক বাস্তবয়নের জন্য ভাবেন। তাদের চিন্তা-ভাবনাগুলো যেন নির্ভুল অর্থাৎ সঠিক পথে চলে তার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা এবং সহযোগিতা করেন। তিনিও সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ। তাই অনেক সতর্ক হয়ে সামর্থ্য বজায় রেখে নিজ ভাবনা থেকে মিলেমিশে একাকার হয়ে ভবিষ্যতের পথ পরিষ্কার করে তৈরি করার চেষ্টা করেন।

সান্তনা আক্তার শান্তির নিজস্ব একটি ব্যবসায়িক অংশীদারও আছে। সেটি নিয়েও ভাবেন। কোম্পানিতে বর্তমানে একটা চাকরি করেন। সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন যেতে হয়। বাসায় না হলে সময় দিতে পারেন না, তাই এভাবে ম্যানেজ করে চলেন আরকি। উনার নিজের আরও দুইটা ভাই ও এক বোন আছে। আম্মা ছিল। কিন্তু আব্বা বেশ কয়েক বছর হলো চলে গেছেন আল্লাহর কাছে। পরের বছর আম্মাও চলে গেলেন। স্বামী বড় চাকুরে তাই স্ত্রীর চাকরি পেশা মেনে নিতে পারেন না। কিন্তু স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসেন, তাই রাগ করেন না। ম্যানেজ করেই চলেন। সন্তান একটাই, নিয়ন। ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। আব্বুর মতো ছেলেও প্রাণীভক্ত। খরগোশ আছে ১৫-১৬টা। আছে ৪-৫টা বিড়াল আর আছে ৭-৮টা পাখি। ওগুলোর খাবার যোগাড় করা, খাবার দেওয়া, কোলে তোলা, দৌড় করানো, খাচা ভেঙে গেলে বদলানো, বিছানাতে রাখা আবার আম্মুর বকায় পাজকোলা করে দৌড়ে পালানো।

ছেলের মার সাথে ছেলের আব্বুর একই রকম আচার ব্যবহার। প্রাণীদের খাঁচায় আলাদা ভাবে দুটো বা একটা করে রাখা হয়। খাঁচার জানালা দিয়ে ওসব প্রাণীর জন্য খাবার পরিবেশন করা হয়। কোনোটা হাত বা পা দিয়ে, কোনোটা ঠোঁটে করে খাবার টেনে নেয়। কোনোটা অনেক সময় বেরিয়ে পড়ে। খাঁচার জানালা ভুল করে খোলা থাকলে বা লুস হলে ঠেলে খুলে খাঁচার বাইরে চলে আসে। তখন ঘরময় ছোটাছুটি করে, বিছানায় উঠে পড়ে, এমনকি খাবার টেবিলেও চেয়ার বেয়ে উঠে যায়। বেডরুম, কিচেন, ডাইনিং বা ড্রইংরুম সবই পশুপাখিরা চিনে গেছে। ওদের বর্জ্য পরিষ্কার করার জন্য আলাদা সার্ভেন্ট রাখতে হয়। কাজের লোক আছে দুই থেকে চারজন। দুজন বড় তাদের দুটো বাচ্চা ছোট। একটি মেয়ে, একটি ছেলে। ৫ থেকে ৭ বছর বয়স। কাজের বুয়া দুজন বাসার কাজ সেরে পশুপাখি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। প্রতিটি খরগোশ, গিনিপিগ, বিড়াল এবং পাখির নাম আছে পৃথক পৃথক। সান্তনা আক্তারকেই নাম দিতে হয়। নিয়নের আবার আব্বু নাম না রাখলে হবে না।

মাঝে মাঝে প্রাণীদের বাচ্চা হয়। কোনোটা বড় হয়, কোনোটা আবার বাঁচে না। খরগোশ আর গিনিপিগের বাচ্চা বড় করে তারা শাহবাগ পশুবিতানে বিক্রি করে। নিয়ন আর তার আব্বু বাচ্চার তদারক করেন। কোনোটা সবল আছে, কোনোটা আবার দুর্বল। পশু হাসপাতালে ৪-৫ হাজার টাকা করে হলেও অসুস্থ শাবকদের গাড়ি দিয়ে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। প্রথমে সান্তনা আক্তার শান্তিই দুটো করে প্রাণী এনেছিলেন দোকান থেকে। ভেবেছিলেন বাসায় মাত্র তিনজন উনার, অবসর সময়ে বাচ্চাটা ওদের নিয়ে খেলা করতে পারবে। তা থেকে আজ ওনাদের বাসায় এই মিনি চিড়িয়াখানা। তার হাজব্যান্ড মিস্টার স্বদেশজন খান এই পশু পালনাগারের নামকরণ করেন ‘স্নেহভাজন আশ্রয় কেন্দ্র’।

আসলে সান্তনা দেখলেন দিন দিন পশুপাখি বেড়ে চলেছে, তাই সকল পশুই বিক্রি করতে চলছিলেন। কিন্তু মিস্টার স্বদেশজনের এদের প্রতি এত বেশি স্নেহ, মায়া, মমতা এসে গেল যে কিছুতেই রাজি হননি এগুলো পরিত্যাগ করতে। উনাদের একটা ফ্যামিলি লাউডরুম আছে, সেটাতে তিনি স্নেহভাজন আশ্রয়কেন্দ্র নাম দিয়ে বাধাই করে দিলেন ঘরের বড় কাচের দরজার সামনে। ভেতরে খাঁচায় খাঁচায় সাজানো তারা। দরজা বন্ধ থাকলে আওয়াজ আসে না, তবে একটু ফাঁক থাকলেই গিনিপিগের মিষ্টি স্বরের গান, বিড়ালের বাচ্চাদের কঠোর চিল্লাপাল্লা আর পাখিদের কলকাকলি, সুরেলা গান কানে আসে। খরগোশ সব শান্তশিষ্ট, কোনো শব্দই যেন করতে জানে না। স্বদেশজন সাহেব বেশ আনন্দেই সময় কাটান ওদের সাথে। চাকরি থেকে ফিরেই প্রাণীগুলো খোলা কিনা, সবার প্রয়োজন মতো খাবার আছে তো- এসব খবর নেন। কোনো খাঁচা পরিষ্কার না থাকলে শোরগোল করে তৎক্ষণাৎ পরিষ্কার করান, আবার খাবার দেন। অনলাইনে খাবার আসে। আশপাশের বাজার থেকে আসে, আবার ঘরের খাবারও বেঁচে গেলে দেওয়া হয়। খরগোশ, গিনিপিগ, বিড়াল, পাখি সকলের জন্য আলাদা প্রকারের খাবার।

ছেলেটা দিনে বেশি সময় পায় না। পড়ালেখা থাকে। বাসায় টিচার আসেন। বাইরে ভার্সিটিতে পড়তে চলে যায়। তাই রাতে খাওয়াদাওয়ার পর যতক্ষণ জেগে থাকে ওদের নিয়েই ব্যস্ত। ওদের খবরাখবর আম্মু-আব্বুকে দেয়। আম্মু শোনে, আবার কখনো সাড়া দেয় না। কিন্তু আব্বু শোনামাত্র রিঅ্যাক্ট করে। নতুন খাঁচা লাগবে বললেই এনে দেয়। বিড়াল এই ব্র্যান্ডের খাবার খায় না, বা রিয়ো ব্র্যান্ডের কোনটা দিব। খরগোশের ফল বা শাক বেশি করে লাগবে, তাই দিব। পাখি খাবার নষ্ট করে রেখেছে ঠিক আছে এখনই পরিষ্কার করিয়ে দিচ্ছি। গিনিপিগ পুরা ৩০ সেকেন্ড গান করছে, বাহ বেশ মজা তো। বাবা ছেলেতে এই সব আলোচনা কতক্ষণ চলে। মা মাঝখানে বলে বুঝেছি, তোমরা দুজনে লিস্টটা করে দাও। ওসব ব্যবস্থা তো আমাকেই নিতে হবে। তোমরা একটু থামো, আরও কত দরকারি কথা আছে। কত ইম্পরটেন্ট কাজ পড়ে আছে, সেসবও সবাইকে মানতে হবে, করে নিতে হবে, ওসব কিছুও কি বলো সবাই?

নিয়ন বলবে, আম্মু আমি তো খেয়ে নিয়েছি, টিচারের কাছে পড়াও তৈরি করে রেখেছি। আমার এখন কোনো কাজ নেই। আব্বু বলে, ছেলে তো বড় হয়ে যাচ্ছে, পড়া শেষ করে চাকরি করবে ভালো। আবার ভালো একটা বিয়েও দিতে হবে। নিয়ন লজ্জা পায়, মুখে কিছু বলে না। তার মুখ চেপে বলে, আমি তো আরও অনেক পড়াশোনা করব, অনেক দেরিতে বিয়ে করব। তোমরা এখন ওসব চিন্তা করো না। নিয়ন একটু ভাবে তারপর বলে, আমি তো আমার বন্ধুদের মতো পড়াশোনার ফাঁকে চাকরিও করতে পারি। শুধু তোমরা দাও না বলে। আমার বন্ধুদের আব্বু-আম্মুও তো ভালো চাকরি করে। কিন্তু ছেলে-মেয়েদের চাকরিতেও বাধা দেয় না। তারা শখ করে চাকরি করে।

আব্বু বলে ফিহু, রুবা ওরা তো কিছু করে না। নিয়ন বলে, না আব্বু রুবা একটি ফার্মে নতুন জয়েন করেছে, আর ফিহুও বলছে কোচিং সেন্টারে পড়াবে। আম্মু বলে থাক বাবা নিয়ন, ওদের আরও ভাইবোন আছে, কিন্তু তুমি তো একা। সারা দিন-রাত ব্যস্ত থাকলে বাসা তো খালি খালি হয়ে থাকবে। লক্ষী ছেলে না তুমি, আরও পড়াশোনা শেষ করে আব্বুর মত বড় চাকরি করবে, আম্মুর মতো বিজনেস শেয়ারিং করবে। তখন তুমিই তোমাদের সব বন্ধুদের থেকেও ব্যস্ত বেশি থাকবে। তোমার কিছু লাগবে, কাপড়, সেন্ডেল, সুজ বা পড়াশোনার জন্য নতুন মডেলের ল্যাপটপ, ক্যালকুলেটর যা লাগবে তোমার আব্বু বা আম্মুকে সাথে সাথে বলে দিও। সব এসে যাবে। নিয়ন বলে, তা তো আমি জানি। আব্বু বলে খাবারদাবার কিছু লাগবে তোমার পছন্দের? বলে, না আম্মু আমার পছন্দের খাবারই দেয়। তুমিও কত সময় দিনে বা রাতে বাসায় ফেরার সময় কিনে নিয়ে আসছো, ওসব কিছু আর নতুন করে লাগবে না। হাতখরচও যথেষ্ট বেঁচে থাকে আমার পকেটে। এসব নিয়ে তোমরা চিন্তা করো না। এভাবে হেসে খেলে মিসেস সান্তনার সংসার চলছে।

সান্তনা খেয়াল করেছে, সকাল ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত তিনি একা। বাসায় ছেলে বা স্বামী কেউ থাকে না। তিনি যেদিন বাইরে না যেয়ে বাসায় থাকেন অর্থাৎ, বাইরে যাওয়ার হয়তো সময় হয় না, একা হয়ে যান। সেই সময়টা হঠাৎ উনার নিজের আম্মার কথা মনে পড়ে। আব্বার কথা, ভাইবোনদের, আত্মীয়দের কথা মনে পড়ে। আম্মা তাদের ভাইবোনদের কত না যত্নের দৃষ্টি দিয়ে বড় করেছেন। তারা দুই ভাই দুই বোন। তিনি সকলের ছোট। আম্মা-আব্বা আর তারা চার ভাইবোন একসাথে একদিন নানাবাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে। তখন নৌকা চলতো নদীতে। নৌকা করে তারা নদী পার হতো, তারপর বাসে উঠে সোজা নানাবাড়ি। আব্বা একটু ভাবুক ছিলেন। নদীতে নৌকা রিজার্ভ করে নিতেন। বসে বসে যেতেন আর মাঝি উনার সঙ্গী থাকতো। আম্মা আমাদের চার ভাইবোনদের সজাগ দৃষ্টি নিয়ে নৌকা পার করতেন। আমরা সবাই ৮ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ, বয়সের ফারাকটা আমাদের খুবই কম। একে অপরের পিঠাপিঠি ভাইবোন। বড় দুজন শান্ত, ছোট দুজন চঞ্চল। নৌকায় বড়-ছোট সবাই চঞ্চল। আব্বা থাকেন একপাশে সরে। তাই সবাই ছাড়া পাই। নদীপথও অনেকটা ওই পদের। তারপর বাসে উঠতে হয়। বড় ভাইবোন নদীর বুকে দুহাত দিয়ে পানি থেকে মাছ ধরায় ব্যস্ত থাকে। একবার বুঝি চুনা নাকি বড় মাছ ধরেও ছিল তারা। আম্মা বোধহয় আব্বার সাথে নদী পার হতে কতদূর পথ বাকি জিজ্ঞাসা করতে গেছে, সেই ফাঁকে এটা করেছিল। আম্মা সেখান থেকে দেখতে পেয়েই হড়হড় পা ফেলে নৌকার এক পাশে, যে পাশে আবু ভাইয়া ছিল এসে তাদের হাত ধরে এমন জোরে দেয় ঝাকুনি যে মাছ পানি সব একাকার। ভয়ে জড়োসড়ো ওরা।

একবার তো আমার ইমিডিয়েট বড়টা নৌকার ঠার ধরে এমন ঝাঁকুনি দিল যে নিজেই উল্টে পড়ে যায় আরকি। আম্মু আমাদের জন্য বক্স থেকে আইসক্রিম দিচ্ছিল, সেই সময়টা আরকি। আম্মু বক্সটা তাড়াতাড়ি পাশে ঠেলে ফেলে যেন ঝাঁপ দিল আরকি এভাবে ছোঁ মেরে ওকে কোলে নিয়ে নদীতে পড়ে যাবার মাঝপথ থেকে বাঁচিয়ে দিল আরকি। অন্যরা কেউ দেখিনি কিন্তু আম্মুর সেই তীক্ষ্ন সজাগ দৃষ্টি সারাক্ষণ আমাদের পাহারা দিত যেন। আসলে আব্বা চাকরি করে আমাদের পড়ালেখা শিখিয়েছেন, বড় করেছেন কিন্তু আম্মা হয়তো সেভাবে কিছু করেনি। মাঝে মাঝে বই বা চাল আগে থেকে কিনে রেখে পরে কোনো দোকানে পাঠিয়ে বিক্রি করা হতো। যেটা কিনা আম্মার জমানো টাকায় হতো। আম্মার ছোটখাটো বিজনেস আরকি। কিন্তু আম্মা হয়তো আব্বার মতো করে আমাদের জন্য টাকা পয়সা খরচ করতে পারেননি, তবে এই যে আমাদের এত যত্ন নিয়ে সদা সতর্ক থেকে বড় করে তোলা সেটা আম্মা ছাড়া সম্ভব নয়।

বুঝি আমাদের সকল মায়েদের ক্ষেত্রেই এই কথাটা চিরসত্য। নিজের স্বামী-সন্তানদের জন্য উনাদের অবদান যুগে যুগে অতুলনীয়। ছোটবেলায় হয়তো বুঝতাম না, কিন্তু এ বয়সে নিজের সন্তানকে বড় করতে করতে এ সত্যটাই যেন খট করে বেজে ওঠে আমার মধ্যে। নানা-নানুদের পেয়েছি, খালা-মামাদের নিয়ে কত রকম মজা আনন্দ হৈ চৈ করেছি। আম্মা আবার সবাইকে নিয়ে সেখানে শিশুপার্কসহ নানা জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যেত। এতসব আনন্দ আম্মার জন্য পেয়েছি শুধু তা বলছি না। কিন্তু কতটা কেয়ার করে প্রায় ফি বছর কয়েকবারেই নানা-নানুর বাড়িতে নিতেন নদীতে যেন না পড়ি, কোনো ব্যথা না পাই, গাড়ি দিয়ে কোনো এক্সিডেন্ট যেন না ঘটে বা গাড়িতে উঠতে নামতে যেন পড়ে না যাই, খেলতে গিয়ে ব্যথা বেদনা না পাই সবদিকেই আম্মার কত না যত্ন, খেয়াল, সজাগ দৃষ্টি। নিজেদের তো ছোট বলে একা একা ততটা চলা সম্ভব হতো না, আম্মার জন্যই পেরেছি। আব্বা খরচপাতি করে নিতেনই কিন্তু হাত পা শরীর নাক মুখ দাঁত ঠোঁট অক্ষত রেখে এত বড় হতে পেরেছি আম্মার মমতা মাখানো দেখাশোনার জন্য। ছোটবেলা থেকে দাদা-দাদু নেই আরকি। কিন্তু চাচা ফুফু নিয়ে এক বাসাতেই বড় হয়েছি। আব্বাদের একটা বিজনেস ছিল। সে সময়ে খুব নাম ছিল। দেশ ছেড়ে বিদেশে ছড়িয়ে ছিল সেই নাম। ব্যবসা এখনো আছে তবে এখন আরও অনেক বড় হয়েছে। নামও নাকি হয়েছে। কিন্তু এ বয়সে আগে যে নাম ছিল তেমনই নাম আছে মনে হয় আরকি।

আসলে বয়স বাড়ার সাথে মানুষের ইচ্ছা, অভ্যাস, আবেগ বা অনুভূতি এবং রুচিও পরিবর্তনশীল। ভাড়া দেওয়া হয় ওটা। মোটা টাকা বছরে পাওয়া যায় ব্যবসাটা থেকে আরকি। চাচা ফুফুদের কবে বিয়ে হয়েছে, কেউ বিদেশেও আছে। কেউ বা বেঁচে নেই আরকি। খালা মামাদের মতই অনেকটা দেশে-বিদেশে রয়েছে কেউ কেউ। আত্মীয়-স্বজনরা পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। বছরে বা পাঁচ বছরেও কারও কারও সাথে দেখা হয় কিনা সন্দেহ আছে। তাদের নাতি-নাতনিদের সাথে আবার নিজেদের মধ্যেও কারও বিয়ে হয়েছে। ওই অনুষ্ঠান পর্বেই একটু আধটু সকলে একত্রিত হওয়া, দেখা আলাপ হয় এই আরকি। দূরে কখনো বা পর্যটকদের মত বেড়াতে যাওয়া হয় যশোর, কক্সবাজার, কোয়াকাটা, জাফলং, পদ্মাসেতু, সিলেট ইত্যাদি নানা স্থানে।

নিয়ন তার আব্বু আর আমি আমরা প্লেনে করে বা নিজেদের গাড়িতে যাই। তখন যেসব স্থানে কোনো আত্মীয় বা পরিচিতদের কেউ থাকলে কিছুটা সময় বের করে হয়তো যাওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে জানাও থাকে না ওখানে কোনো আত্মীয় থাকেন। পরে কখনো জানলে পক্ষদ্বয়ের আফসোস করাটাই থাকে আরকি।

এদিকে ছেলেটি একা একাই বড় হচ্ছে। ওর তো কোনো ভাইবোন নেই। বাবা-মায়ের কি খেয়াল। একটাই সন্তান থাকল তাদের। আল্লাহর কাছে লাখ কোটি অগণিত শোকর আদায় করেন উনারা ওই একটি মাত্র সন্তানের জন্য। ছেলেটি যেন আল্লাহর রহমতে মায়ের মনের মত মানুষ হতে পারে। আজকাল ছেলে-মেয়েরা কত বেয়াদবও হয়, মা-বাবার সাথে ঝগড়া এমনকি হাতাহাতিও মৃদু করে থাকে। ওদের নিয়ন ছেলেটা সেরকমটি না করে। আব্বু-আম্মুর কথা যেন সবসময় শুনে চলে। তাহলেই আসলে সন্তানেরা সত্যিকার অর্থে মানুষের মত মানুষ হয়ে ওঠে। তাই উনারা অনেক পরিমাণ করে মাপজোক করে চলেন, যেন একমাত্র ছেলে ঠিকঠাকভাবে বড় হয়। এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে, একসময় পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরিবাকরি করবে, বিয়ে থা করে ভবিষ্যত গড়বে। অন্য সকল বাবা-মায়ের মত ওনাদেরও এমনটাই আশা আরকি।

নিয়ন সঙ্গী সাথী তেমন পায় না। বাসায় একগাদা বিড়াল, খরগোশ আছে, দু-চারটা গিনিপিগ আবার কয়েকটা পাখিও আছে। ওদের নিয়ে তার অবসর কাটে। এপার্টমেন্টে থাকে, তাই অন্য বন্ধুদের মত বাগানটাগান নাই। আম্মু টবে কিছু ফুল ফল সবজি করেছেন, তিনিই ওসব যত্ন করেন। নিয়নের ফ্রেন্ড আছে অ্যামি। সম্ভবত তার সবচেয়ে কাছেরজন আরকি। সব বন্ধুরা ওর বাসায় গিয়েছিল। নিয়ন ওর কথাই তার আম্মু-আব্বুর কাছে আড়াল করে রাখে। তাদের বাসায় মাছের বড় একুরিয়াম ছিল গেটের ভেতরে ঢোকার পথে। সুন্দর সুন্দর লাল-নীল-সাদা-কমলায় মিশানো সব বিদেশি মাছ। এ্যানি হাত দেয় ছুঁয়ে ছুঁয়ে মাছের নাম বলে বলে তাদের চিনিয়েছিল। মেয়েটা নিয়নের প্রতি একটু বেশি আগ্রহ দেখায়। তাকেই যেন বাসায় ঢুকাচ্ছে সবার ছলে তার সাথে গল্প করছে আরকি।

এ্যানিদের বাসার মাটিও ঘাসের মিশ্রণে টিলা পাহাড়ের মত করা আছে। তার ওপর কেমন লাউ, পুঁইশাক, ছিম, পেঁপে, টমেটো এসবের গাছ হয়ে আছে। যেন টিলা বেয়ে গাছগুলো উঁচু থেকে নিচু ভূমিতে এসে মিশেছে। দারুণ ব্যাপার একটা। যেন পানি আর উঁচু ভূমি একাকার হয়ে গেছে। সকল বন্ধুদের মনে হলো নাকি নিয়নের একাই এমনটা লাগল নিয়ন নিজেই সেটা বুঝতে পারল না। এ্যানিকে তখন নিয়নের কাছে জিজ্ঞেসের মত লাগছিল। নিয়ন এসেছে এ্যানিও বোধহয় প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাই প্রথমে হকবাক হয়ে তার দিকে যেন নিবিষচিত্তে তাকিয়ে ছিল। আসলে আগে সে কোনো ফ্রেন্ডের বাসায় যায়নি। সিয়াম, ফিহু, রুবা তারা এসে আন্টির সাথে কথা বলছে কিন্তু এ্যানি নিয়নকে ছাড়ছে না। ওর সাথে পটপট করে কথা বলেই চলেছে, বলেই চলেছে। যেন ওর মা-বাবার দিকে ভালোভাবে দেখতেই পারছে না আরকি। তবে তার ওই ফ্রেন্ডের বাসায় ফুলের গাছ যেন দেখা গেল না। ওটা নিয়ন তার আম্মুর টবেই যেন উজ্জ্বলতার ভাবে দেখে আসছে। নিয়ন তাদের বাসার পশুপাখি ফুল ফল খুবই ভালোবাসে। সে পানি দেয় ওই টব বাগানে।

কিন্তু পরিমাণ করে দিতে হবে তাই ততটা সাহস পায় না। আম্মু আবার রাগ হতে পারেন, একবার পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচের কাছে এতটা পানি দিয়েছিল যেন বন্যা প্লাবিত হয়ে সবই গোড়া থেকে উঠে গেল। আম্মুর সেকি মন খারাপ, তাই এতটা আর করতে যায় না। ছোট-বড় গাছ আছে, একটা ঝাড়ও আছে। আম্মু, কোনো কোনো সময় আব্বুও ওদের গাছে পানি ঢালে। সে অনেক সময় টবের বাগানের ফুল তুলে ড্রইং রুমে রাখে। আম্মু হেসেই ফেলে বলে, মেয়ে হলে করত এখন ছেলেটাই আমার এ কাজ করছে। নিয়ন ফল পছন্দই করে না। তাদের স্ট্রবেরি ফল গাছ আছে। পেঁয়ারা বা স্ট্রবেরি ফলে গাছ ভরে থাকে। কিন্তু নিয়ন খেতে পারে না তাই বেশি কাছেও যায় না। গোলাপ, লাল, সাদা, গোলাপি রঙের, গাদা ফুল, বেলি, রজনীগন্ধা, জুঁই, হাসনাহেনা, চাপা, জবা এসব ফুলের গাছ আছে। কোনোটা তাজা আবার কোনোটা মেন্দা হয়ে থাকে। বেলকনি আর ড্রইং রুমের জানালায় ওরা ফুটে আছে। ঘরের কার্নিশেও সবজি পাতার গাছ লাগানো আছে। বুয়া আর তাদের বাচ্চারাই বেশি দেখভাল করে। গাছ গাছড়ার দায়িত্বটা ওদের ওপরই বেশি পড়ে আছে।

ছেলেটা এভাবে বেড়ে উঠেছে। অন্য ভাই বা বোন থাকলে কেমন হত তা বুঝে না একদম। নিয়ন যখন তার আম্মুর থেকে খালা বাবা মামাদের গল্প শোনে, আম্মুর যে নিজের ভাইবোনদের প্রতি অনেক দরদ, টান যা স্বাভাবিক সে বেশি বুঝতে পারে না বা চায় না। ভাবে সন্তানদের প্রতিই দরদ থাকে শুধু। তাদের প্রতিও ওর দরদ আছে। মাঝে মাঝে নিজেও জিজ্ঞেস করে কিন্তু দেখাটা বেশি হয় না। একটি ফুফু আছে বিদেশে থাকে। তাই চেনেও না যেন। দেশেও ওর আত্মীয়রা সব। কেউ আলাদা আলাদা বিভাগে থাকেন, সবারই সন্তান আছে, বড় হয়েছে। তাই যাওয়াও কম, দেখাটাও কম পড়ে আরকি। ছোটবেলায় আরও বেশি দেখা হতো, তখন খেলত ওই ভাইবোনদের সাথে। কিন্তু এখন যোগাযোগ কম। তাই সেও ভুলে গেছে। যেন ভুলো মন আরকি।

আমি যেন অবাকই হয়ে যাই অনেক সময়। এটি আশ্চর্য। আমরাও ছোট থেকে বড় হয়েছি। কিন্তু বুঝেছি খালা, মামা, ফুফু. চাচাদের দিকে বাবা-মায়ের দরদ থাকা স্বাভাবিক। আম্মু-আব্বুর মতোই তো তাদের দিকেও মনটা থাকার কথা। তাদের তো সেরকমই লাগে। অথচ নিয়নেরই এরকম মনে হয়। ভাইবোনদের মধ্যে ছোটবেলার মত ভুল বোঝাবুঝি, সামান্য কথা কাটাকাটি হলেও আবার পূর্বের মত মিল থাকবে, একসাথে এক বাড়িতে একই পরিবারে থেকে বড় হয়েছে, তাই তাদের মনের সহজাত বন্ধনটা যে ছোট থেকে বড়বেলা পর্যন্ত সবসময় আগের মত থাকবে সেটা বেশি বুঝতে চায় না। নিয়ন তার আব্বু-আম্মুর একমাত্র সন্তান তো, তাই মনে করে আম্মু বা আম্মুর অন্য ভাইবোনদের প্রতি টান কম। আবার কখনো বলে টানটা একটু বেশি, অর্থাৎ তার মন খারাপ থাকলে বা রাগ করলে এমন বলে। অথচ সম্পর্কটা তো আব্বু-আম্মু বা সন্তানের মত ভাইবোনদের সাথে একই থাকে, মরিচা পড়ে না। সন্তান আর আম্মু-আব্বু নিয়েই তো একটি সংসার, একটি পরিবার, যা চিরন্তন সত্য এবং এর সমকক্ষ অন্যকিছু আপাতদৃষ্টিতে নেই। কিন্তু বৃহত্তরভাবে তারা সকলেই আত্মীয়তার বন্ধনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দূরসম্পর্কের আত্মীয়, নিকট আত্মীয়, কাছের আত্মীয় পরিজন এভাবেই রিলেশনশিপ থাকে।

নিয়ন শুধু কিনশিপ বলতে নিজের পরিবার বুঝলে হবে না। তাকে আক্ষরিকভাবে আত্মীয়তার সকল সম্পর্কের ব্যাপারেই পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে। তাকে সান্তনার ভালোভাবে বুঝিয়ে শেখাতে হবে। সান্তনাকে তার পরিবারসহ টিভি চ্যানেলে ডেকেছিল। তাদের স্নেহভাজন কেন্দ্র অর্থাৎ, পশুপাখি আর টবের বাগানের ছবি, ভিডিও করে দেখানো হয়েছিল। এর জন্য স্বদেশজন খান তাদের পুরো ফ্ল্যাটটা রঙ করিয়েছেন, ফার্নিচার বার্নিশ করিয়েছেন, নতুন নতুন আসবাবপত্র এবং ফ্ল্যাটের চলাচল ব্যবস্থার নতুনত্ব ঘটিয়েছেন কিছু। আসলে প্রাণী পালন আর বাড়ির মডেল চেঞ্জ, এসব ফ্ল্যাটের সোসাইটি থেকে অনুমোদন ছাড়া হয় না। তবু অনুরোধ করে মিস্টার স্বদেশজন তার বাসায় এগুলো করে রেখেছেন আরকি। একটি বিশেষ টিভি চ্যানেল মিস্টার স্বদেশজনতে তার চাকরিক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করায় অ্যাওয়ার্ড দিয়েছে। তখন পারিবারিকভাবে ওনাকে ডেকে নেয় চ্যানেলটি। শীতকাল ছিল, সকাল ১০টার দিকে তাদের অনুষ্ঠানটি সরাসরি দেখানো হয় সারাদেশে। সান্তনার বোন বিদেশে থেকে একটা দামি ত্রিকোণ শীতকালীন শাল বা চাদর গিফট করেছিল। সেটা পরেই সান্তনা গিয়েছিল হাজব্যান্ড আর পুত্রের সাথে। সেখানে তাদের বাড়িঘর অর্থাৎ প্রাণীদের আর বাগান দেখানো হয়। ওগুলো বাসাময় সর্বত্রই ছিল, তাই পুরো বাড়িটাই টিভি কাস্ট করে। কথার ফাঁকে ফাঁকে এগুলোর ছবি, ভিডিও এসব দেখানো হয়। সঞ্চালক বা উপস্থাপক বেশ হাসিখুশি একজন লোক। তাদের সবাইকে সমান সম্মানে ফুলের তোড়া দিয়ে অনুষ্ঠানে বরণ করা হয়। স্বদেশজনকে প্রশ্ন করা হলেও সোফায় তার পাশে নিয়ন এবং সান্তনাকেও প্রশ্ন করে। অনেকক্ষণ আলাপ চলে। ওরা অনুষ্ঠান শুরু আগে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিল টিভি চ্যানেলের একটি রুমে। সম্ভবত ষষ্ঠতলায় অনুষ্ঠান। লিফ্ট না থাকায় হেটেই উঠেছিল ওরা। অভ্যাস নেই, ফ্ল্যাটে লিফট দিয়ে উঠানামা করে। তবে তখন তাদের ব্যাপারটা সয়ে গিয়েছিল প্রোগ্রাম করার আনন্দে। তা ওই রুমে বসিয়ে তাদের চা কেক দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। চা-টা খাওয়া হয় কিন্তু কেকটা খেতে পারেনি। ওখানকার একজন ওয়ার্কার ইশারায় দেখায় যে ওই অবস্থানে বেশি খেতে নেই। তাই মুখে দিতে নিয়েও ওরা সেটা রেখে দেয়।

যাহোক, উপস্থাপক এসে গেল। বয়সটা একটু কম। নিয়নের থেকে কয়েক বছরের বড় হতে পারে। আমরা প্রোগ্রাম রুমে ঢুকে গেলাম। একটি টেবিল, চারপাশে সোফা, চারজন বসে গেলাম। একপাশে চেয়ার পাতা, যেখানে হয়তো সাথে কেউ থাকলে অনুষ্ঠানে অংশ না নিলেও বসে অপেক্ষা করতে পারে। তার একটু সামনেই মঞ্চ সাজানো। এই অনুষ্ঠানটা সন্ধ্যায় করলে সেটা অন্য রুমে রিলে করা হতো। দুজন ক্যামেরাম্যান। বিশাল লম্বা লম্বা মই আকৃতির ক্যামেরা, সেটের পেছনের দিকে পাশেই অন্য রুম। কাচের পার্টিশান দেওয়া। ছাদ পর্যন্ত ছোঁয়নি। আধাআধি পার্টিশান। ইচ্ছে হলে কথা বলা চলে। তবে নিজেরা রুমে কথা বললে পাশের রুমে শোনা যাবে না। রুমে চেয়ার পাতার পাশে একটা টিভিও আছে। টিভিটা পাশাপাশি রুম দুটোই দেখতে পায় আরকি। ওই রুমে ফোন আছে তবে আমাদের সোফার টেবিলের ওপরও ফোন রাখা আছে। অনুষ্ঠান চলছে। ফোন আসার ব্যবস্থা আছে। দর্শক ফোন করতে পারে। দু’একটা ফোন আসছে। ওরা সকলে এবং উপস্থাপক এসব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল। তবে ম্যাক্সিমাম প্রশ্ন নিয়নের আব্বুর জন্যই এসেছে।

সান্তনা দেখল দুজন ক্যামেরাম্যানের মধ্যে একজন একটু চলে গেল। স্বদেশজন ওদের সবাইকে চেনে দেখা গেল। আগেও দু-চারবার এসেছে অন্য কোনো অনুষ্ঠানে। সেইক্ষণে একটা ফোন পাশের রুমে আসে। একটু পর আমাদের টেবিলে সম্ভবত ওই ফোনই প্যারালাল সিস্টেমে কোনোভাবে এলো। উপস্থাপক টেবিলের ফোন ধরলে যথারীতি প্রশ্ন এলো, উত্তরও দেওয়া হলো। নিয়নের আম্মু ভাবে বাইরে থেকে এই প্রথম কোনো অনুষ্ঠানে সে এসেছে সিস্টেমটা তাই লক্ষ্য করছিল আরকি। ইতোমধ্যে ক্যামেরাম্যান ফিরে এসে ক্যামেরা ঘোরানো শুরু করল আগের মতো। সান্তনার কেবল মনে হতে লাগল এই লোকই কি এইমাত্র লাস্টের প্রশ্নটা করে ফিরে এলো। কেমন যেন হাবভাব মিলে যায়। যাক এসব টেলিভিশনের ব্যাপার এত বেশি বুঝে দরকার নেই তার। আর আগ্রহ নিয়ে উনার দিকে তাকাল না। কিছুক্ষণ পর অপর ক্যামেরাম্যান রুমের ভেতরের টিভির কাছে গেল। টিভি চালু কিন্তু কোনো সাউন্ড নেই আরকি। বন্ধ করা ছিল। ছবি অর্থাৎ আমাদের সবার ছবিগুলো দেখা যাচ্ছিল। যদিও বেশি তাকানোর ‍উপায় নেই তবুও একটু আধটু দেখছিলাম আরকি। দ্বিতীয় ক্যামেরাম্যান লোকটি টিভির নব ঘোরাল আর সাথে সাথে টিভিতে একটুখানি ডিস্টার্ব হলো ন্যাচারালি। আমরা বাসায় টিভি দেখলে যেমন দেখে থাকি আরকি। তারপর সাথে সাথেই আবার টিভি পূর্বের মত চলছে সাউন্ডহীন দৃশ্যপট। বুঝতে পারছি না বাসার টিভিতেও কি সকলের রুমে ড্রইংরুমে টেলিভিশন আছে, সেগুলোও একই সাথে ডিস্টার্ব হয়েছিল নাকি। দুটো ঘটনাই হয়তো কাকতালীয়, যা দুজন ক্যামেরাম্যান মারফত ঘটতে পারে ভেবেছিল সান্তনা।

থাক ওসব টিভি চ্যানেলের ব্যাপার আমার অত বুঝে বা ভেবে কাজ নেই কোনো আরকি। নিয়নকে তার লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এসব জিজ্ঞেস করা হয়। সান্তনাকে ঘরবাড়ি ‘স্নেহভাজন প্রাণী’র সম্পর্কের আর টব বাগান সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। রান্নার আগ্রহ আর তার অংশীদারিত্বের সেই ব্যবসায়িক পরিচালনা নিয়ে পরিকল্পনা ইত্যাদি জিজ্ঞেস করা হয়। আর মিস্টার স্বদেশজন খানকে ওনার অফিসিয়াল সাকসেস, তার পেছনে কার অবদান এসব জিজ্ঞেস করা হয়। ভবিষ্যতে চাকরিস্থলে আর কী অবদান রাখতে পারেন, এসব করে দেশের বাইরে তার প্রতিষ্ঠান কতটুকু সম্মান সুনাম কুড়িয়েছে ইত্যাদি। ওনাাকে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে পুরস্কার গ্রহণের জন্যও সপরিবারে আমন্ত্রণ করা হয় ওই চ্যানেল থেকে। তারা বর্তমানে প্রস্তুতি নিচ্ছে বিদেশে যাবার জন্য। কেউ আবার বিদেশে থেকে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ করেছে। তবে খান সাহেবের বিদেশে বাসস্থান করার তেমন আগ্রহ কম। তাহলে তো বিয়ের পরই সস্ত্রীক চলে যেতে পারতেন কোনো দেশে। কিন্তু তখন যাননি। এখন ছেলে বড় হয়েছে। পড়াশোনা করছে। আপাতত তিনি দেশেই ফিরবেন। শুধু সবাই মিলে ১০ দিনের জন্য বিদেশে যাবে আরকি। তবু স্বদেশজন তার ছেলে স্ত্রীর সঙ্গে একটা প্লান করে রেখেছেন। এখন থেকে মাঝে মাঝে দেশের মত বিদেশেও বেড়াতে আসবেন। যেমন কাছাকাছি দেশ ইন্ডিয়া, নেপাল, সিঙ্গাপুর, কানাডা, থাইল্যান্ড ওসব। সম্ভব হলে হজও করবেন সবাইকে নিয়ে আল্লাহর ইচ্ছায়।

মিসেস সান্তনা আক্তার শান্তি সংসারে তার সকল কাজ বা দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথেই মেনে চলেন। তিনি হাজী পরিবারের মেয়ে। যদিও তার বিয়ের পরই আব্বা-আম্মা হজ করেন। আব্বার দুটো ভাই উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু ওরাও হজ করেছে। এক ভাই নামকরা জার্নালিস্ট, অপর ভাই তাদের বাসায়ই পরিবার নিয়ে আছে, পারিবারিক ব্যবসা সামলায় আবার একটা নামি এনজিওতে কর্মরত। এখন রিটায়ার্ড করেছে। বোনটা বিদেশে থাকে। তবে বছর পাঁচেক পর দেশে চলে আসার কথা। তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়েছে। ভাইবোনদের বাচ্চারা কেউ আবার ছোট, এমনকি নিয়েনেরও ছোট। পড়ালেখা করে। কারও বিয়ে ঠিক করা হচ্ছে। সময় সুবিধা হলে বিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু প্রত্যেকে আলাদা ডিভিশনে থাকে। তাই নিজেদের পরিবারে অন্য ভাইবোনরা তেমন নাক গলাতে পরে না। তবু হোয়াসঅ্যাপ, ভাইবার, স্কাইপির যুগে ভাইবোনদের ঠিকই যোগাযোগ আছে। একসাথেও গ্রুপে কথা হয়। আবার একক ভাবেও কথাবার্তা, দেখা-সাক্ষাৎ ওইভাবে হয়। ফেসবুক, টুইটার সবই চালু, যোগাযোগ হয়। ইমু এছাড়াও আরও অনেক মাধ্যম আছে। শুধু মোবাইল ফোনেও কথা হয়। সবাই কিছুটা বয়সের দিকে, তাই সবারই শরীর স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রেখে যোগাযোগ রাখা হয়। তবে ছেলেমেয়েরা ততটা এভাবে আসে না। ভাইবোনরাই সকলের সন্তানদের খবর নেয়। আর মাঝে মাঝে সামান্যভাবে হয়তো একে অন্যের সাথে কথা বলে ছেলেমেয়েরা। ওদের সময় কম, নিজেদের জগৎ তৈরি হয়েছে। বন্ধুবান্ধব, পড়াশোনা কেউ বা চাকরি করে, সেভাবেই সবাই ব্যস্ত থাকে। সময় সময় আসা যাওয়াটাও আছে। তবে আগের মত হয় না। ছেলেমেয়েরা ছোট ছিল। নানা-দাদার বাড়ি ঈদে, অনুষ্ঠানে এক হতো, থেকেও আসতো। কিন্তু এখন সকলের ব্যস্ততায় সেটা কমে গেছে আরকি।

স্বদেশজনের একজন বড় বোন আছে। দেশে এলে ভাইয়ের বাসায় আসে। পাঁচ-ছয় দিন থেকে যায়। নিজেদেরও একটা ফ্ল্যাট আছে, সেখানে শ্বশুর-শাশুড়ি ছিল, এখন শুধু শ্বশুর আছেন তো উনার কাছেই বেশি তাকে, তাও অন্য ডিভিশনে থাকে বোনের শ্বশুর। স্বদেশজন প্ল্যান করে নিয়েছে তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে এবার থেকে দেশের মত দেশের বাইরেও তারা একসাথে বেড়াতে যাবে। তখন আত্মীয়দের বাড়িও ঘুরে আসা যাবে। নিয়ন তাই ভাবে ভাইবোনদের সাথে আবার কিসের যোগাযোগ, তারা তো সব দূরেই থাকে, সেই টান কি হবে ওদের নিজেদের মত, এসব বলে ছেলেটা।

বয়সে উনি ৫০ ছুঁই ছুঁইতে আছেন। একসাথে বসে সবাইকে নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য ভাবেন তিনি। রিটায়ার করার পর বড় করে কোনো ব্যবসা খুলবেন। আবার বলেন, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ইনস্টিটিউট খুলবেন। সবাই সেটা পরিচালনা করবেন। কোনো এনজিও দিতে পারেন, যেখানে সকলেই থাকতে পারেন। থাইল্যান্ড, ইন্ডিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউএসএ, লন্ডন কত লোক কত সোর্সে আজকাল চলে যাচ্ছে। ওখানে উনার বা সান্তনা শান্তির পরিচিতরাও আছে। আসলে কারও নতুন বিয়ে হলে সেক্ষেত্রে অনেক নতুন আত্মীয়র সৃষ্টি হয়, নতুন জন্ম নিলে সেও আত্মীয়র নতুনত্বে জন্মসূত্রে অধিকার পায়। চাকরি বা ব্যবসা অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নেওয়ার সময় নতুন বন্ধুবান্ধবদের ঘনিষ্ঠতা এমনও হয়ে যায় যা আত্মীয়তার মতো। পরিচিতদের মধ্যে বিবাহ হলে এভাবে তাদের মাঝেও আত্মীয়তার অটুট বন্ধন তৈরি হয়। ছেলেমেয়ে উভয়পক্ষের সকল আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে।

এসব সম্পর্কের মাঝে বৈদেশিক বন্ধনও গড়ে ওঠে। বিদেশে লোকে শ্রমশক্তি নিয়ে পড়ালেখা করতে, বেড়াতে বা বিয়ে করে নতুন করে বৈদেশিক আত্মীয়তার সম্পর্কও একইভাবে গড়ে তোলে। এভাবে আত্মীয়ের ছোট গণ্ডি পেরিয়ে দেশে এমনকি বিদেশে রিলেটিভ বা রিলেশনশিপ বা সম্পর্ক বৃহত্তরভাবে বেড়ে ওঠে। সান্তনা জানে তার পরিবার ও বর্তমানের গণ্ডির সাথে বৃহত্তর গণ্ডির মাঝেও একাকার হয়ে আছে। তাদের এবং সকলের সব পরিস্থিতি মেনে সঠিক পথ বেছে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের পরিপ্রেক্ষিতে চলাটাই উত্তম।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :