উন্নয়নে উজাড় বনাঞ্চল, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য

শাহনূর শাহীন
| আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৮:৫৮ | প্রকাশিত : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৮:২১

২০০১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬ হাজার ৩৮৮ হেক্টর বনভূমি উজাড় হয়েছে। বিগত ৫ বছরেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বনভূমি ধ্বংস করা ঠেকানো যায়নি। সবমিলিয়ে ৭ হাজার হেক্টর ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা গবেষকদের। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনসাইট ফ্রম সিটিজেন সায়েন্স রিভিল প্রায়োরিটি এরিয়া ফর কনজারভিং বায়োডাইভারসিটি ইন বাংলাদেশ শীর্ষক গবেষণায় এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক এই গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, বন উজাড় করে ঘর-বাড়ি ও সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামো নির্মাণ এবং বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণসহ নানান কর্মকাণ্ডের কারণে সংরক্ষিত বনভূমি কমছে। ফলে বিলুপ্তি ঘটছে বন্যপ্রাণীর। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সংরক্ষিত বন ধারাবাহিকভাবে সংকুচিত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশের বনভূমিগুলোতে বিশ্বজুড়ে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাঘ-ভালুক, চামচ ঠুঁটো বাটান বা স্পুন বিলড স্যান্ডপাইপার এবং গাঙ্গেয় ডলফিন বাস করে। গবেষণায় উঠে এসেছে, কমপক্ষে এক কোটি মানুষের জীবিকা সরাসরি বনের সম্পদ যেমন গাছ, মাছ, মধুসহ নানা সম্পদ সংগ্রহের ওপর নির্ভরশীল। বনের ওপর চাপ তৈরি হওয়ায় গত ৮০ বছরে দেশের ৪০ শতাংশ এলাকার গাছপালা কেটে মানুষের বসতি তৈরি হয়েছে। ফলে বর্তমানে ১১ শতাংশেরও কম এলাকায় প্রাকৃতিক বন টিকে আছে।

বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিশেষজ্ঞদের মত

জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য সনদ অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে জল ও জঙ্গলে দেশের ৩০ ভাগ অঞ্চল সংরক্ষিত এলাকার আওতায় আনার চুক্তি রয়েছে। সংরক্ষিত বনভূমি বাড়ানোর আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সই করা সত্ত্বেও প্রভাবশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন আইনি বাধ্যবাধকতার পর্যায়ে না পড়লেও তা রাষ্ট্রের জন্য অসম্মানের। একটা রাষ্ট্র যখন আন্তর্জাতিক কোনো বিষয়ে সই করে তখন সেটা না মানলে তা রাষ্ট্রের জন্য অসম্মানের এবং এটা নৈতিকভাবে খারাপ দৃষ্টান্ত।’

মৌলভীবাজারে সাফারি পার্ক নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যখন উন্নয়নের কোনো একটা মডেল দাঁড়ায় তখন সেখানে সংবেদনশীল অনেক কিছুই সংযোজন-বিয়োজন হবে। কিন্তু এখন যে উন্নয়ন, এটা উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া। মুখে যতই বলা হয় পর্যাপ্ত জলাশয় রাখা হবে, পরিবেশ ঠিক থাকবে, কিছুই থাকে না। মূল কথা হলো, সংশ্লিষ্টরা বনের ভূমির ব্যাপারে যতটা আগ্রহী বন রক্ষার ব্যাপারে ততটা না।’

প্রভাবশালী মহলের ইশারায় এবং সরকারি দপ্তরের অবহেলায় প্রতিদিন বনভূমি উজাড় হচ্ছে বলে জানান, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে বন পরিস্কার করে। প্রতিনিয়ত তারা আবাস সম্প্রসারণ করে বন উজাড় করছে। এই সুযোগ নিয়ে অবৈধভাবে গাছপালা কাটছেন স্থানীয়রা।’

মৌলভীবাজারে যে সাফারি পার্ক হচ্ছে সেটিও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে জানান, পবা’র চেয়ারম্যান। সেখানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও তার পরিবারের সংশ্লিষ্টতায় বনভূমি ধংসের উদ্যোগ দেখা গিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

এসবই জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য সনদ ও বাংলাদেশ সরকারের জলবায়ু এবং পরিবেশ নীতির সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

বন বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত দেশের ৫২টি এলাকা সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত। এরমধ্যে জাতীয় উদ্যানগুলোসহ দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চল রয়েছে। বর্তমানে অধিকাংশ বনভূমিতেই বনায়ন ও বন্যপ্রাণী হুমকির মুখে রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হাবিবুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পৃথিবীতে অসংখ্য প্রাণী আছে যেগুলোর সৃষ্টি রহস্য আমরা জানি না। ছোট্ট একটি পোকাও যদি আমরা দেখি সেটা ক্ষতিকর, দেখা যাবে সেটাও অন্য কোনো দিক থেকে আমাদের উপকার করছে। আমরা যখন কৃত্রিমভাবে প্রাণীদের আবাস্থল ধংস করি তখন প্রাণিগুলো পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।’

অবকাঠামোগত উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার কারণে দুর্যোগ, জমির উর্বরতা এমনকি জনস্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানিয়েছেন প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এই অধ্যাপক।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রাণিবিদ্যার এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘যুদ্ধের সময় দেখেছি অনেক পাখি আমাদের দেশ ছেড়ে চলে গেছে। যেগুলো এখন আর দেখা যায় না। সুতরাং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে প্রতিটি পদক্ষেপ কঠোর হতে হবে। যাতে বন্যপ্রাণির আবাসভূমি কেউ দখল করতে কিংবা পরিবেশ নষ্ট করার কেউ সাহস না করে।’

কী পদক্ষেপ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ

বন বিভাগের সবশেষ হিসাব ২০২০ সালের অথ্যানুযায়ী বর্তমানে দেশে মোট বনভূমি আছে ১৩ লাখ ৩৯ হাজার ৯০৫ দশমিক ৯২ হেক্টর। এরমধ্যে ১০ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট। বাকী অংশ উপকূলীয় অঞ্চলে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) এর হিসেবে বাংলাদেশে সংরক্ষিত বনভূমির মাত্র দশমিক ৮৭ শতাংশ এলাকা সুরক্ষিত আছে।

বিভিন্ন গবেষণা এবং পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের জলবায়ু সম্মেলনে জাতিসংঘের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী সংরক্ষিত এলাকা বাড়ানোর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ বন বিভাগের নেই। উল্টো অভিযোগ রয়েছে নানা ধরনের সরকারি ও বেসরকারি তৎপরতায় পূর্বের সংরক্ষিত এলাকা আরও সংকুচিত হচ্ছে।

এদিকে জাতিসংঘের সনদ বা চুক্তির বিষয়ে তেমন ধারণা নেই বলে অপারগতা প্রকাশ করেছেন বন বিভাগের উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী প্রধান বন কর্মকর্তা ড. মরিয়ম আক্তার। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘জাতিসংঘ সনদ বা মন্ট্রিয়ল চুক্তির বিষয়টা আমাদের কোথাও মেনশন করা হয়নি। আমার মনে হয় না সেটা আমাদের দেশের সঙ্গে যায়। তবে আমি তথ্যটা ভেরিফাই করবো। আমি আপনাকে যেটা বলতে পারি, এসডিজি টার্গেট অনুযায়ী আমাদের দেশের মোট ভূমির বিপরীতে বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ আছে। এটাকে ১৬ শতাংশে উন্নত করা হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা এই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর পরিকল্পনায় কাজ করছি।’

জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য সনদ সিবিডির আওতায় করা কুনমিং-মন্ট্রিয়ল চুক্তি অনুযায়ী যেকোনো দেশের ১৭ শতাংশ ভূখণ্ড ও ১৩ শতাংশ সাগর এলাকাকে সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। গত বছরের ডিসেম্বরে কানাডায় অনুষ্ঠিত কপ সম্মেলনে সর্বশেষ প্রস্তাবিত পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত ‘কুনমিং-মন্ট্রিয়ল গ্লোবাল বায়োডাইভার্সিটি ফ্রেমওয়ার্কে’ সই করেছে বাংলাদেশ। এর আগে ১৯৯০ সালেই এই চুক্তিতে প্রথম সই করেছিলো বাংলাদেশ। এরপর নানা সময়ে আন্তর্জাতিক এই চুক্তি সংশোধন-সংযোজন হয়েছে।

বন কর্মকর্তা ড. মরিয়ম আক্তার বলেন, ২ লাখ ৬০ হেক্টর ভূমিতে আমরা বনায়নের পরিকল্পনা করেছি। নির্ধারিত সময়ে এই লক্ষ্যমাত্রার বনভূমি সংরক্ষণের আওতায় আনতে পারবেন বলেও দাবি করেছেন তিনি।

তবে বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র রক্ষায় সরকারের উদাসীনতা রয়েছে জানিয়ে অতিসত্বর এ বিষয়ে সতর্ক হওয়ার তাগিদ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

(ঢাকাটাইমস/১৩ডিসেম্বর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

মে দিবস বোঝে না শ্রমিকরা, জানে ‘একদিন কাজ না করলে না খেয়ে থাকতে হবে’

গামছা বিক্রেতা থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক, মনে আছে সেই গোল্ডেন মনিরকে?

সোনার ধানের মায়ায় হাওরে নারী শ্রমে কৃষকের স্বস্তি

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর বার্তা দেবে আ. লীগ 

গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন: চাহিদা বেড়েছে তরমুজের, ক্রেতা কম ডাবের

গাছ কাটার অপরাধে মামলা নেই 

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :