ভারতের নতুন সংসদ ভবনে বাংলাদেশ-পাকিস্তানকে নিয়ে ‘অখণ্ড ভারতের’ মানচিত্র!

সম্প্রতি ভারতে উদ্বোধন হয়ে গেল দেশটির নতুন সংসদ ভবনের। নতুন এই সংসদ ভবনের বিপক্ষে অবস্থান করেছিল দেশটির বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। আলোচিত এই নতুন ভবনের সাজসজ্জায় কোনো কার্পণ্য করেনি ভারত সরকার। নানা বর্ণের আলোকসজ্জার পাশাপাশি ভবনটিতে এবার স্থান পেয়েছে ‘অখণ্ড ভারত’-এর মানচিত্র যেখানে আফগানিস্তান থেকে শুরু করে পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং শ্রীলঙ্কা—সব দেশকেই দেখানো হয়েছে।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অখণ্ড ভারত’-এর ধারণাটি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের মূল মতাদর্শগত চিন্তার অন্যতম। ওই ধারণায় বলা হয়ে থাকে, প্রাচীন কালে ইরান থেকে বর্তমানের মিয়ানমার, উত্তরে তিব্বত, নেপাল, ভূটান আর দক্ষিণে বর্তমানের শ্রীলঙ্কা—সবই ছিল অখণ্ড ভারতের অন্তর্ভুক্ত।
তবে এ নিয়ে যেন বিতর্কের শেষ নেই। সামাজিক মাধ্যমে নেটিজেনরা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন ‘একটি দেশের সংসদ ভবনে প্রতিবেশী দেশগুলোর এলাকাসহ কোনো মানচিত্র কেন রাখা হবে?’ এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংসদ ভবনের এই মানচিত্র নিশ্চিতভাবেই প্রতিবেশী দেশগুলির কাছে একটা ভুল বার্তা দেবে।
‘অখণ্ড ভারত’ নিয়ে যা বলছে আরএসএস
আরএসএস বলছে অখণ্ড ভারত হল প্রাচীন সাংস্কৃতিক ভারতবর্ষ। যেসব এলাকায় প্রাচীনকালে ভারতীয় সংস্কৃতি ছিল তা নিয়েই মূলত ‘অখণ্ড ভারত’। আরএসএসের নেতা জিষ্ণু বসু বলেন, ‘গান্ধার থেকে ব্রহ্মদেশ, দক্ষিণে সিংহল—গোটা অঞ্চল জুড়েই তো একই সংস্কৃতি ছিল একটা সময়ে। এটাই তো ছিল ভারতের প্রাচীন রূপ। আফগানিস্তানের বামিয়ান বুদ্ধ বলুন বা সিন্ধু সভ্যতার যেসব নিদর্শন বর্তমান পাকিস্তানে আছে, সেগুলো তো ভারতেরই এলাকা ছিল। আবার বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে যে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন হয়েছিল, সেটাও তো ভারতবর্ষেরই অঙ্গ ছিল। ভারতের এই সাংস্কৃতিক ইতিহাস যাতে মানুষ ভুলে না যায়, সেজন্যই অখণ্ড ভারতের চিন্তা তুলে ধরা হয়েছে।’
জিষ্ণু বসু আরও বলেন, ‘অখণ্ড ভারতের’ ভাবনা যে শুধু সঙ্ঘের, তা নয়। ঋষি অরবিন্দ পণ্ডিচেরি আশ্রমে যেখানে বসতেন, তার পিছনেও এই একই অখণ্ড ভারতের মানচিত্র থাকত। অনেক মনীষীই অখণ্ড ভারতের কথা মেনে চলতেন।’
হিন্দুত্ববাদের গবেষক ও সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলছেন, ‘সংঘের নেতৃবৃন্দের তত্ত্ব অনুযায়ী অখণ্ড ভারতের শুরু হয়েছিল বর্তমান ইরান থেকে যাকে প্রাচীনকালে পারস্য বলা হতো। কিন্তু আরএসএস মনে করে এটি পরশুরামের জন্মস্থান। সেই তত্ত্ব মেনে তারা একে পরশুদেশ বলে। আবার নেপাল থেকে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার সবটাই প্রাচীন ভারতের অংশ বলেও তারা মনে করে।’
তবে এসব তথ্য যে শুধু সঙ্ঘের তাত্ত্বিক নেতারা প্রচার করছেন তা নয়, বরং সংঘের অধীন বিদ্যা ভারতী নামে যে কয়েক হাজার বিদ্যালয় আছে এবং যে সকল বিদ্যালয় সঙ্ঘ পরিচালনা করে সেখানের একেবারে নীচু শ্রেণি ক্লাস থেকে এই তত্ত্ব পড়ানো হয়। এমনকি ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের এই বিষয়টা পড়া বাধ্যতামূলক। আর এগুলো পরীক্ষার প্রশ্নও আসে বলে জানিয়েছেন স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য।
‘বিদ্যা ভারতী সংস্কৃতি শিক্ষা সংস্থান’এর চতুর্থ শ্রেণির একটি বইতে ‘ভারতের বর্তমান ভৌগলিক সীমা’ শীর্ষক পরিচ্ছেদের প্রশ্ন-উত্তর অংশে লেখা হয়েছে ‘আমাদের দেশের বর্তমান সীমা-সংলগ্ন কোন কোন দেশ আমাদের দেশের অঙ্গ ছিল? উত্তর: পূর্বে ব্রহ্মদেশ (মিয়ানমার), বাংলাদেশ। পশ্চিমে পাকিস্তান, আফগানিস্তান। উত্তরে—তিব্বত, নেপাল ও ভূটান এবং দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা।’
ওই একই পরিচ্ছেদে আরব সাগরের নাম বলা হয়েছে সিন্ধু সাগর আর বঙ্গোপসাগরের নাম বলা হয়েছে গঙ্গাসাগর।
অখণ্ড ভারতের মানচিত্র সংসদ ভবনে কেন?
সেই চিন্তাধারার প্রতিফলন দেশের সংসদ ভবনে কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে চান নি জিষ্ণু বসু। তিনি বলেন, ‘এটা তো সরকারি সিদ্ধান্ত। তারা কেন এই মানচিত্র সংসদ ভবনে রেখেছে, কী চিন্তা করে রেখেছে, সেটা তো সরকার বলতে পারবে।’
বিশ্লেষকরা মনে করছেন সংসদ ভবনে ‘অখণ্ড ভারত’-এর মানচিত্র রাখা, উদ্বোধনের হিন্দু রীতি মেনে যজ্ঞ করা বা বহু সংখ্যক হিন্দু সাধুসন্তদের উপস্থিতি, সব কিছুর মধ্যে দিয়ে ভারতকে একটা হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরারই প্রচেষ্টা।
‘প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির প্রতি ভুল বার্তা যাবে’
সংসদ ভবনে যে মানচিত্রটি রাখা হয়েছে, সেখানে আফগানিস্তান থেকে শুরু করে নেপাল, বাংলাদেশ, মিয়ানমার—পুরো অঞ্চলটিকেই দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রী ওই মানচিত্রের যেসব ছবি টুইট করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে যে পাকিস্তান এবং নেপালের বিভিন্ন শহরের প্রাচীন নাম লেখা আছে, কিন্তু তিব্বত বা বাংলাদেশর অঞ্চলে কোনও প্রাচীন জনপদের নাম লেখা নেই।
তিব্বতের বিভিন্ন জনপদের প্রাচীন নাম লেখা হলে তা নিয়ে চীন আপত্তি তুলতে পারে ভেবেই সম্ভবত সেগুলির নাম লেখা হয় নি। একই যুক্তিতে বাংলাদেশর অঞ্চলটিকে অখণ্ড ভারতের মধ্যে দেখানো হলেও সেখানকার কোন প্রাচীন জনপদের নামও চিহ্নিত করা হয় নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির কাছে এই মানচিত্র একটা ভুল বার্তা দেবে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ইমন কল্যান লাহিড়ী।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লাহিড়ী বলেন, ‘এটা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির কাছে ভারতের ভাবমূর্তি একেবারেই উজ্জ্বল করবে না। চারপাশে যতগুলো রাষ্ট্র আছে, প্রত্যেকের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে ভারত। এখন যদি অখণ্ড ভারতের মানচিত্র সংসদ ভবনে রাখা হয়, তার ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা কতটা?’
তিনি আরও বলেন, ‘১৯৪৭ সালে ঐতিহাসিকভাবে আমরা যে ভূখণ্ড পেয়েছি, ভারতবর্ষ সেই ভূখণ্ডের ওপরেই প্রতিষ্ঠিত। এর দর্শন, এর ধারণা অনেক গভীর। দেশ পরিচালিত হয় সংবিধান মেনে, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ মেনে। তাই এ ধরনের পদক্ষেপ প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে অবনতি হবে বলেই আমার মনে হয়।’
(ঢাকাটাইমস/২জুন/এসএটি)
সংবাদটি শেয়ার করুন
আন্তর্জাতিক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ

ভারত বিশ্বকাপে হরদীপ সিং হত্যা বদলার হুমকি খালিস্তানি নেতার

গাঁজা খেয়ে টালমাটাল ভেড়ার পাল

নিজেদের তৈরি সাবমেরিন উন্মোচন করল তাইওয়ান

ব্যাংকের লকারে রাখা মহিলার ১৮ লাখ টাকা খেয়ে ফেলল উইপোকায়!

শীর্ষ কমান্ডার সোকোলভকে জীবিত দেখানো ভিডিও প্রকাশ রাশিয়ার

ইরাকে বিয়ের অনুষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ডে বর-কনেসহ অন্তত ১০০ জনের মৃত্যু

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে পুনরায় যোগ দিতে চাচ্ছে রাশিয়া

শক্তি প্রদর্শনে ১০ বছরের মধ্যে প্রথম সামরিক কুচকাওয়াজ করবে দক্ষিণ কোরিয়া

সৌদি-ইয়েমেন সীমান্তে হুতিদের ড্রোন হামলায় বাহরাইনের ২ সেনা নিহত
