রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা

মো. সাখাওয়াত হোসেন
 | প্রকাশিত : ২৩ মে ২০২৩, ১৫:৫৮

সমকালিন বিশ্বে রাজনীতিতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সমীকরণ রাজনীতির মাঠকে নির্দেশ প্রদান করে থাকে। এখানে নিজ দলের সাংগঠনিক ভিতকে যেমন মজবুত রাখতে হয়, নিজ দলের ভেতরকার প্রতিপক্ষের কারণে কৌশলী ভূমিকা অবলম্বন করতে হয়, আবার প্রতিপক্ষের ছুঁড়ে দেওয়া অভিযোগকে দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে হয়। অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের সবসময় আপডেট থাকতে হয়, চলমান বিশ্বের সকল ধরনের খোঁজ খবর রাখা, ভোটারদের রাজনীতি সচেতন করে তোলা, দলের গতানুগতিক কার্যক্রম ভেঙ্গে গণতান্ত্রিক মনোবৃত্তি নিয়ে দল পরিচালনা করার মানসিকতা ইত্যাদি বিষয়গুলো সাধারণত চিন্তাশীল রাজনীতিবিদদের মধ্যে ব্যাপৃত হয় এবং এ গুণাবলী সম্পন্ন রাজনীতিবিদেরাই রাজনৈতিক অঙ্গনে দ্যুতি ছড়ায়। তাছাড়া জাতির যে কোন সংকটে জনগণের মঙ্গলার্থে ঝুঁকি গ্রহণের সৎসাহসিকতা একজন রাজনৈতিক নেতা তথা যে কোন রাজনৈতিক দলের সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য বলা চলে। এখন এর উল্টো চরিত্র যখন আপনার আমার সামনে অবলোকন করা হয়, খোলস উন্মোচিত হয় ঠিক তখনই বলা যাবে দলটি দেউলিয়া হয়ে গেছে তথা রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে।

সম্মানিক পাঠক, আপনারাই খেয়াল করবেন, ভিত্তিহীন রাজনৈতিক দল সাংগঠনিকভাবে কখনো শক্তিশালী হতে পারে না। একটা গল্প আছে এমন, অবৈধভাবে ক্ষমতায় বসা একজন শাসকের মনে হল তিনি একটি রাজনৈতিক দল গঠন করবেন এবং ইচ্ছা মোতাবেক তিনি কাজটি করলেন। বিভিন্ন পেশা শ্রেণির মানুষকে নিয়ে এসে তিনি মন্ত্রীসভা গঠন করলেন এবং তার মন্ত্রীরা সরকারের নানাবিধ সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে ব্যবসা বাণিজ্য করলেন। কিন্তু দেখা গেল ঐ শাসক হত্যাকান্ডে নিহত হওয়ার পর নতুন গঠিত সামরিক সরকারে পূর্বের মন্ত্রীরা দলে দলে যোগ দিলেন। অর্থাৎ দলের প্রতি, দলীয় নেতার প্রতি তাদের কোনরূপ আবেগ, শ্রদ্ধা কিছুই ছিল না। অর্থাৎ ভিত্তিহীন রাজনৈতিক দলের উত্থান হলেও পতন হতে দেরি হয় না এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পরে দলটি অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে।

যখন কোন রাজনৈতিক দল দেউলিয়া হয়ে যায় তখন দলটির মধ্যে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়:-১. দলটি নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে অবস্থান নড়েবড়ে হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে দলের কাউন্সিল না হওয়ায় সমর্থকদের মধ্যে একঘেয়েমি চলে আসে। শীর্ষ নেতৃত্বের বয়সের ভারে ন্যুজ হয়ে যাওয়া কিংবা দলের প্রয়োজনের সময়ে বিদেশে অবস্থান করা কিংবা কর্মীদের প্রয়োজনে তাদের পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা না থাকা ইত্যাদি বিষয়গুলোর কারণে শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি সাধারণ নেতাকর্মীদের রূঢ় মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। দলীয়ভাবে কর্মসূচি প্রদান করে রাজপথে কর্মীদের নামিয়ে নেতারা যখন উদাও হয়ে যায় সে জায়গাটিতে কর্মীদের সঙ্গে শীর্ষ নেতৃত্বের অঘোষিত দূরত্ব ও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়ে যায় এবং এটা চলমান থাকে। ফলে দলটি দেউলিয়া হওয়ার পথে সামনের দিকে অগ্রসর হয়।

২. সাংগঠনিকভাবে দলটি ক্রমশ স্থিমিত হয়ে পড়ে। সাংগঠনিক কার্যক্রমকে চলমান রাখতে বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান, দলীয় অনুষ্ঠান, জাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজন, সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের গঠনমূলক আলোচনা সমালোচনা, দলীয়ভাবে রাষ্ট্রের নানাবিধ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, দলের তৃণমূলকে স্থানীয় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায়ে মূল্যায়নের মাধ্যমে একটি দলকে সাংগঠনিকভাবে সুদৃঢ় করা যায়। যে দলটির মধ্যে এ বিষয়গুলো অনুপস্থিত দলটি কালক্রমে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।

৩. গণতান্ত্রিক চর্চার রীতি দলের মধ্যে অনুপস্থিত হয়ে যায়। নিয়মিতভাবে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মিটিং, স্ট্যান্ডিং কমিটির মিটিং, মিটিংগুলোতে আলোচনায় সংখ্যাঘরিষ্ঠ সদস্যদের মতামতের মূল্যায়ন, কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত প্রত্যেকটি জায়গায় গণতান্ত্রিক রীতির মাধ্যমে কমিটি গঠন ও মূল্যায়ন একটি দলকে সাংগঠনিকভাবে মজবুত করে তোলে। কিন্তু এ বিষয়গুলোর অনুশীলন যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন যে কোন একটি দল দেউলিয়া হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

৪. অর্থের লেনদেনের মাধ্যমে দলের কমিটি প্রদান করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশে কয়েকটি রাজনৈতিক দলে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অর্থের বিনিময়ে কমিটি প্রদান করা হয়। অর্থের বিনিময়ে কমিটি প্রদান করা হলে যোগ্য নেতৃত্বরা বঞ্চিত হয়, অযোগ্যরা নেতৃত্বে উঠে আসে। অযোগ্যরা নেতৃত্বে উঠে এলে দলীয় কর্মসূচিতে তাদের অংশগ্রহণ যথাযথ থাকে না। অযোগ্যদের আহবানে দলের ‍তৃণমূল সাড়া দেয় না। তৃণমূল মনে করে, দল যেখানে যোগ্যদের মূল্যায়ন করে না তখন নেতৃত্বে অযোগ্যরাই চলে আসে এবং তাদের আহবানে সাড়া দেওয়ার কোন মানে হয় না। এভাবে একটি রাজনৈতিক দল ধারাবাহিকভাবে তৃণমূল থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

৫. তৃণমূলের সঙ্গে ব্যাপক দূরত্ব তৈরি হয়ে যায় নেতাদের। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে এমন অভিযোগ পাওয়া যায়, নেতারা হরতালের আহবান জানিয়েছে এবং তৃণমূল তাতে সাড়া দিয়ে রাজপথে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে খবর বের হয়, যে নেতারা হরতালের আহবান জানিয়েছে তাদের ব্যাংক, গার্মেন্টস ঠিকই খোলা ছিল। এহেন নেতৃবৃন্দের আচরণে তৃণমূল ব্যাপকভাবে শকড হয় এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহনের পূর্বে এ বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। সুতরাং এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, তৃণমূলের সঙ্গে নেতাদের দূরত্বের কারণে যে কোন রাজনৈতিক দলের অবস্থা নড়েবড়ে হতে বাধ্য।

৬. দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় আস্থা বিশ্বাসের সংকট সৃষ্টি হয়। নেতাদের নিয়ে যখন তৃণমূল কর্মী, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রের অঘোষিত দূরত্ব তৈরি হয় সেখানে বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা যায়, দলের মধ্যে অস্থিরতা দেখা যায়, দলে বিপর্যয় চলে আসে, নেমে আসে অন্ধকার। দল অন্ত:প্রাণ কর্মীরাও এহেন পরিস্থিতিতে নিশ্চুপ হয়ে যায় এবং অনেকেই অন্য দলে ভিড় জমায়।

৭. দলের প্রতি আস্থাহীন হয়ে দলের নেতারা বিদেশী বন্ধুদের দ্বারস্থ হয়। এহেন পরিস্থিতিতে উপরিউক্ত চলমান সংকটের কারণে তৃণমূল ও জেলা-উপজেলার নেতাদের সাথে কেন্দ্রের নেতাদের দীর্ঘদিনের অচলাবস্থার কারণে বিরোধ সৃষ্টি হয় এবং যার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্র ঘোষিত কোন কর্মসূচি আলোর মুখ দেখে না। ফলশ্রুতিতে বিদেশী বন্ধুদের দ্বারস্থ হতে হয় দলটির কতিপয় নেতাদের। এ ব্যাপারগুলো তৃণমূল কোনভাবে সমর্থন করে না। এ দেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দেখা গেছে অসাংবিধানিক সরকার ব্যবস্থাকে এ দেশের জনগণ ব্যাপক আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করিয়েছে। অর্থাৎ রাজনীতির মাঠের সমস্যা জনগণই সমাধান করেছে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে। সেখানে যখন জনগণ, দলীয় কর্মী সমর্থকদের বাইপাস করে বিদেশী বন্ধুদের সহায়তা নিয়ে নিজেরা কিছু একটা করে দেখানোর মন্ত্রে উজ্জীবিত থাকে তখন সেখানে জনগণের ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপারটি উহ্য হয়ে যায়।

সর্বোপরী বাংলাদেশে কতিপয় রাজনৈতিক দলের মধ্যে এ ধরনের ক্রিয়াকলাপ দেখা যাচ্ছে যেটি আমাদের রাজনীতির জন্য কোনভাবেই সুখকর নয়। রাজনীতিবিদদের উচিত হবে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি বিশ্বাস আস্থার জায়গায় ইতিবাচক পদক্ষেপ সৃষ্টি করে রাজপথের আন্দোলনকে বেগবান করে রাজপথের মাধ্যমেই রাজনীতির দাবি দাওয়া আদায় করা। কিন্তু উল্টোপথে হাঁটলে দলের মধ্যে ভাঙ্গন ও অব্শ্বিাসের সৃষ্টি হয়, দলীয় কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে আসায় দলটি সর্বাসাকুল্যে জনগণ থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যায় এবং তৎসাপেক্ষে রাজনৈতিক দলটি দেউলিয়া হওয়ার পথে ক্রমশ অগ্রসরমান থাকে।

মো. সাখাওয়াত হোসেন, চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :