ঢাকা টাইমস অনুসন্ধান

বেঁচে যাওয়া খাবারের নামে পচা-উচ্ছিষ্ট বিক্রি, পেছনে পুলিশ সদস্য

অনুসন্ধানে গিয়ে ঢাকা টাইমসের দুই প্রতিবেদক পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত

লিটন মাহমুদ ও মুজাহিদুল ইসলাম নাঈম
| আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৯:০৭ | প্রকাশিত : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৭:৪৯

কমিউনিটি সেন্টার, ক্লাব বা অনুষ্ঠানে বেঁচে যাওয়া খাবারের নাম করে রাত ৯টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে কমদামে পোলাও, বিরিয়ানি, মুরগি, গরু, খাসির মাংস ও বোরহানিসহ যেসব খাবার বিক্রি করা হয় তা পচা-উচ্ছিষ্ট। ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া বাসি-পচা নোংরা খাবার এগুলো। কয়েকটি চক্র এ খাবার সংগ্রহ করে হাত বদলে বিক্রি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যে চক্রের প্রশ্রয়দাতা খোদ পুলিশ সদস্যরা। ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন ভয়ংকর তথ্য।

এই প্রতিবেদনের তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে শনিবার রাতে হাতিরঝিল থানা এলাকায় পুলিশ ও ওই চক্রের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন ঢাকা টাইমসের নিজস্ব প্রতিবেদক লিটন মাহমুদ ও মুজাহিদুল ইসলাম নাঈম। এমনকি পুলিশ ওই চক্রের পক্ষ নিয়ে এই অপরাধ সংঘটনের পুরো ভিডিও মুছে (ডিলিট) দেন। টেনেহেঁচড়ে গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে হাতিরঝিল থানার এএসআই ফুল গাজীর নেতৃত্বে একটি দল। আর পুলিশের এই টিমকে পেছন থেকে ফোনে পরিচালনা করে একই থানার এসআই মো. তমিজ উদ্দিন ও এসআই এনামুল। নিজেকে এসআই তমিজের বান্ধবী পরিচয় দিয়ে সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করেন ইস্কাটনে উচ্ছিষ্ট খাবার বিক্রয়ের হোতা শারমীন নামে এক নারী, যাকে হাতিরঝিল থানার পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে ‘নেত্রী’ বলে সম্বোধন করেন।

এ সময় তেজগাঁও বিভাগের এডিসি হাফিজ আল ফারুক এ দুই প্রতিবেদককে রক্ষার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তাকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছিলেন না এএসআই ফুল গাজীর নেতৃত্বে ঘটনাস্থলে আসা পুলিশের ওই দলটি। এমনকি পুলিশের গাড়িচালক সিদ্দিক সাংবাদিকদের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে এএসআই ফুল গাজীর নির্দেশে ভিডিও মুছে দেয়। তখন এডিসি মোবাইল ফোনে ওই পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও পুলিশ সদস্যরা কথা বলেননি। একপর্যায়ে চক্রটি বৈদ্যুতিক বাতি নিভিয়ে দিয়ে পুলিশের সামনেই এ দুই প্রতিবেদককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। এ সময় ওই পথ দিয়ে অন্য সাংবাদিকরা যাওয়ার সময় ঘটনা দেখে সেখানে থামলে প্রাণে রক্ষা পান ঢাকা টাইমসের এ দুই প্রতিবেদক।

ঘটনার ১৪ ঘণ্টা পার হলেও এখনো লাঞ্ছিতকারী ওই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। এমনকি গ্রেপ্তার হয়নি চক্রের হোতারাও।

এদিকে এ ধরনের খাবার খেলে ক্যানসারসহ মৃত্যুঝুঁকিও রয়েছে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সবারই স্বাস্থ্যসম্মত খাবার তৈরি এবং পরিবেশন করা উচিত। অস্বাস্থ্যকরভাবে খাবার পরিবেশন করা উচিত নয়। পুলিশরা যদি এ বিষয়ে সহায়তা করে সেটিও উচিত নয়।’

রাজধানীর হাই-কেয়ার জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক পুষ্টিবিদ সানজিব আহমেদ তালুকদার তনয় ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এ ধরনের খাবার যারা খাবে প্রাথমিকভাবে তাদের পেটে বিষক্রিয়া হবে। নিয়মিত এ ধরনের খাবার খেলে লিভার ফেটে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে।’

উচ্ছিষ্ট বাসি-পচা খাবার থেকে মাংস-পোলাও আলাদা করছে চক্রের সদস্যরা

যেভাবে খোঁজ মিলল চক্রের: বেঁচে যাওয়া খাবার বলে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে যে খাবার বিক্রি করা হয় কম দামে, সেগুলো কোথা থেকে আসে সেই উৎসের সন্ধানে নামে ঢাকা টাইমস। বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়, ময়লার ভেতর থেকে পচা, বাসি, উচ্ছিষ্ট খাবার আলাদা করা হচ্ছে।

এরপর কী হয় এসব খাবার? সেই অনুসন্ধানে নেমে দেখা যায়, শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বেশকিছু ক্যারেট (ঝুড়ি) নিয়ে ইস্কাটন গার্ডেনের সবজি বাগান মসজিদের বাম পাশে অন্ধকার জায়গায় থামে একটি ভ্যানগাড়ি। সেখানে অপেক্ষায় থাকা ৪ ব্যক্তি ক্যারেটগুলো ভ্যান থেকে নামিয়ে ফুটপাতে রাখেন। এরপর ক্যারেটগুলো ডিজিটাল পরিমাপকে (পাল্লা) ওজন দেওয়া শেষে ওই ৪ ব্যক্তির সঙ্গে ১০ মিনিট সময়ের মতো আলাপ করে হিসাব সেরে ওই স্থান ত্যাগ করে ভ্যানটি। সেটি অনুসরণ করে দেখা যায়, মৎস্য ভবন অতিক্রম করে পুরান ঢাকার দিকে চলে যাচ্ছে সেটি।

অন্যদিকে ইস্কাটনের ক্যারেটগুলো অন্ধকার ফুটপাতে একটি মাদুর পেতে ঢালা শুরু করেন ওই চার ব্যক্তি। এরপর ময়লা, দুর্গন্ধযুক্ত উচ্ছিষ্ট খাবার থেকে পোলাও, রোস্ট, মুরগি, খাসি ও গরুর মাংস আলাদা করতে দেখা যায় তাদের। মোবাইলে ভিডিওধারণ শুরু করলে চক্রের একজন এসে বাধা দেন। যদিও সে বাধা অতিক্রম করে কৌশলে ওই ভিডিও ধারণ করা হয়, যা ঢাকা টাইমসের কাছে রয়েছে।

এরপর এগুলো কোথায় যায় তা অনুসরণ করে দেখা যায়, ওই খাবারগুলোর একটি অংশ নিউ ইস্কাটন ও আরেকটি অংশ কারওয়ানবাজার এলাকায় চলে গেছে। সেখানে ওই উচ্ছিষ্ট খাবারগুলো বিক্রেতাচক্র প্রথমে পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করতে থাকে। পরে তেল, মরিচ, হলুদসহ প্রয়োজনীয় উপাদান দিয়ে আবার রান্না করা হয়।

এরপর রাত সাড়ে ১০টায় নিউ ইস্কাটনের আঞ্চলিক লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পাশে ফুটপাতে ভ্যানে ধরনভেদে এক বল (গামলা) খাবার ২০০ থেকে ৬০০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। সাজিয়ে রাখা হয়েছে প্যাকেট ও প্লাস্টিকের গামলায়।

বাসি-পচা খাবারগুলো পুনরায় রান্নার পর বিক্রি করছেন ইস্কাটনের শারমীন। ছবি: ঢাকা টাইমস

এ সময় ওই খাবার বিক্রির ভিডিও করতে গেলে মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন ওই বিক্রিচক্রের হোতা শারমীন। তিনি হাতিরঝিল থানার এসআই তমিজ উদ্দিনের বান্ধবী দাবি করে তাকে দিয়ে সাংবাদিকদের আটকের হুমকি দেন। যেই কথা সেই কাজ। সঙ্গে সঙ্গে ওই নারী ফোন দেন তমিজকে। এরপর পুলিশ পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তমিজ। একাধিকবার তমিজের নাম ভেসে ওঠে চক্রের হোতা শারমীনের মোবাইলের স্ক্রীনে। ওই নারীর ডাকে চক্রের অন্য সদস্যরাও আশপাশ থেকে দ্রুত এসে হাজির হন। ঘিরে ফেলেন সেখানে অনুসন্ধানে যাওয়া ঢাকা টাইমসের দুই প্রতিবেদক লিটন মাহমুদ ও মুজাহিদুল ইসলাম নাঈমকে। করা হয় লাঞ্ছিত। এর মধ্যেই ঘটনাস্থলে হাজির হয় ওই নারীর পুলিশ বন্ধুর পাঠানো পুলিশের গাড়ি। তেড়ে গাড়ি থেকে নামেন চালক সিদ্দিক। বলেন, ‘কি নেত্রী, কে ঝামেলা করছে, সোজা করে দেবো।’ এ সময় নেত্রী বলেন, ‘আমি তো আগেই বলেছি, এখানে নষ্ট খাবার তো কিছুই না, গাঁজা ইয়াবা বিক্রি করলেও কেউ এখানে ভিডিও করতে পারবে না, এটা এসআই তমিজের বান্ধবীর স্পট। ১৪ বছর এখানে ব্যবসা করি।’

এ সময় গাড়ি থেকে নামেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) হাতিরঝিল থানার এএসআই ফুল গাজীসহ পুলিশের তিন সদস্য। তারা ওই বিক্রেতা নারীকে ‘নেত্রী’ বলে সম্বোধন করে ভিডিও করা সাংবাদিকদের খোঁজ করেন। নারী বিক্রেতা তাদের দেখিয়ে দিলে এএসআই ফুল গাজীর সামনে পুলিশের গাড়িচালক সিদ্দিক সাংবাদিক মুজাহিদুল ইসলামের হাতে থাকা মোবাইল ফোন কেড়ে নেন এবং বেআইনিভাবে সাংবাদিকের মোবাইল ঘাটেন। মোবাইলে থাকা চক্রের অপরাধ কর্মকাণ্ড ও সাংবাদিক আক্রমণ করার ভিডিও জোরপূর্বক মুছে দেন। এমনকি ওই সাংবাদিকদের তাদের সহকর্মী বা অফিসের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। এ সময় ঢাকা টাইমসের দুই প্রতিবেদকের ছবি তুলে তাদের নাম-ঠিকানা লিখতে থাকেন ফুল গাজী।

এর মধ্যে ফুলগাজী ও গাড়ি চালক সিদ্দিক ওই নারীকে গিয়ে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কুপ্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ এনে মানুষ জড়ো করতে পরামর্শ দেয়। কিন্তু তা ধোপে না টিকলে বন্ধ করে দেওয়া হয় বৈদ্যুতিক বাতি। এরপর এ দুই প্রতিবেদককে জোরপূর্বক টেনেহেঁচড়ে থানার গাড়িতে তোলার চেষ্টা করেন। আর শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত করেন এএসআই ফুল গাজী ও সঙ্গীয় পুলিশ সদস্যরা। এ সময় ওই পথ দিয়ে যাওয়া দুজন সাংবাদিক জটলা দেখে সেখানে থামেন। তারা দেখে ফেলায় ঢাকা টাইমস প্রতিবেদকদের গাড়িতে তোলার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

এসময় চক্রের সদস্যরা পুলিশের আসকারা পেয়ে তাদের সামনেই সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করেন এবং মোবাইলের সমস্ত ভিডিও ডিলিট না করলে সেখান থেকে বেঁচে ফিরতে দেওয়া হবে না বলে হুমকি দেন। এরপর ভিডিওগুলো পুলিশ ও চক্রের সদস্যরা মিলে মুছে দিয়ে মোবাইল ফোন ফেরত দেন। এরই মধ্যে এএসআই স্থানীয় জাকির নামে এক ব্যক্তিকে ফোনে ডেকে আনেন সাংবাদিকদের শায়েস্তা করতে। তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয় দিয়ে সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করেন। এরপর ভিডিও করেন ঢাকা টাইমসের দুই প্রতিবেদকের।

মোবাইল ফোন হাতে পেয়ে সাংবাদিক লিটন মাহমুদ তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল বিভাগের এডিসি হাফিজ আল ফারুককে ফোন করতে সক্ষম হন। বিষয়টি জানালে তিনি এএসআই ফুল গাজীর সঙ্গে কথা বলতে চান। কিন্তু ফুল গাজী এডিসির সঙ্গে কথা বলতে চাননি। উল্টা ‘এসব এডিসির সময় নেই’ বলে সাংবাদিকদের আরেক দফা লাঞ্ছিত করেন। একপর্যায়ে দুই সাংবাদিককে চক্রের হাতে ছেড়ে দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে পুলিশের ওই গাড়ি। পুলিশ চলে যাওয়ার পর পরিবেশ আরও ঘোলাটে হয়। আবার সাংবাদিকদের ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। এরপর আরেক দফা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে ঘটনাস্থল ছাড়তে বাধ্য করা হয় এ দুই সাংবাদিককে।

এদিকে রবিবার দুপুরে ওই নারীকে কেন প্রশ্রয় দেওয়া হয় এবং ওই নারী বান্ধবী কি না তা হাতিরঝিল থানার এসআই তমিজ উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা টাইমসকে ওই নারীর ফোন পেয়ে পুলিশ পাঠানোর কথা স্বীকার করেন। বলেন, ‘আমি ডিউটিতে না থাকার কারণে এসআই এনামুলকে পুলিশ পাঠাতে বলেছিলাম। তবে লাঞ্ছিত করতে বলিনি।’ ওই নারী কেন আপনাকে বারবার ফোন দিচ্ছিলেন এবং সাংবাদিকদের আপনার ভয় দেখানো হলো আর আপনিই কেন ডিউটি না থাকলেও পুলিশ পাঠালেন— এসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি তমিজ। তিনি বলেন, আমি বিষয়টি এসআই এনামুলকে জানিয়েছিলাম। তিনি যা করার করেছেন।

এ বিষয়ে এসআই এনামুলকে ফোন করা হলে তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমি তমিজের অনুরোধে পুলিশ পাঠিয়েছি। তবে মোবাইল কেড়ে নিয়ে সাংবাদিকের তোলা ভিডিও মুছতে বলিনি।’

তবে এসআই এনামুল বা এসআই তমিজ, দুজনের কারোরই ডিউটি ছিল না শনিবার ওই সময়ে।

জানা গেছে, শুধু এই চক্রই নয়- আরও বহুমুখী অপরাধচক্রের সঙ্গে হাতিরঝিল থানার বড় কর্মকর্তারাও জড়িত।

(ঢাকাটাইমস/০৪ফেব্রুয়ারি/এলএম/এফএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজধানী বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :