হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে আগুন সন্ত্রাসীরা কোথায়?

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী
| আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১৪:২৯ | প্রকাশিত : ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৩১

বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) প্রতিবেদনে বিএনপির আগুন সন্ত্রাসীদের ধ্বংসযজ্ঞ অনুপস্থিত কেন? পর্যবেক্ষক মহলের মনে এই প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সুস্পষ্ট অভিমত হচ্ছে নিউইয়র্কের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে এই সংগঠনটি বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থ চেষ্টা করছে! সূচনার প্রশ্ন এবং এ সম্পর্কিত অভিমত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ একদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সাজ-সাজ রব লক্ষ করা যাচ্ছে, আর ঠিক এর বিপরীতে বিএনপি এবং সমমনা কয়েকটি নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দল হরতাল ও অবরোধের নামে চালাচ্ছে আগুন সন্ত্রাস তথা জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি।

দেখা যাচ্ছে, হরতাল অবরোধে মানুষ সাড়া দিচ্ছে না। আর তাই বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অর্থাৎ জ্বালাও-পোড়াও তথা আগুনসন্ত্রাসের মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছে বিএনপি এবং সমমনা নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলো। সংবাদমাধ্যমে পরিবেশিত তথ্য অনুযায়ী ২৮শে অক্টোবর থেকে ২৮শে নভেম্বর সকাল ৬টা পর্যন্ত মোট ২২৩টি অগ্নিসংযোগের সংবাদ পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যে কয়েকটি স্থাপনা থাকলেও অধিকাংশ অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে যানবাহনে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, গত এক মাসে পুড়ে যাওয়া যানবাহনের মধ্যে রয়েছে ১৩২টি বাস, ৩৫টি ট্রাক, ১৬টি কাভার্ড ভ্যান, আটটি মোটরসাইকেল, দুটি প্রাইভেট কার, তিনটি মাইক্রোবাস, পিকআপ, সিএনজি ট্রেন ও লেগুনা এবং একটি করে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, পুলিশের গাড়ি, নছিমন ও অ্যাম্বুলেন্স। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ফায়ার অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মিডিয়া সেলের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা শাহাজাহান শিকদার। ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া তথ্যমতে, যানবাহনগুলোতে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। পাশাপাশি হরতাল-অবরোধে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে পরিবহণখাতে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।

অগ্নিসংযোগের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে দেশের পরিবহণ খাতের ওপর। ২৮শে অক্টোবর ছিল বিএনপিসহ বিভিন্ন বিরোধী দলের মহাসমাবেশ। এরপর থেকেই হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি দিচ্ছে বিরোধী দলগুলো। সংবাদমাধ্যমে পরিবেশিত তথ্য অনুযায়ী ২৮শে অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে মঙ্গলবার (২৮শে নভেম্বর) সকাল ৬টা পর্যন্ত ২১২টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ১১টি স্থাপনায়ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগ অফিস, পুলিশ বক্স, কাউন্সিলর অফিস, বিদ্যুৎ অফিস, বাস কাউন্টার ও শোরুম। এদিকে, ২৮শে নভেম্বরের আগে শেষ হওয়া ২৪ ঘণ্টায় দুর্বৃত্তরা পাঁচটি যানবাহনে আগুন দিয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যে ঢাকা সিটিতে একটি, হবিগঞ্জে একটি, পাবনায় একটি, টাঙ্গাইলে একটি ও খুলনায় একটি যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিস জানায়, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় আগুনে একটি ট্রেনের বগি, তিনটি বাস ও একটি ট্রাক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। জনগণের বিরুদ্ধে বিএনপির এইসব আগুন সন্ত্রাসের তথ্য হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে নেই। মানুষের জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতা রক্ষা করা রাষ্ট্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। নাগরিকের নিরাপত্তা ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক সংরক্ষিত এবং নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারের রক্ষাকবচ। অন্য মানুষকে নিরাপদ রাখা ও বাঁচতে দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে অন্যতম। কোনো ব্যক্তি, সংঘ, সংগঠন ও বহিঃশত্রু কোনো নাগরিককে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে উদ্যত হতে পারে না; বরং রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা যেকোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে বাধ্য থাকবে।

আর তাই হরতাল অবরোধের নামে যারা আগুন সন্ত্রাস চালাচ্ছে দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য আইন অনুযায়ী আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সিসিটিভি ফুটেজ এবং সংবাদমাধ্যমের তোলা ও প্রকাশিত ছবির মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের সনাক্ত করে তাদের গ্রেপ্তার করছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে এই গ্রেপ্তারের তথ্য দেয়া হয়েছে। কিন্তু যে পটভূমি অর্থাৎ আগুনসন্ত্রাস সৃষ্টির প্রত্যক্ষ প্রমাণের তথ্য না দিয়ে ‘তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে’- সেকথা উল্লেখ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। এটি একদিকে দ্বিচারিতা আবার অন্যদিকে পক্ষপাতদুষ্ট! তবে কি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিএনপির পক্ষাবলম্বন করছে? সংস্থাটির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৮শে অক্টোবর প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) একটি পূর্বঘোষিত সমাবেশের পর থেকে প্রায় ১০ হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চলমান সহিংসতায় পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ কমপক্ষে ১৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। সংস্থার এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলিয়া ব্লেকনারের দাবি, বাংলাদেশ সরকার দাবি করছে, তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্ত দেশটির রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক বিরোধীদের দিয়ে কারাগার ভরছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে খুব সতর্কতার সাথে অগ্নিসন্ত্রাসের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে! এর পরিবর্তে, ‘স্বাধীন মতপ্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া, নির্বিচার গ্রেপ্তার, গুম, হয়রানি, ভয় দেখানোর মাধ্যমে বিরোধী, সমালোচক ও অধিকারকর্মীদের অকার্যকর করে দেওয়ার’ কথা বলা হয়েছে। সংস্থাটির বিজ্ঞপ্তিতে ‘বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে আওয়ামী লীগ নেতাদের পেটানোর ও হত্যার হুমকির’ কথাও উল্লেখ করা হয়। ২৮শে অক্টোবরের বিএনপির সমাবেশের পর থেকে জ্বালাও-পোড়াও ও হরতাল-অবরোধে প্রাণ যাচ্ছে মানুষের, পুড়ছে শত শত গাড়ি। এফবিসিসিআইয়ের হিসাব অনুযায়ী হরতাল-অবরোধে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ এসব নাশকতার ঘটনাকে আমলে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। গত ২৮শে অক্টোবর বিএনপির সমাবেশে সংঘটিত সহিংসতাকে কেন্দ্র করে ২৯শে অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া দফায় দফায় হরতাল-অবরোধের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতিতে। হরতাল-অবরোধে বাস-ট্রাকসহ গণপরিবহণে অগ্নিসংযোগের ঘটনার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতিতে। এফবিসিসিআই সভাপতি বলছেন. রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে হরতাল অবরোধের মতো নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের প্রভাবে দেশের পোশাক খাতসহ রপ্তানিমুখী খাত মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে এসব কথার উল্লেখ নেই হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে। বরং সংস্থার এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলিয়া ব্লেকনারের দাবি, ‘বাংলাদেশ সরকার দাবি করছে, তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু দেশটির রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিরোধীদের দিয়ে কারাগার ভরছে’- একথা বলে নিউইয়র্কে বসে তিনি সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশের সকলকে সতর্ক করার হাস্যকর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন!

অতীতের মতো ২০২৪-এর নির্বাচন ঠেকানোর অংশ হিসেবে বিএনপির আন্দোলনে ২৯শে অক্টোবর থেকে সারা দেশে ২৯০টি যানবাহনে আগুন দেওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ২২শে নভেম্বর পর্যন্ত ২৯০টি যানবাহনের পাশাপাশি ১৭টি স্থাপনাসহ মোট ৩৭৬টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া এক পুলিশ সদস্যসহ মোট ৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। অগ্নিসংযোগের বাইরে এ সময়ে ২৭৫টি যানবাহন ভাঙচুর, ২৪টি স্থাপনা ভাঙচুরসহ মোট ৩১০টি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। পাশাপাশি এ সময়ে রেলওয়েতে ২৪টি নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে টাঙ্গাইল, জামালপুর ও সিলেটে ৩টি ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ৬টি ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারা হয়েছে। রেললাইনে ৯টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া সিলেট, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জে রেললাইন কেটে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। গাইবান্ধায় রেললাইনের ফিস প্লেট খোলার চেষ্টাও করা হয়েছে। পাবনায় ট্রেনে পেট্রল ও ডিজেল ভর্তি বোতল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জে রেললাইনের ওপরে অতিরিক্ত ৩ ফুট লম্বা ৩ ইঞ্চি চওড়া পাত সংযোজন করে নাশকতার চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংস্থাটির প্রতিবেদনে এর কোনো উল্লেখ নেই।

এর পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কর্তৃক এ ধরনের বাস্তবতা বিবর্জিত ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণের মনে সন্দেহ ও প্রশ্নের উদয় হয়েছে! কারণ ১৯৭১ সালেও এভাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থানগ্রহণ করেছিল। তবে কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রতিবেদন অতীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে আমেরিকার গৃহীত অবস্থানেরই পুনরাবৃত্তি?

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :