স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় আবারও প্রয়োজন ‘তারুণ্যের সাংস্কৃতিক মহাবিপ্লব’

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
| আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৩:৫৯ | প্রকাশিত : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:৪৫

বর্তমান বিশ্ব নতুন মেরুকরণের নেশায় উন্মত্ত হয়ে যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে যে কক্ষপথে হাঁটছে, আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। কিন্তু, আমরা হয়তো এখনই এমনটা প্রত্যাশা করিনি। তাই পূর্বপথের ভারসাম্য বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাবার ক্ষেত্রে,বারবার ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছি বর্তমান একমুখী বিশ্বব্যবস্থাপনায় বিশ্বনেতাদের বহুবিধ তৎপরতার ঘুর্নীপাকে পড়ে। পূর্ববৎ স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হলে পৃথিবী আমেরিকাকে একক মোড়ল মানতে বাধ্য হয় সাথে ইউরোপীয়ানরা দোসর হলে অবধারিতভাবেই অপ্রতিরোধ্য শক্তি অর্জন করে আমেরিকা। তাদের বাইরে যে সকল দেশ রইল, সেগুলোর মধ্যে আভ্যন্তরীণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে জটিলতার সৃষ্টি করা এবং পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত অনিবার্য করে সব সময় একটি অস্থিরতার মধ্যে নিমজ্জিত করে রাখা মার্কিনীদের সুপ্রচলিত পররাষ্ট্রনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়। আবার, কোথাও কোথাও যুদ্ধ লাগিয়ে অস্ত্রব্যবসার সুবিধা আদায় করা এবং সেই সকল দেশের সর্বনাশ করে নিজের পছন্দের সরকার ক্ষমতায় বসিয়ে ভবিষ্যত একক পরাশক্তিকে আরো সুসংহত করার লক্ষ্যে,বিশ্বমানবতাকে পদদলিত করতে একটুও কুন্ঠাবোধ করেনা আমেরিকা।

প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীতে বিশ্বমোড়লদের কাছে একটি শান্তিময় ও কল্যাণমুখী আবহ তৈরি করার এক অনন্য সুযোগ বয়ে এনেছিল করোনা ভাইরাস। প্রকৃতি সেই সময় ধনী-গরীব, উন্নত-অনুন্নত সকলকে একঘরে করে রেখেছিল দীর্ঘ সময় ধরে। ফলে, নতুন করে বিশ্বের ভারসাম্য রক্ষায় বিশ্বমোড়লদের চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন আসবে, এক নতুন কল্যাণমুখী, সাম্যময় ও ভারসাম্যপূর্ণ পৃথিবী বিনির্মাণের পথে তারা সকলেই একমত হয়ে পথপরিক্রমায় নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন এমনটাই আমরা ভেবেছিলাম। হয়তো সৃষ্টিকর্তা তাঁর ক্ষমতার নিদর্শন দেখিয়ে তাঁর অসন্তুষ্টির হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতেই এমন পরীক্ষার মুখোমুখি করেছিলেন। কিন্তু বিধিবাম। যুদ্ধবাজদের অসুস্থ মস্তিষ্ক পূর্বপুরুষদের দেখানো পথের বাইরে হাঁটতেই শেখেনি। সময়ের শিক্ষা গ্রহণ করে বিশ্বমোড়লরা একত্রিত হয়ে যুগোপযোগী শান্তিময় ও কল্যাণমুখী বিশ্ব বিনির্মাণের ক্ষেত্রে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করে একটি মানবিক নতুন বিশ্ব সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু, সেই পথে না হেঁটে অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন ব্যবসায় পুষিয়ে নিতে না পেরে আমেরিকা যে হোঁচট খেয়েছিল, তার ফলশ্রুতিতে বিশ্বের পরাশক্তি হিসেবে ভবিষ্যতে নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখার প্রয়াসে নতুন করে যুদ্ধকেই বেছে নিল তারা, যার অনিবার্য পরিণতি চলমান ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ। এশিয়া, আফ্রিকা, রাশিয়া এমনকি তাদের মিত্রশক্তি ইউরোপও আজ নিদারুণ অর্থনৈতিক ঝুঁকির মুখে পড়ে নাগরিক জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। আর সঙ্গত কারণেই বিশ্বব্যবস্থাপনা একমুখী অবস্থান থেকে বহুমুখী অবস্থানে যাবার লক্ষ্যে মূলত আবারও সেই দ্বিমুখী ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। ফলে আমাদের মত বেশ কিছু দেশ,যারা এখনো নিজেদেরকে এই দ্বিমুখী ব্যবস্থার বাইরে রেখেই ধীরে ধীরে ভাগ্য বদলানোর মাধ্যমে উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত করতে চায়, সেই প্রচেষ্টা আজ সত্যিই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে এই নতুন ব্যবস্থাপনার যাঁতাকলে পড়ে।

পূর্বে স্নায়ুযুদ্ধে ন্যাটো বনাম ওয়ারশো তথা আমেরিকা ও তার মিত্রশক্তি এবং সোভিয়েত রাশিয়া জোটের সামরিক যুদ্ধকে বিশ্বের দুই শক্তিশালী পরাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হত। মুদ্রানীতির আধিপত্যে আমেরিকা এখনো এক নাম্বার পরাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হলেও, অন্যতম দ্বিতীয় পরাশক্তি হিসেবে বর্তমান ব্যবস্থায় আবির্ভূত হয়েছে চীন। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত রাশিয়ার পক্ষে প্রেক্ষাপটের কারণে চীনকে এক নম্বর পরাশক্তি হিসেবে মেনে নিতে কোনো দ্বিধা থাকবেনা এবং বাস্তবতাও সেদিকেই যাচ্ছে। কেননা, ইতোমধ্যেই যুদ্ধের কারণে রাশিয়া সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। কাজেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে কোনভাবেই চীন এবং আমেরিকাকে টক্কর দিয়ে রাশিয়ার পক্ষে বর্তমানে শীর্ষ অবস্থানে যাওয়া সম্ভব নয়, অবশ্যই এটি রাশিয়া খুব ভালোভাবেই জানে। তাই শুধুমাত্র আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চীনকে দাঁড় করাতে পারলেও সেটি পক্ষান্তরে প্রাথমিকভাবে রাশিয়ারই একটি বড় বিজয় বলেই ধরে নেওয়া যায়। অবশ্য, সময়ের অপেক্ষা করলে ভবিষ্যৎ অনেক বেশি উজ্জ্বল হবার সম্ভাবনা রাশিয়ার নিজেরও রয়েছে এ কারণে যে, এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী ঘনিষ্ঠ,মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে ইতিমধ্যেই তাদের এবং চীনের আওতাভুক্ত করে নিতে পেরেছে খুব শক্ত করেই। আর, ভবিষ্যতে এসব দেশগুলোকে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই সামরিকভাবে এবং বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে নিজেদের প্রয়োজনেই চীন এবং রাশিয়া তাদেরকে উন্নত কাতারে নিয়ে আসবে। চলমান প্রক্রিয়ার মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার অবতারণা করা যায় এই মর্মে যদি রাশিয়া, চীন, ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের সমন্বিত প্রচেষ্টায় জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে কোনভাবেই ভবিষ্যৎ প্রচেষ্টায় এই কাতারে নিয়ে আসতে পারে তাহলে ক্ষমতার ভারসাম্যে নতুন করে পৃথিবীতে যে রূপ লাভ করবে, তা অতীতের যে কোন সময়ের বিশ্বব্যবস্থা থেকে একটু ভিন্নতর হবে সেই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

কিন্তু, সমস্যাটি ধীরে ধীরে জটিলতর হচ্ছে উপমহাদেশের অন্যতম শক্তিশালী দেশ ভারতকে নিয়ে। পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি নানাবিধ কারণে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত যে ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তা প্রাথমিক পর্যায়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনা বলা গেলেও, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী চীন নাম্বার ওয়ান পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হোক- সেটি মনে প্রানে ভারত কখনই চাইতে পারে না। ফলে, দুই নৌকায় পা রেখে চলার চেষ্টা করলেও ভারত যে প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার সাথে গাঁটছড়া বেঁধে চলার নীতি বা কৌশল অবলম্বন করেছে, সেটি বিভিন্নভাবে ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। ভারতের পক্ষে যুদ্ধকালীন সময়ে রাশিয়াকে যে পরিমাণ সহযোগিতা উদারনীতিতে করা সম্ভব ছিল, তা তারা যেমন করেনি, তেমনি করে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তেলের সুবিধা নিয়েও নিজে উপকৃত হবার পাশাপাশি আমেরিকা এবং ইউরোপকে সহযোগিতা করেছে বলে জানা যায়। অবশ্য, চীন ও ভারতের বৈরী সম্পর্কও তাদেরকে আমেরিকামুখী থাকতে অনেক বেশি বাধ্য করেছে। তারই ফলশ্রুতিতে নৈতিকতার কূটনীতিতে ভারত কতটুকু সফল, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে খোদ ব্রিকস্ সম্মেলনে ভারতের বিরোধিতা সত্ত্বেও মূলত চীন ও রাশিয়ার বিজয় ঘটেছে ব্রিকস্ এর সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে। বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণে এটি স্পষ্ট ধরা পড়েছে যে, ভারত ও ব্রাজিল আমেরিকার এজেন্ট হিসেবে ব্রিকসকে সম্প্রসারণ কার্যক্রম নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছে। খালি চোখে প্লাটফর্মটি বর্তমানে শুধুমাত্র একটি অর্থনৈতিক জোট মনে হলেও ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপটে এই জোটটি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক সকল ক্ষেত্রে ন্যাটো কিংবা পশ্চিমাদের বিপক্ষে একটি শক্তিশালী জোট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে- তাতে কোন সন্দেহ নেই। এমনকি, মার্কিনী ও ইউরোপীয় মুদ্রনীতির বিপরীতে আরেকটি ভিন্ন মুদ্রানীতির উত্থান ঘটানোই হবে এই জোটের মুখ্য উদ্দেশ্য তা সহজেই অনুমেয়।

উন্নতবিশ্বের সাথে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মানের পথে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা গর্বের পদ্মা সেতু নির্মানে সক্ষম হয়েছেন। সেই সাথে পলতে, কুপি বাতি, হারিকেন-হ্যাজাকের বাংলাদেশকে বৈদ্যুতিক লাইট, সোডিয়াম লাইট থেকে শুরু করে বর্তমান পারমাণবিক চুল্লীর বাংলাদেশে পরিণত করলেন তিনি। তাঁর সফল রাষ্ট্রপরিচালনার মাধ্যমে মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে, মহামারি করোনাকেও সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্বের সাথে অগ্রগতির প্রতিযোগিতায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, উৎপাদন, প্রযুক্তি ইত্যাদি প্রধানতম খাতগুলিতেও বাংলাদেশের দৃশ্যমান উন্নতি আমাদের বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে অনেকটাই। এর মধ্যেই অর্থনীতির চাকাকে ঘুরিয়ে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মৌলবাদী কিংবা ধর্মবাদী অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তে সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে এখনো একটি পরিচ্ছন্ন অসাম্প্রদায়িকতাকে ধারণ করে গণতন্ত্রের পথেই সফলভাবে রাষ্ট্রপরিচালনা করে চলেছেন। কিন্তু, দুঃখজনকভাবে সার্বিক গ্রহনযোগ্যতার নিরীখে যখন বিশ্বের ছোট বড় প্রায় সকল নেত্রীবৃন্দের কাছেই তিনি একজন সুদক্ষ এবং সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে বিশ্বের দরবারে নিজের জায়গা স্পষ্ট করে নিচ্ছেন, এমন মুহূর্তে এসে পশ্চিমারা তাদের ভূরাজনৈতিক কৌশলের বেড়াজালে ফেলে মানবতালঙ্ঘন, অপশ্চিমা গণতান্ত্রিক চর্চা, অতিরিক্ত চীনের দিকে ঝুঁকে পড়া, বর্তমান দ্বিমেরুকরণ নীতিতে তাদেরকে সরাসরি সমর্থন না করা আর বঙ্গীয় নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার বিকল্প কোন নেতার সন্ধান করতে না পারার হীনমন্যতা থেকে ক্ষমতার পালাবদলে মরিয়া হয়ে পড়েছে। কারন, তারা ভালো করেই জানে যে, আপোষহীন মুজিবকণ্যা ক্ষমতায় থাকলে বাংলার মাটিতে তাদের এই হীনস্বার্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টা কোনোদিনই বাস্তবায়নের মুখ দেখতে পাবে না।

নির্বাচনকে সামনে রেখে পশ্চিমাদের দৌড়ঝাঁপ, তাদের স্বার্থান্বেষী চিন্তা এবং সেই সাথে হঠকারীতার মত নেক্কারজনকভাবে স্যাংশান চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা, এমনকি অর্থনৈতিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে সহযোগিতা কমিয়ে নিয়ে আসা ইত্যাদি নানা ভাবে অশুভ তৎপরতা চালিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতার বাইরে রেখে তাদের পছন্দমত ফরমায়েসি সরকার গঠন করবার উদ্দেশ্যে হেন কোন চেষ্টা নেই, যা তারা করে যাচ্ছে না। অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে চীনকে বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বমোড়লগিরিতে আমেরিকা এই মুহূর্তে ভূরাজনৈতিক অবস্থানে সুবিধালাভের আশায় বাংলাদেশকে ঘাঁটি হিসেবে দেখার স্বপ্নে বিভোর হয়ে অতিকৌশলী চেষ্টা করে যাচ্ছে। কেননা, প্রতিবেশী ভারতকে দিয়ে আগামীতে চীনের সাথে কিভাবে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেওয়া যায়, সে চেষ্টায় তারা বাংলাদেশে তাদের একটি শক্ত অবস্থান সৃষ্টিকরাকে কৌশলগতভাবে অনেক সুবিধাজনক মনে করে। ভারতকে বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে বেছে নিলেও ভারতের অভ্যন্তরে আমেরিকান ঘাঁটিকে ভারতের নাগরিক সমাজ মেনে নেবেন না, এটি তারা খুব ভালোভাবেই জানে। তাছাড়া, আমেরিকা কষ্মিনকালেও সরাসরি চীনের সাথে যুদ্ধে জড়াবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম। যা করবে বলে মনে হচ্ছে তা হল- আজকের রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে যে সুবিধা ভোগ করবার চেষ্টা করছে, একসময় ভারত ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়ে উভয় রাষ্ট্রকেই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বিজ্ঞান ও সামরিক সকল ক্ষেত্রেই তাদেরকে দুর্বল করে বর্তমান ইউক্রেন ও রাশিয়ার যে অবস্থা করতে পেরেছে, সেদিকে নিয়ে যেতে পারলেই আগামী অন্তত বেশ কিছুকাল পর্যন্ত আমেরিকা পুনরায় একক পরাশক্তি হিসেবে পৃথিবীকে আবার শাসন করতে পারবে।

বলা বাহুল্য, এই কৌশল সফল করার জন্য যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশে তাদের স্বপক্ষীয় তোষামুদে একটি সরকারব্যবস্থা জরুরীভাবে প্রয়োজন। সঙ্গত কারণেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর আপোষহীন ব্যক্তিত্বের কারনে তাদের কাছে চরম অপছন্দের তালিকার একজন হিসেবে বিবেচিত, যদিও ব্যক্তিগত সাফল্যের মানদন্ডে তিনি তাঁর পিতার মতোই সারা বিশ্বের কাছে উদীয়মান বিশ্বসেরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ইতিমধ্যেই বিরাট প্রভাব তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই, অবধারিতভাবে যখন বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রাকে ধারাবাহিক রাখার জন্য পুনরায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে একজন অনিবার্য সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখনই প্রায় মতিভ্রষ্ট্র হয়ে গেছে আমেরিকা তথা পশ্চিমা রাষ্ট্রজোটের। আবার, ইতিমধ্যে ডক্টর ইউনুস তার বিভিন্ন বেআইনি কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সরকারের গৃহীত আইনি ব্যবস্থাকে তার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত রোশানলের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিক মহলে কিছু প্রভাবশালী মানুষকে প্রভাবিত ও প্ররোচিত করতে সক্ষম হয়েছেন। সামাজিক ব্যবসার ন্যায় তিনিও বর্তমান সরকার প্রধানকে নানা ভাবে চাপে রাখার চেষ্টায় প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছেন, যেন সুযোগসন্ধানী বিশ্বমোড়লদের সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কিছু প্রভাবশালী কূটনীতিবীদগনও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপরে অসন্তুষ্ট হোন। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী নন এমন কিছু রাজনৈতিক দল তাদের নিজেদের স্বার্থে প্রয়োজনে সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে দিয়ে হলেও বর্তমান সরকারপ্রধানকে সরিয়ে দেবার জন্য সকল ধরনের নালিশবাণিজ্য ও অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে নির্লজ্জভাবে। ক্ষমতার লোভে দাসত্বের শৃঙ্খলে জাতিকে নতুন করে আবদ্ধ করতে তাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই, তা এখন সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। এদের অতীত কর্মকাণ্ডে শেখ হাসিনাকে বারবার হত্যাচেষ্টার পাশাপাশি মৌলবাদ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে উসকে দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে ক্ষমতার ভাগাভাগি করতে দেখা গিয়েছে বারংবার।

তারুণ্যই একটি দেশের প্রাণশক্তি। বাংলাদেশ তার জন্মলগ্নের বহু পূর্ব থেকেই- বিশেষ করে ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৬৬'র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন আর ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের সক্রিয় ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহনের মাধ্যমে বারবার সেটি প্রমাণ করে এসেছে। তাই বিদেশি ষড়যন্ত্র এবং দেশীয় স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির এই অশুভ ষড়যন্ত্রের হাত থেকে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করা তরুণ প্রজন্মের জন্য আবার নতুন করে সময়ের দাবি হয়ে দেখা দিয়েছে। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তরুণদের এখনই জেগে উঠতে হবে, কেননা তরুণ এবং যুবকরাই এদেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অগ্রসেনা এবং জীবনচক্রে সামনের সময়গুলোতে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে হলেও আজকে তাদেরকে এই গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে। ঘরে ঘরে সকল শ্রেণীর নারী-পুরুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে এই সুগভীর ষড়যন্ত্রের প্রকৃত চেহারা। সাধারণ মানুষদের সচেতন করে আগ্রহভরে নির্বাচনের জন্য উৎসাহিত করতে হবে। মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে বাংলার আনাচে-কানাচে, গ্রাম-শহর সকল স্থানে, এমনকি প্রাথমিক স্তর থেকে সকল স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্তরে মাসব্যাপী পরিকল্পিতভাবে ছাত্র-শিক্ষক সবাই মিলে বিজয় দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালির শ্বাসত সাংস্কৃতিক চেতনাকে পুনরায় উজ্জীবিত করতে হবে। প্রয়োজনে এই কার্যক্রমটিকে সরকারী উদ্যোগে জাতীয় কর্মসূচীর আওতাভুক্ত করে নিয়মিতভাবে প্রশাসনিক তত্বাবধানের রাখতে হবে, যাতে স্বাধীনতাবিরোধী কোনো চক্র এই মহান কর্মকান্ডকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করার সুযোগ না পায়।

৫৬ হাজার বর্গ মাইলের প্রতিটি কোনায় কোনায় বেজে উঠতে হবে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের ইতিকথা, দেশাত্মবোধক গান, গণসঙ্গীত, রণ সঙ্গীত, পথনাটক, মঞ্চনাটক, আবৃত্তি আর নাচ-গান সহ সাংস্কৃতিক সকল বিষয়গুলো মানুষের সামনে তুলে ধরে তাদেরকে নিরলসভাবে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে মননে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার নতুন বীজমন্ত্র রচিত করে সমগ্র বাঙালিজাতীকে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে। নির্বাচন পর্যন্ত এই উৎসবমুখর সাংস্কৃতিক যাত্রা চলমান রাখা সম্ভব হলে প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি ও অশুভ শক্তিরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক বা না করুক, সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহনে নিঃসন্দেহে উৎসবে পরিণত হবে আগামী সংসদীয় নির্বাচন। আর ষড়যন্ত্রের বীজমন্ত্র নিয়ে যারা নির্বাচনকে অন্যায় ভাবে প্রতিহত করবার চেষ্টা করবে, সাংস্কৃতিক গণজাগরণের কারণে তারা কোনভাবেই এই সুবিধা ব্যবহার করতে সাহস করবে না। সেইসাথে প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার বিভিন্ন কর্মকান্ড যদি সাংস্কৃতিক মূল ধারার সাথে একাত্ম হয়ে সকল পশ্চিমা ও দেশীয় ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করে, তাহলে নিঃসন্দেহে কোনো বিদেশী বা দেশী ষড়যন্ত্রকারীরাই এদেশের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতাকে কলঙ্কিত করতে পারবে না। নাটক, সিনেমা শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণের এই মানুষগুলোর কর্মকাণ্ডকে নিরাপদ করার জন্য প্রগতিশীলধারার রাজনৈতিক দল-উপদলগুলো যদি তাদের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করে, সেক্ষেত্রে কোনো অশুভ শক্তিই বাঁধা হয়ে দাঁড়ানোর সাহস পাবে না। আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ব্যাপী রাজধানী ঢাকা সহ সকল বিভাগীয় শহর, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এবং গ্রামে গ্রামে অবাধে সকল অনুষ্ঠানমালা চলতে থাকবে। সকল ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হবে, তার বহুল প্রচারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা যেতে পারে। বিভিন্ন বিনোদনমাধ্যমে প্রচার করা যেতে পারে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে একটি নির্দিষ্ট সময় সম্প্রচারের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। প্রয়োজনে বিজয় উৎসব প্রচারে বিশেষ প্রনোদনা প্রদান করা যেতে পারে। স্টেজ শো'র পাশাপাশি সরকারিভাবে প্রজেক্টরের মাধ্যমে জেলা, উপজেলা ও বিভাগীয় শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র, নাটক, শর্টফিল্ম, দেশাত্মবোধক গান-কবিতা আবৃত্তিসহ নানা ধরনের প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি সরকারের বিবিধ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে অব্যাহতভাবে প্রচার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় ইতিহাস তুলে আনতে হবে আরো গভীর শিকড় থেকে। দেশের প্রতিটি শিল্পী, কবি, গীতিকার, বাচিক শিল্পী, নাট্যকারসহ সকল পর্যায়ের সকল ধরনের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে এই মহান কর্মযজ্ঞে। বাংলাদেশের পরিসীমার সকল প্রান্তে এখন থেকে আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত চলমান এই মহান বিজয়উৎসব হবে সকল প্রতিক্রীয়াশীল স্বাধীনতাবিরোধী ও দেশের সার্বভৌমত্বহরণের ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে একটি সার্থক ও গঠনমূলক প্রতিবাদ। রাজপথে আবার হবে আলোর মিছিল। দেশের গানে, মা-মাটি-মানুষের টানে বাংলার সেই শ্বাসত আবহমান সংস্কৃতির পূণ্যস্রোতে কেটে যাবে অশনীর কালো ছায়া।

আর প্রশাসনিকভাবে যারা নিরাপত্তারক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত, তারা ন্যায়সঙ্গত ভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করলেই এই জাগরণকে কেউ ব্যাহত করতে পারবে না। তেমনি করে, যদি তথ্য মন্ত্রণালয়, শিল্পকলা একাডেমী, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী এবং স্বেচ্ছাসেবী সাংস্কৃতিক ও মানবিক সংগঠনগুলো সমবেতভাবে এখন থেকেই কাজ শুরু করে, তাহলে যে সাংস্কৃতিক জাগরণ বা মহাবিপ্লব সংঘটিত হবে, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচিত করবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। আর, তা করতে না পারলে বাংলার দিগন্তরেখায় যে ভয়াবহ দূর্যোগের অশনী সংকেত দেখা দিয়েছে, তার সর্বগ্রাসী প্রাবল্যের চরম মূল্য দিতে হতে পারে আপামর জনগনকে। সেই সাথে বড় রকমের ক্ষত দেখা দিতে পারে আমাদের স্বাধীন মানচিত্রে। তাই নিঃসন্দেহে বাংলার স্বাধীনতার অস্তিত্ব ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় সার্বজনীন সাংস্কৃতিক জাগরণ তথা মহাবিপ্লব গড়ে তোলা এখন অতি-আবশ্যক সময়ের দাবি, যার বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে বাংলার বহুলপরীক্ষিত সেই তরুণ প্রজন্মকেই।

লেখক: পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :