ভেষজ কাবাব চিনি ডায়াবেটিসের মোক্ষম ওষুধ

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ২২ জুলাই ২০২৩, ০৯:০৯| আপডেট : ২২ জুলাই ২০২৩, ০৯:২০
অ- অ+

কাবাব চিনি বা কিউবেব পিপার গোত্রের লতানো বৃক্ষারোহী গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। কাবাব চিনির বৈজ্ঞানিক নাম পিপার কিউবেবা লিন। জাভা আর সুমাত্রা দ্বীপে প্রচুর উৎপাদিত হয় বলে ‘জাভা পিপার’ বলেও ডাকা হয়।

কাবাব চিনির উদ্ভিদ জামাইকা থেকে আগত যা কিনা কলম্বাসের হাত ধরে সারা বিশ্বে পরিচিতি পায়। ফল পাকার আগেই এটি গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং রোদে শুকানো হয়, এটি হালকা ধূসর বা কাল রঙের দেখতে, আকৃতিতে ছোট এবং খেতে হালকা তিক্তস্বাদের। বিভিন্ন রান্না এবং পানীয়তে এর ব্যবহার হয়। সুগন্ধযুক্ত এই মশলাটিতে আছে ক্যালোরি, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ভিটামিন এবং আয়রন, শূণ্য কোলেস্ট্ররালের বৈশিষ্ট একে আরো গুণান্বিত করেছে।

কাবাব চিনির কাণ্ড বাঁকা এবং পাতা শাখার বিপরীত দিকে অযুগ্মভাবে থাকে। পাতা ৫ থেকে ৬ ইঞ্চি লম্বা ডিম্বাকৃতির হয়ে থাকে। বৃন্ত মোটা এবং পাতায় বহু শিরা থাকে। পুষ্পদণ্ডে ঘন ঘন ফুল হয় এবং ফল হয় গোলাকার গোল মরিচের মতো। কাবাব চিনির বোঁটা লম্বা এবং ফলের সঙ্গে থাকে। ফলের খোসা আবরণ অতিশয় কোঁকড়ানো এবং একটি বীজ হয়।

ফল পাকার আগেই সংগ্রহ করে সতর্কতার সাথে শুকানো হয়। বাণিজ্যিক কিউবেব বা কাবাব চিনি শুকনো বেরি আর বোঁটার সমন্বয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। শুকনো ফলত্বক ভাঁজ পরা, ধূসর বাদামী বা কালচে হয়ে থাকে। কাবাব চিনির বীজ শক্ত, সাদা ও তৈলাক্ত হয়ে থাকে। কাবাব চিনি বা কিউবেবের গন্ধ সুন্দর, স্বাদ কটু, মৃদু তেঁতো। স্বাদ জ্যামাইকা পিপার ও ব্ল্যাক পিপারের মাঝামাঝি।

কিউবেব বা কাবাব চিনি আরব বণিকদের সঙ্গে ভারত হয়ে ইউরোপে আসে। কাবাব চিনির আরব নামে আলকেমির বইতে উল্লেখিত আছে। জন পারকিন্সন তার বইতে উল্লেখ করেছেন, ১৬৪০ সালে পর্তুগালের রাজা ব্ল্যাক পিপার উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কিউবেব উৎপাদনের উপর নিষেধ আরোপ করেছিলেন। উনিশ শতকে ঔষধি গুনের কারণে খানিকটা প্রত্যাবর্তন হলেও মূলত ইউরোপে এটি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।জিন আর সিগারেটে সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহারের জন্য পশ্চিমে আর খাদ্যের অনুষঙ্গ হিসেবে ইন্দোনেশিয়ায় এর ব্যবহার অবশ্য চালু ছিল।

কাবাব চিনি শরীরের প্রধান অঙ্গগুলো শক্তিবর্ধক। বিশেষ করে জীবনী শক্তি সতেজকারক ও যৌনশক্তিবর্ধক। যকৃৎ ও পাকস্থলীর শক্তিবর্ধক হিসেবে কাজ করে এবং বায়ুনাশক। পুরনো মাথাব্যথা এবং প্রতিবন্ধকতা অপসারক। প্লীহা রোগ, গলাব্যথা ও হৃদকম্প দূর করে এবং দাঁতের মাড়ি সবল করে। মূত্রাশয়ের শক্তি ও প্রস্রাববর্ধক, পাথুরিনাশক। মুখের দুর্গন্ধ এবং কণ্ঠস্বর পরিষ্কারক। মূত্রনালির প্রদাহ, গনোরিয়া, ক্ষত ও প্রস্রাবের জ্বালাপোড়ায় বিশেষ উপকারী। কাবাব চিনিসহ ওষুধ সম্ভোগের ইচ্ছাশক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। মনে প্রফুল্লতা আনয়ন করে।

ওষুধ তৈরির নিয়ম হলো- কাবাব চিনি, জটামাংশি, তজ, জৈন, মৌরি, বূযিদান, স্বর্ণলতা, রুমিমস্তগি, তেউরি মূল, রেউচিনি, জাফরান, চিতামূল, শুঠ, গোলমরিচ, পিপুল, দারচিনি, লবঙ্গ একসঙ্গে মিশিয়ে ওষুধ তৈরি করে নিতে হবে। এটি ট্যাবলেট বা সেমিসলিড ফর্মে তৈরি করে সেবন করা যায়।

মধ্যযুগে আরব চিকিৎসকরা প্রসিদ্ধ ছিলেন, আর তারা কিউবেব বা কাবাব চিনি ব্যবহার করতেন কাবাবা নামে, যখন তারা ‘ওয়াটার অফ আল বাটম’ প্রস্তুত করতেন। ‘এক হাজার এক রজনী’ গ্রন্থে কিউবেবকে এক ধন্বন্তরি উপাদান হিসেবে দেখানো হয় যৌন দুর্বলতা সমাধানের ঔষধ তৈরির ক্ষেত্রে। ‘বীর্য ঘন করার’ এক মোক্ষম ওষুধ তৈরি হত এক ধরনের মিশ্রণ হিসেবে, যা শামস আল দ্বীন নামক ব্যক্তির জন্য তৈরি হয়েছিল, সেই ওষুধ ব্যবহার করে তিনি সন্তান লাভের সফল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে পেরেছিলেন বলে এই গ্রন্থে উল্লেখ আছে।

অন্যান্য আরব লেখকরাও কিউবেব বা কাবাব চিনি ব্যবহারে নিঃশ্বাসের সুগন্ধ, ব্লাডারের প্রদাহে উপশম ও দেহ মিলনে মাধুর্য লাভের উপায় হিসেবে এর ব্যবহার উল্লেখ করেছেন। ১৬৫৪ সালে লন্ডন ডিসপেনসেটোরিতে নিকোলাস কালপেপার কিউবেব সম্পর্কে লিখেন, ‘এটি উষ্ণ এবং মস্তিষ্কের উন্নতি সাধন করে, পাকস্থলী উত্তপ্ত করে ও কামের উদ্রেক করে’। পরে ১৮২৬ সালে এই তথ্য সংস্করণ করা হয়, ‘আরবরা একে কেবেব ও চাইনিজ কেবেব বলে অভিহিত করে,এটি জাভা দ্বীপে উৎপন্ন হয় আর জরায়ুর শীতলতার ক্ষেত্রে এটি ফলপ্রসূ সমাধান।

১৮১৫ সাল থেকে ইংল্যান্ডে কিউবেব বা কাবাব চিনির আধুনিক চিকিৎসাবিষয়ক প্রয়োগ চলে আসছে। বিভিন্ন ধরনের প্রয়োগ, যেমন তেল, টিংচার, ফ্লুয়িড যৌগ, তৈলাক্ত রেজিন ও বাস্প(গলায় প্রদাহের উপশমে) ইত্যাদি দেখা যায়। অল্প পরিমাণের কিউবেব ব্রংকাইটিস নিরাময়ের ওষুধ ও জীবাণুনাশকেও ব্যবহার করা হয়। তবে গনোরিয়া রোগের চিকিৎসায় এর জীবাণুনাশক ধর্ম বিশেষ কাজে লাগে।

উইলিয়াম ওয়াট ১৯০৮ সালে লিখেন, ‘কাবাব চিনি জননাঙ্গের মিউকোসা মেমব্রেনে বেশি কাজ করে’। এই কাজের আরেকটি অনুষঙ্গ ‘কোপাইবা’র তুলনায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিউবেব ব্যবহার বেশি সুবিধাজনক। উদ্বায়ী তেল রূপে কিউবেব সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়ে থাকে, ৫ থেকে ২০ মিনিম পরিমাপে এটি সেবন করা হয়, যা মিউসিলেজে বা উয়েফারের মাধ্যমে সেবন করা হয়। তবে প্রস্রাবের জটিলতায় এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে এলবুমিন সংক্রান্ত কিছু সাদৃশ্যগত সমস্যা হতে পারে। ন্যাশনাল বোটানিক ফার্মাকোপিয়া ১৯২১ সালে কিউবেবকে “ফোর এলবাস” এর চমৎকার উপশম বলে অভিহিত করে।

স্বাদের দিক থেকে চিনির সুযোগ্য উত্তরসূরি হতে পারে কাবাব চিনি। ভেষজ এই উপাদান অবশ্য স্বাস্থ্যগুণের দিক থেকে চিনিকে দু’গোল দেয়। কবাব, পোলাওয়ের মতো বাহারি রান্নায় এই চিনির ব্যবহার হয়। কাবাব চিনি দিয়ে রাঁধলে খাবারের স্বাদও বেড়ে যায়। তবে শুধু স্বাদের যত্ন নেয় এই চিনি, তা নয়। শরীর ভাল রাখতেও এর জুড়ি মেলা ভার। গলা খুসখুস থেকে শ্বাসকষ্টের সমস্যা, সমাধান লুকিয়ে সেই কবাব চিনিতেই। চিকিৎসকেরাও সর্দি-কাশি হলে কাবাব চিনি খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু ডায়াবেটিকরা কি এই চিনি খেতে পারেন?

গবেষণা বলছে, ডায়াবেটিস থাকলেও কাবাব চিনি খাওয়ায় কোনও বাধা নেই। কাবাব চিনি বরং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাতেও ভারসাম্য বজায় রাখে এই চিনি।

শুধু ডায়াবেটিকরা নন, রোগা হওয়ার পর্বেও অনায়াসে খাওয়া যায় কাবাব চিনি। কারণ এতে কার্বোহাইড্রেট নেই। ফলে ওজন বেড়ে যাওয়ারও ভয় নেই কোনও। তবে কাবাব চিনির গুণের শেষ নয় এখানেই। কাবাব চিনিতে রয়েছে ফেনোলিক অ্যাসিড, ফ্ল্যাভোনয়েডস, বেনজোয়িক অ্যাসিড, সেলেনিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফেরসের মতো উপাদান। যা শরীর ভিতর চাঙ্গা রাখতে সাহায্য করে। প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। এমনকি লিভারের রোগের ঝুঁকি কমাতেও বেশ উপকারী এই চিনি। বর্ষায় ইউটিআই-এর ঝুঁকি বেশি থাকে। কাবাব চিনি মূত্রনালির সংক্রমণ থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে।

খারাপ এবং ভাল— সব জিনিসেরই দু’রকম গুণ থাকে। কাবাব চিনিও তার ব্যতিক্রম নয়। কাবাব চিনি সকলের জন্যেও উপকারী নয়। অ্যালার্জির সমস্যা, গ্যাসট্রিক আলসার, গ্যাস-অম্বলের সমস্যা থাকলে কাবাব চিনি এড়িয়ে চলাই ভাল।

(ঢাকাটাইমস/২২ জুলাই/আরজেড)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
টেকনাফে বিজিবির হানা: আইস ও পিস্তলসহ যুবক গ্রেপ্তার
‘সহযোদ্ধা’ ও ‘জাস্টিস ফর কমরেডস’–এর সদস্যরা জড়ালেন ডাকাতিতে!
সোমবার যাত্রাবাড়ীতে পালিত হবে ‘মাদরাসা রেজিস্ট্যান্স ডে ২০২৫’
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবদান ৫০ শতাংশ: ভিসি আমানুল্লাহ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা