পাঠ প্রতিক্রিয়া
এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকারের ‘বঙ্গবন্ধু: বিশ্বরাজনীতির আধ্যাত্মিক কিংবদন্তি’

‘বিস্মিত মহাকাল!
চিরজাগ্রত উন্নত শির, মুক্তির কবিয়াল
ইতিহাস তুমি একাত্তরের অমর বিজয়গাঁথা,
মহাসংগ্রামী, স্রষ্টার দূত, বাঙালি জাতির পিতা।
বঙ্গবন্ধু বিশ্ববন্ধু, শোষিতের বরাভয়
বজ্রকণ্ঠী, মহাজাগতিক, দূর্বার-দূর্জয়।
রুদ্ধ দুয়ার, লৌহ কারাগার কম্পিত সেই নামে,
শেখ মুজিবুর, কাণ্ডারী তুমি
চেতনার সংগ্রামে।’
কালে কালে মানবসভ্যতায় শোষিত মানুষের মুক্তির দূত হিসেবে বহু নেতার জন্ম হয়েছে। অনেকেই কালোত্তীর্ণ এবং কালজয়ী হয়ে শোষিতদের বিপদকালিন সময়ে এখনো সাহস দেন, পথ দেখান। অন্ধদের চোখে আলো দেন। ক্লান্ত মনে শক্তি দেন। পরম স্বস্তির ঠিকানা দেন, পরাধীনতার শিকল ভেঙে স্বাধীনতা দেন। ফিরিয়ে দেন নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষার আবহে বসবাস করার উন্মুক্ত উদ্যান। এর মধ্যে আবার হারিয়ে গেছেন অনেকেই ক্ষয়িষ্ণু বস্তুর মতো লোভের ঘর্ষণে আদর্শচ্যুত হয়ে। আবার, কেউ কেউ মৃত্যুর পরেও জীবন্ত হয়ে আছেন আমাদের বিশ্বাস, স্বপ্ন, উদ্দীপনায় প্রেরণার পাথেয় হয়ে। ঠিক সেরকম একজন মহানায়ক নায়ক আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বিগত কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন দেশী ও বিদেশী লেখকদের হাত ধরে বঙ্গবন্ধুকে আমরা বহু উপাধি, বহু উপমা দিয়ে উপস্থাপন করেছি বিশ্বদরবারে। কিন্তু 'বঙ্গবন্ধু: বিশ্বরাজনীতির আধ্যাত্মিক কিংবদন্তি' গ্রন্থটিতে লেখক জাহাঙ্গীর আলম সরকার পিপিএম একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপনের মাধ্যমে যেন সাধারণ পাঠকদের মানসনেত্র উন্মোচিত করে দিয়েছেন। জাতির জনকের কর্মময় জীবনের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বহু পরিকল্পনা, সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের পথে ধারাবাহিক তৎপরতার নিখুঁত ভাববিশ্লেষণের মাধ্যমে তাঁকে মহান স্রষ্টার প্রেরিত একজন মহামানব রূপে সার্থকভাবে এই গ্রন্থে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন লেখক।
এমন একটি নামকরণ শুরুতেই যে কোনো বিদগ্ধ পাঠককে কৌতুহলী করে তোলে অনায়াসে। প্রশ্ন জাগে নামকরনের সার্থকতার বিষয় নিয়ে। আমরা জানি আধ্যাত্মিক ব্যক্তি বলতে বিশেষ পরাবাস্তব ক্ষমতাসম্পন্ন সুফি, সাধক, পীর-পয়গম্বরদেরই বোঝায় সাধারণ অর্থে। আপাত দৃষ্টিতে একজন পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধুকে কোনো আধ্যাত্মিক পুরুষ হিসেবে চিন্তা করার কথা মনে না হলেও, এই বইটি পড়লে উক্ত বিষয়ে যে কোনো পাঠকের মনেই সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকবে না, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে।
বইটি অধ্যয়ন করতে গিয়ে ইতিহাসের সমস্ত পূর্বপ্রকাশিত ও বহুল-চর্চিত তথ্যসমূহ একটি নতুন মাত্রায় প্রস্ফুটিত হয়ে আমার বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত এ যাবৎকালের সমস্ত ধ্যান-ধারনাকে বদলে দিতে বাধ্য করে। কেন তরুণ শেখ মুজিব প্রবল প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনকে এতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন, কেন তিনি ঠিক ঐ সময়ে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার বিষয়টিতে মনসংযোগ করেছিলেন, কেন তাঁর মননে জনপ্রিয় আওয়ামী মুসলিম লীগকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দল 'আওয়ামী লীগ' হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা অনিবার্য হয়ে উঠল, ছয় দফা দাবীর আভ্যন্তরীন তাৎপর্য কি ছিল, কেন তিনি ৭০ এর দশককেই মুক্তিযুদ্ধের জন্য উপযুক্ত সময় হিসেবে বহু পূর্বেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন ইত্যাদি প্রশ্নের যৌক্তক ও তথ্যসমৃদ্ধ চিত্র এই বইটির বিভিন্ন পর্বে সজ্জিত রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ব রাজনীতির আধ্যাত্মিক কিংবদন্তী’ উপমায় অভিসিক্ত করার অন্যতম যুক্তি হিসেবে গ্রন্থকার জাহাঙ্গীর আলম সরকার পিপিএম জাতির পিতার ভবিষ্যৎদর্শনের অলৌকিক ক্ষমতার উদাহরণ দিয়েছেন বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। শেখ পরিবারের বিভিন্ন প্রজন্মে ঘটে যাওয়া প্রায় অশ্রুত বা স্বল্পশ্রুত বহু ঘটনায় মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপা প্রদর্শনের প্রসঙ্গ এসেছে অনিবার্য ভাবে। উঠে এসেছে ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ভবিতব্য হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য। সত্তরের নির্বাচনের বিষয়ে তাঁর প্রাপ্ত মোট আসনসংখ্যা সহ নিঁখুত গাণিতিক ভবিষ্যৎবাণী স্তম্ভিত করে দিয়েছিল পৃথিবীকে। এমনকী, নির্বাচন পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের বিষয়েও ঠিক তাই ঘটেছে, যা তিনি পূর্বেই ধারণা করে রেখে তাঁর পরিকল্পনা সাজিয়ে নিয়েছিলেন। এই প্রজ্ঞা, এত প্রবল আত্মবিশ্বাস, এমন ব্যক্তিত্ব কোনো সাধারণ জাগতিক মানুষের হওয়া প্রায় অসম্ভব।
সমসাময়িক এবং পরবর্তী প্রজন্মের বিভিন্ন প্রখ্যাত বিশ্বনেতাদের মনঃস্তত্ত্বে বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত অবস্থানের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপের পরিচয় পাওয়া যায় বইটিতে। বঙ্গবন্ধুর সার্বিক ব্যাপ্তির ধারণা লাভের ক্ষেত্রে বর্তমান প্রজন্মের জন্য এটি একটি অমূল্য সংযোগ। মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়কালের মধ্যে যে দূর্বার গতিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে তিনি পুনঃনির্মাণের মহাযজ্ঞ সম্পন্ন করেছেন, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের প্রায় সার্বিক গঠনমূলক পরিকল্পনার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, শতাধিক দেশের স্বীকৃতি আদায় করেছেন, পরাশক্তিদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বিশ্বমানবতার দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, একজন সাধারণ মানুষের ক্ষমতার মাত্রায় কল্পনা করলে তা যেন এক রূপকথা! সত্যিই এভাবে চিন্তা করলে কিংবদন্তী বঙ্গবন্ধুর আধ্যাত্মিক সংযোগের অনুভবকে অস্বীকার করা যায় না।
‘ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন দর্শনের গভীর ভাববিশ্লষণ করলে একটা বিমূর্ত অনুভূতি ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হতে থাকে। তিনি যেন দৈবনির্দিষ্ট হয়ে সাধারণ মানুষকে ভালবাসতেই জন্মেছিলেন। শৈশব থেকে সর্বস্ব উজাড় করে শোষিত, বঞ্চিত মানুষদের নিখুঁত ভাবে ভালবেসে গিয়েছেন আমৃত্যু। নিগৃহীতের অধিকারের দাবীতে তিনি যেমন সর্বত্র বজ্রকন্ঠী, আর্তের আকুতির সামনে তেমনি তাঁর সিংহহৃদয় মুহূর্তে করুণায় বিগলিত। মহাকালের সাক্ষী হয়ে যেন পৃথিবীর সমস্ত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির দায়ভার নিয়ে বাংলার মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই ঈশ্বরনির্দিষ্ট ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। শৌর্যে, বীর্যে, শরীরী ভাষায়, কন্ঠে এই তেজোদীপ্ত মহানায়ক সর্বাত্মক ভাবেই ছিলেন একজন পরিপূর্ণ স্বপ্নদ্রষ্টা। চিন্তা, চেতনা ও মননে কালের উর্ধ্বে গিয়ে বারবার ভবিষ্যতকে তিনি নখদর্পণে প্রত্যক্ষ করেছেন কোনো এক আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবলে। তাঁর জীবনী ও যুগান্তকারী কর্মকান্ডের সার্বিক তাৎপর্য বিশ্লেষণে এই ভাবনাটাই বারবার প্রকট হয়ে ওঠে।’
গ্রন্থটির পরতে পরতে এমন সাবলীলভাবেই মহামানব বঙ্গবন্ধুর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য উপস্থাপন করা হয়েছে অত্যন্ত যত্নের সাথে। তাঁকে আখ্যায়িত করা হয়েছে 'জাতীয়তাবাদী রাজনীতির দার্শনিক গুরু' হিসেবে। শেখ মুজিবকে নিয়ে বইতে উল্ল্যেখিত পৃথিবীর বহু সুপ্রসিদ্ধ রাষ্ট্রনায়ক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক বিবিধ ব্যক্তিদের উক্তি বিষয়টিকে যৌক্তিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।
গ্রন্থটির বিভিন্ন পর্বে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের সেই মহাকাব্যিক ভাষণকে ‘বাংলার স্বাধীনতার মানপত্র’ বলা হয়েছে। যদিও এই বিষয়টি নিয়ে অজস্র গ্রন্থ, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গবেষণাপত্র ইত্যাদি বিগত দীর্ঘ সময় ধরে সারা পৃথিবীতে চর্চিত হয়ে এসেছে, কিন্তু খুব সামান্য সংখ্যক লেখাতেই এই ভাষণের তৃতীয় মাত্রার এমন নিখুঁত ব্যাখা এত প্রাঞ্জল ভাবে উঠে এসেছে।
সার্বিক বিশ্লেষণে গ্রন্থটির স্বকীয়তা, ভিন্নধর্মী লিখনশৈলী, লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি, তথ্য, উপাত্ত, ভাববিশ্লেষণ সবকিছু মিলিয়ে পাঠক হিসেবে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ভাবনার জায়গায় একটি বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করে। অনাগত সকল প্রজন্মের সারা বিশ্বের গবেষক ও জ্ঞানপিপাসুদের কথা বিবেচনা করে গ্রন্থটিকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা এখন সময়ের দাবী বলেই আমি মনে করি।
আমরা জানি, নেতা হতে হলে রাজনীতিকে বুঝতে হয়, আজীবন লালনপালন করতে হয় এবং একটি আদর্শকে মূখ্য করে পথ চলতে হয়। তবেই একজন মানুষ মৃত্যুর সুদীর্ঘকাল পরেও বেঁচে থাকেন কিংবদন্তী হয়ে। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের বঙ্গবন্ধু বিশ্বরাজনীতির আধ্যাত্মিক কিংবদন্তী হয়ে, পৃথিবীর সকল প্রান্তের লাঞ্চিত, বঞ্চিত, শোষিত মানুষের হৃদয়ে বাস করবেন অনন্তকাল। শোষণমুক্ত পৃথিবী বিনির্মাণে, অসম্প্রদায়িক চেতনায়, মানবিকতার উজ্জ্বলতায়, প্রতিনিধিদের প্রতিনিধি হয়ে বেঁচে থাকবেন বাংলা ও বাঙালি জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবশেষে বলব- সৃষ্টির সাথে থাকুন, ভালো বই পড়ুন, বঙ্গবন্ধুকে জানার জন্য পড়ুন।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
গুলজার হোসেন গরিব, কবি

মন্তব্য করুন