নির্বাচনে বিদেশি প্রভাব কতটা?
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশে-বিদেশে চলছে নানান আলোচনা-সমালোচনা। সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল এক বক্তব্যে নির্বাচনে ‘বিদেশি থাবার’ কথা উল্লেখ করেন। বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার খোরাক জোগায়।
বিশেষজ্ঞ মহলের অনেকে মনে করছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা এখনও কাটেনি। যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করতে নির্বাচন কমিশন বদ্ধপরিকর। কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যাওয়া দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি দলগুলো প্রায়ই সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। বিশেষ করে জাতীয় পার্টি বলে আসছে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি।
সোমবার (২৭ নভেম্বর) নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটির সদস্যদের প্রশিক্ষণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনে কিন্তু বাহির থেকেও থাবা, হাত এসে পড়েছে। তারা থাবা বিস্তার করে রেখেছে। ’দেশের অর্থনীতি, ভবিষ্যৎসহ অনেক কিছু রক্ষা করতে হলে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সেই সঙ্গে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে নির্বাচনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নির্বাচনের ফেয়ারনেসকে উপলক্ষ্য করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিভক্ত হয়ে গেছে, এটি কাঙ্ক্ষিত ছিল না।’
পরদিন মঙ্গলবার (২৮ নভেম্বর) আরেক মতবিনিময় সভায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বহির্বিশ্বের কোনো চাপ নেই বলে দাবি করেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর।
নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া বিভিন্ন বিবৃতির প্রসঙ্গ নিয়ে সিইসি বলেন, ‘আমাকে বাঁচাতে হলে, আমার জনগণকে বাঁচাতে হলে, আমার গার্মেন্টসকে বাঁচাতে হলে, আমার সাধারণ জনগণকে বাঁচাতে হলে, যে দাবিটা আমাদের জনগণের এবং পাশাপাশি বাইরের, ওরা খুব বেশি দাবি করেনি, ওদের একটাই দাবি যে বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচন ফ্রি ফেয়ার হতে হবে। কোনো রকম কারচুপির আশ্রয় নেওয়া যাবে না।’কাজী হাবিবুল আউয়ালের এই বক্তব্যের পরে দেশে আবারও নতুন করে আলোচনা সৃষ্টি হয়। তৈরি হয় বিদেশি চাপ নিয়ে নানান গুঞ্জন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত নানান পরিস্থিতি মোকবিলা করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। তারা বর্তমানে অভ্যন্তরীণ চাপ ও চ্যালেঞ্জের মধ্যেই আছে। এছাড়া থাকতে পারে বাইরের চাপও। যদি প্রত্যাশা অনুযায়ী নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক না হয়, তবে পরিবেশ আশঙ্কাজনক হয়ে উঠবে বলে মনে করেন তারা। তারা বলছেন, ইসির ভেতরে নির্বাচর কমিশনারদের মধ্যে তৈরি হয়েছে মতপার্থক্য।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে একই দলের একই আসনে দুই-তিনজন করে প্রার্থী হচ্ছে। তাদের সঙ্গে আবার নতুন কিছু লোকজনও আসছে। এমনিতেই বিষয়টি জটিল মনে হচ্ছে এরমধ্যে দুই এক জায়গায় নিজেরা নিজেরা মারামারি করার খবর দেখলাম। গতকাল চট্টগ্রামে এক আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাংবাদিকও পিটিয়েছে।
বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বিপুল নেতাকর্মী নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে আসেন। এসময় সাংবাদিকরা নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন নিয়ে প্রশ্ন করলে সঙ্গে সঙ্গে মোস্তাফিজ উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং ওই সাংবাদিককে থাপ্পড় দিয়ে শার্টের কলার ধরেন।
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এমন ঘটনা মাত্র শুরু। এখনও প্রার্থী পূর্ণ বাছাই হয়নি। অনেক লম্বা সময় বাকি এখনও। নির্বাচন কমিশন যেভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ইচ্ছুক, সেভাবে তারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলেও মনে করেন না তিনি।
তিনি বলেন, ‘কমিশন যেমন অভ্যন্তরীণ চাপ ও চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে, তেমনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কথা অনুযায়ী বাইরের চাপেও তিনি আছেন। তবে সে চাপটা কী ধরণের আমি জানি না। যেমন জাতিসংঘ বলছে, তারা নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। এর মানে হলো, জাতিসংঘ আগে থেকেই ধরে নিয়েছে যে, এখানে ওইরকম কোনো নির্বাচন হবে না। তাই জাতিসংঘ কোনো জাজমেন্ট দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করছে না। সুতরাং আমি মনে করি নির্বাচন কমিশনার দারুণ চাপের মধ্যে আছেন। এমনকি কমিশনের ভেতরেও কমিশনারদের মধ্যে মত, দ্বিমতের বিষয়টি দেখা যাচ্ছে।’
নির্বাচনে বিদেশি থাবা প্রসঙ্গে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপ চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ ঢাকাটাইমসকে বলেন, সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, তারা কিছু একটা আশঙ্কা করছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ ৭ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে নির্বাচন কমিশনের প্রত্যাশা ব্যাপক ভোটার উপস্থিতি এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ যদি বজায় থাকে, তাহলে নির্বাচন কমিশনের আশঙ্কা কেটে যাবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে প্রত্যাশা তা-ও পরিপূর্ণ হবে।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বিএনপি থেকে যদি কোনো একটা দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তাহলে সেই নির্বাচনে এক অর্থে ক্রটি থেকেই যাবে। নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো যেহেতু অংশগ্রহণ করছে না, সেহেতু নির্বাচনে ক্রটি থেকেই গেল। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তাদের মিত্ররা যদি কোনো পদক্ষেপে নেয়, স্যাংশন দেয়, সেক্ষেত্রে পরিবেশ আশঙ্কজন হয়ে উঠবে।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঢাকাটাইমসকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপের কোনো লক্ষণ আমি দেখছি না। কারণ বিদেশিরা অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আশা করে। দেশের সরকার প্রধান শেখ হাসিনা বারবার বলছেন, নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হবে। তাই আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের সুষ্ঠু নির্বাচন চাওয়ার সঙ্গে চাপের কোনো সম্পর্ক নেই। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো, তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা।
এ বিষয় নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কিছু কিছু প্রশ্ন ইদানীং সাংবাদিকরা করে থাকেন, যা আমি তাদের কাছে থেকেই প্রথম শুনি। আমরা কমিশনাররা যে সিদ্ধান্তটা নেই সেটা ঐক্যমত হয়ে আইন ও বিধির আলোকেই নিয়ে থাকি। দ্বিমত অথবা মতপার্থক্য এর কোনোটাই সত্য নয়।
বিদেশি চাপ প্রসঙ্গে আহসান হাবিব বলেন, ‘ইলেকশন কমিশন এযাবৎ যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা হচ্ছে সংবিধান, আইন এবং বিধির আলোকে। এতোটুকু আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, কমিশনের ওপর কোনো প্রকার চাপ নেই, তাহলে চাপ অনুভব করবো কেন? আমরা যেটাই করছি বা বলছি সেটাই তো অংশীজনের এবং আন্তর্জাতিক মহলের সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রত্যাশা। এই নির্বাচনে সকল দল বিশেষ করে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল যাতে অংশগ্রহণ করে তার জন্য আমরা প্রথম থেকেই আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছি এবং শেষদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি।’
(ঢাকাটাইমস/০২ডিসেম্বর/টিআই/বিবি)