কী মধু বসিলা পশুরহাটে? ৪০ লাখের হাট ৩ কোটিতে কারা বাগিয়ে নিলেন?

অভিজিত রায় কৌশিক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৯ জুন ২০২৩, ১২:২৩ | প্রকাশিত : ০৯ জুন ২০২৩, ১২:১১

এবছর কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীতে বসছে ১৬টি অস্থায়ী পশুরহাট। যার মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় হাট বসবে পৃথকভাবে আটটি করে। তাছাড়া ডিএসসিসির সারুলিয়া ও ডিএনসিসির গাবতলী স্থায়ী পশুরহাটে কোরবানির পশু বিক্রি হবে। এরইমধ্যে সিটি করপোরেশন থেকে হাটের ইজারার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে। যারা হাটের ইজারা পেয়েছেন, তারা মাঠ সাজানোর কাজ শুরু করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবছরের মতো এবছরও পশুরহাটগুলো প্রায় আগের মূল্যেই টেন্ডারের মাধ্যমে ইজারা দিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। তবে ভিন্ন দৃশ্য একমাত্র মোহাম্মদপুর ‘বসিলা হাটে’। অস্থায়ী এই পশুরহাটে এবছর ৭ গুনেরও বেশি দামে ইজারা নিয়েছে একটি প্রতিষ্ঠান; যা টাকার অঙ্কে আড়াই কোটি টাকা বেশি। এখন প্রশ্ন এসেছে- কী মধু আছে এই হাটে?

সরজমিন ও অনুসন্ধান করে জানা গেছে, গেল বছরগুলোতে মোহাম্মদপুর বসিলার ৪০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন ‘বসিলা গার্ডেন’-এলাকায় অস্থায়ী হাটটি ২৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় ইজারা পেয়েছিলেন মেসার্স শাহীন ইন্টারন্যাশনাল। এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. আমজাদ হোসেন; যিনি দারুস সালাম থানা আওয়ামী লীগের নেতা। এবছরও তিনি নিলামে অংশগ্রহণ করেন। তবে ইজারা পাননি। উচ্চদামে হাটের ইজারা বাগিয়ে নেন এনায়েত হোসেন ভূঁইয়া। তিনি ক্যাসিনোকাণ্ডে অভিযুক্ত যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাদের ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে।

ক্যাসিনোকাণ্ডে মোহাম্মদপুরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. হাবিবুর রহমান মিজান গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তারা এই হাট নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু গ্রেপ্তারের পর নিজেদের সাম্রাজ্য হারিয়ে ফেলেন তারা। সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হওয়ার পর তারা পুনরায় মাঠ দখলে নেমেছেন, ফিরে পেতে চান নিজেদের আধিপাত্য। এ কারণেই নামসর্বস্ব একটি প্রতিষ্ঠানের নামে মোটা অঙ্কের টাকা দেখিয়ে রাজীবের বিশস্ত হিসেবে পরিচিত এনায়েত হোসেন ভূঁইয়ার নামে হাটটি ইজারা নেওয়া হয়েছে। দলীয় তেমন পদ-পদবী না থাকলেও ক্যাসিনোকাণ্ডে অভিযুক্তদের সঙ্গে ওঠা-বসার ছবি প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেন এনায়েত হোসেন।

সূত্র বলছে, প্রায় তিন কোটি টাকা দিয়ে নেওয়া হাটে লাভ করা তাদের উদ্দেশ্য না। মূলত অনুসারীদের পুনরায় মাঠে একত্রিত করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চান তারা। সাত গুনের বেশি টাকায় হাটটি নেওয়া হলেও সেই টাকা উঠে আসার সম্ভাবনা না থাকলেও মাঠে নিজেদের জানান দিতে তাদের এই বিনিয়োগ। শুধু তাই নয় স্থানীয় পর্যায়ে ম্যানেজ করতেও কয়েক লাখ টাকা দিতে হয়েছে। ফলে এই বিপুল টাকা বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তা ক্যাসিনোকাণ্ডে উপার্জিত কিনা।

আরও্র পড়ুন>>সরকারি খালে পটুয়াখালীর মেয়রের ‘টাইটানিক’, নদীও তার পেটে

এ ব্যাপারে ঢাকা টাইমসকে সরল স্বীকারোক্তিও দিয়েছেন এনায়েত হোসেন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘টাকা উঠবে কিনা জানি না। তবে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে হাট নেওয়া হয়েছে।’

যেভাবে বিতর্ক সামনে আসে:

জানা গেছে, সরকার নির্ধারিত মূল্যের ওপর নিলামের (ডাকের) মাধ্যমে প্রতিবছর পশুরহাট ইজারা দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ দরদাতাই পেয়ে থাকেন হাটের দায়িত্ব। তবে রাজধানীর দুই সিটির ১৬টি হাটের মধ্যে ১৫টি হাট নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। বসিলা হাটে যখন ২ কোটি ২০ লাখ টাকায় দরপত্র দেওয়ার বিষয়টি সামনে আসে তখন থেকে নানান গুঞ্জন শুরু হয়। সিটি করপোরেশনের কর্তা-ব্যক্তিরাও হকচকিয়ে যান। তবে সর্বোচ্চ দরদাতা হওয়ায় এনায়েত হোসেন ভূঁইয়াকেই দেওয়া হয় মাঠের ইজারা।

সিটি করপোরেশনের ইজারার কাগজ মূল্যায়ন করে দেখা গেছে, গতবছর হাটটি ইজারা দেয়া হয় ২৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকায়; সঙ্গে শতকরা ৩৫ শতাংশ ভ্যাট ও ট্যাক্স দিতে হয়। যা সর্বসাকূল্যে আসে ৪০ লাখের কিছু বেশি। কিন্তু সেই হাটই এবছর নিলামে দর দেওয়া হয় ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। সঙ্গে ৩৫ শতাংশ ভ্যাট ও ট্যাক্স দিতে হবে। সব মিলিয়ে যার মূল্য দাঁড়াই প্রায় তিন কোটি টাকা।

যা বলছেন ইজারাদার:

হাট ইজারাদার এনায়েত হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রতিবছর হাটটি যারা নিতেন এবার তাদের টেক্কা দিতে তা নেওয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সাধারণত প্রতিবছর অন্যরা শিডিউল করে হাট নেয়। কিন্তু এবার আমরা শিডিউল দিয়ে হাট নিয়েছি।’

৩০ লাখের হাট এতো টাকায় নেয়ার কারণ কী— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারের যাতে লাভ হয় সেজন্য দাম বেশি দিয়ে আমরা কিনেছি।’

গতবছর সবমিলিয়ে কোটি টাকা লাভ হয়েছিল। তাহলে এবছর তিন কোটি টাকা দিয়ে নিলেও কি লাভ হবে— এমন প্রশ্নে এনায়েত বলেন, ‘সরকারের লাভ বিবেচনায় করে নিয়েছি। দেখা যাক কী হয়।’

পকেটের টাকা দিয়ে সরকারকে লাভ করিয়ে দিচ্ছেন- এ প্রশ্নে বলেন, ‘গেল বছর যারা নিয়েছিল তাদের টেক্কা দিয়ে এবার নিলাম। কারণ হাট নেওয়া দরকার।’ তাহলে কী আপনি পাল্লা দিয়ে কাউকে কোণঠাসা করে এতো দামে হাট নিলেন-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হুম-হুম-হুম।’

হাটটি একাই নিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটার শেয়ার আছে। নেতাকর্মী সবাই থাকবে।’

ব‌সিলা গার্ডেন সিটির মালিক যা জানালেন:

ব্যক্তি জায়গায় হাট বসলেও সেখান থেকে কোনো সুবিধা পান না বসিলা গার্ডেন সিটির মালিক মো. শামীম। বরং ক্ষয়-ক্ষ‌তির সম্মুখীন হতে হয়। তবে রাজ‌নৈতিক নেতারা হাট নিয়ে থাকেন বলে তিনি এসব নিয়ে কথা বলতে চাননি।

নাম প্রকাশ না করার শ‌র্তে বসিলা গার্ডেন সিটির একজন ঢাকা টাইমস‌কে বলেন, ‘এখা‌নে যখন হাট ব‌সে তখন গ‌ন্ধে টিকে থাকা যায় না। রাস্তায় ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে; চলা‌ফেরা করা যায় না। তাছাড়া সীমানা প্রাচীর ভেঙে যায়, কত কিছু যে ক্ষয়-ক্ষতি হয়। কিন্তু কিছু বলার থাকে না।’

আবাসিক জায়গায় হাট বসানো নিয়ে এক রিটের প্রেক্ষিতে এবছর আফতাবনগরে গরুর হাট না বসানোর আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই হাট যেখানে বসানো হয় সেটি ইস্টার্ন হাউজিংয়ের জায়গা ও আবাসিক এলাকা। হাট বসলে তারা নানানভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হন।

সরজমিনে যা দেখা গেল

রাজধানীর মোহাম্মদপুর বসিলার হাট ঘুরে দেখা গেছে, ৪০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন বসিলা গার্ডেন সিটিতে ঈদকে সামনে রেখে হাট বসানোর কাজ চলছে জোরেশোরে। বিভিন্ন জায়গায় তৈরি করা হচ্ছে গেট। পশু বেঁধে-রাখার জন্য পোতা হচ্ছে বাঁশ। তৈরি করা হচ্ছে ‘হাসিল ঘর’।

যা বলছে সিটি করপোরেশন

উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এবছর আমরা প্রায় সবগুলো হাটেই আগের থেকে ইজারা দর বেশি পেয়েছি। তবে বসিলা হাটে একটু বেশি টাকা পেয়েছি। কারণ এই হাট নিয়ে এবার প্রতিযোগিতা ছিল।’

একটু বেশি হলে তো সেটা আড়াই কোটি টাকা বেশি হতে পারে না, অন্য হাটে সিটি করপোরেশেন এতো বেশি নিতে পারেনি তো, এমন প্রশ্নে সেলিম রেজা বলেন, ‘যিনি বেশি দর দিয়েছেন আমরা তাকেই হাট দিয়েছি।’

ঢাকাটাইমস/০৯জুন/এসএস/ইএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :