গভীর সমুদ্রবন্দর পাল্টে দেবে বাংলাদেশের অর্থনীতি

মহেশখালী ছিল অপরাধের অভয়ারণ্য। লবণ চাষ আর মাছ ধরা ছিল বাসিন্দাদের একমাত্র পেশা। এ দ্বীপের দুর্গম এলাকায় তৈরি হতো আগ্নেয়াস্ত্র। সংঘবদ্ধ জলদস্যু ও ডাকাতদের আস্তানা হিসেবেও ব্যবহৃত হতো এ দ্বীপ। সে দ্বীপ অচিরেই পরিণত হতে যাচ্ছে অযুত সম্ভাবনার ক্ষেত্র হিসেবে। মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে নির্মিত হবে গভীর সমুদ্রবন্দর। যে বন্দর পাল্টে দেবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে। দেশের অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’ হতে যাওয়া মহেশখালীর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের চূড়ান্ত নির্মাণকাজ শুরু হবে আগামী বছরের শুরুতে। এরই মধ্যে সিভিল ওয়ার্কস ফর পোর্ট কনস্ট্রাকশন, কার্গো হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট টিওএস অ্যান্ড সিকিউরিটি সিস্টেম টাগ বোট, সার্ভে বোট এবং পাইলট বোট ক্রয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। গভীর এ সমুদ্রবন্দর পুরোদমে চালু হলে আমদানি-রপ্তানি খরচ কমবে ৩০ শতাংশ। আমদানি-রপ্তানির সময় কমবে ১০ থেকে ১৪ দিন। যা ব্যবসার খরচ কমিয়ে আনবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আশা, ২০২৬ সালের মধ্যেই পুরোদমে চালু হবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। গভীর সমুদ্রবন্দরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু না হলেও এরই মধ্যে কয়লা নিয়ে জাহাজ নোঙর শুরু হয়েছে মাতারবাড়ীতে। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের যন্ত্রপাতি নিয়ে অন্যান্য জাহাজও নোঙর করবে খুব শিগগিরই। কক্সবাজারের মহেশখালীর বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় ১৪০০ একর লবণভূমিতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। জেলা প্রশাসন প্রথম দফায় ৪০০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করে বন্দর কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় দফায় আরও ১ হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য জরিপের কাজ চলছে, যা বন্দর কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করা হবে। এরই মধ্যে গভীর সমুদ্রবন্দরে যাতে নির্বিঘ্নে ১৬ মিটার ড্রাফটের বড় জাহাজ ভিড়তে পারে সে জন্য তৈরি করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ চ্যানেল। গভীর সমুদ্রবন্দর দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রপ্তানি চাহিদা মেটাবে। পুরো মহেশখালীকে পরিণত করবে বহুমুখী কর্মযজ্ঞের কেন্দ্র হিসেবে। এ স্বপ্ন পূরণে বিশ্বমন্দার মধ্যেও এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে গভীর বন্দরের কার্যক্রম।
বৈশ্বিক পণ্য বাণিজ্যে চলছে এখন সংকট। সহজে মিলছে না রপ্তানি পণ্য পরিবহনের জন্য জাহাজে বুকিং। কনটেইনার ডিপোগুলোতে রপ্তানি পণ্যে জট। ঠিক এ সময়ে যদি দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর থাকত, তাহলে সমস্যা সমাধানে বিকল্প হাতে থাকত। ইউরোপ-আমেরিকায় সরাসরি পণ্য পরিবহন সেবা থাকলে যেমন অগ্রাধিকার পেত এ দেশের রপ্তানিকারকেরা, তেমনি বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে বড় আকারের এক-দুই জাহাজেই জমে থাকা সব রপ্তানি পণ্যের কনটেইনার ইউরোপ-আমেরিকায় নেওয়া যেত।
গভীর সমুদ্রবন্দরে বড় জাহাজে করে একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ পণ্য পরিবহন করা গেলে। তাতে পণ্য পরিবহন খরচ কমবে। সময়ও কম লাগবে। সব মিলিয়ে ব্যবসার খরচ কমে যাবে।
মাতারবাড়ী নিয়ে জাইকার সমীক্ষায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে তুলনা করলে মাতারবাড়ী টার্মিনালে সমুদ্রপথে প্রতি ২০ ফুট লম্বা কনটেইনারে খরচ সাশ্রয় হবে ১৩১ ডলার। আর ৪০ ফুট লম্বা কনটেইনারে সাশ্রয় প্রায় ১৯৭ ডলার।
মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হলে ৮ হাজার ২০০ টিইইউএস ক্ষমতাসম্পন্ন কন্টেনার বহনকারী জাহাজ নোঙ্গর করতে পারবে। ফলে পণ্য নিয়ে সিঙ্গাপুর, কলম্বো আর মালয়েশিয়ার বন্দরে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের আর অপেক্ষায় থাকতে হবে না। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় একটি পণ্যের চালান পাঠাতে সময় লাগে ৪৫ দিন। মাতারবাড়ি বন্দর চালু হলে মাত্র ২৩ দিনেই সরাসরি নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হলে অন্যান্য বন্দর থেকে এর দূরত্ব বেশি হবে না। চট্টগ্রাম থেকে সমুদ্রপথে মাতারবাড়ির দূরত্ব ৩৪ নটিক্যাল মাইল, পায়রা বন্দর থেকে মাতারবাড়ির দূরত্ব ১৯০ নটিক্যাল মাইল ও মোংলাবন্দর থেকে গভীর সমুদ্রবন্দরের দূরত্ব ২৪০ নটিক্যাল মাইল। তাই মাতারবাড়িতে মাদার ভেসেল (বৃহদাকার কন্টেনার জাহাজ) থেকে পণ্য খালাস করে অল্প সময়ের মধ্যে সড়ক ও সমুদ্রপথে অন্যান্য বন্দরে পরিবহন করা যাবে। পুরোদমে মাতারবাড়ি বন্দর চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। পরিসংখ্যান বলছে গভীর সমুদ্রবন্দর জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে ২-৩ শতাংশ অবদান রাখবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে তৈরি হচ্ছে উন্নত সড়ক যোগাযোগ ও রেলপথ। মাতারবাড়ি বন্দর থেকে রেললাইন এসে যুক্ত হবে কক্সবাজার দোহাজারি রেললাইনের সঙ্গে। সংযোগ ঘটবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কেও। বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এই সুুবিধাটা যদি আমরা ব্যবহার করতে পারি সঠিকভাবে, তাহলে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে পুরো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এটা ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
লেখক: পরিচালক, বিজিএমইএ; শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ; চেয়ারম্যান, নিপা গ্রুপ ও কেসি ফাউন্ডেশন

মন্তব্য করুন