ভিয়েনা-জেনেভা কনভেনশনে যুদ্ধের আইন

শাব্বির আহম্মদ
 | প্রকাশিত : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:৪৮

বিদেশি কূটনীতিক বা রাষ্ট্রদূতগণের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রায়ই আমাদের দেশে কথা হয়। সে প্রসঙ্গে কাউকে কাউকে ভিয়েনা কনভেনশনের কথা মনে করিয়ে দিতে দেখা যায়। আবার মায়ানমার সীমান্ত রক্ষীদের কিংবা রোহিঙ্গাদের প্রবেশ, অথবা আটকে পড়া পাকিস্তানি (বিহারী হিসেবে পরিচিত) প্রসঙ্গ বা কোন দেশের যুদ্ধের সময় অসামরিক নাগরিকদের উপর হামলা আক্রমণ হলে আমরা শুনি জেনেভা কনভেনশন নামে আরেকটি কনভেনশন বা চুক্তির কথা।

১৯৬১ সালের ১৮ই এপ্রিল অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় জাতিসংঘের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে, আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের প্রস্তাবনা অনুসারে স্বাধীন দেশসমূহের দূত, কূটনীতিকগনের অধিকার, কর্তব্য ও পরস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর নাম The Vienna Convention on Diplomatic relations. দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপ দেশ পালাউ, সদ্য পৃথক ও স্বাধীন হওয়া দক্ষিণ সুদান আর জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক সদস্য প্যালেস্টাইন ও ভ্যাটিকান সিটি ব্যতীত জাতিসংঘের সদস্য সকল স্বাধীন দেশ ( ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ১৯৩ টি) এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।

এ চুক্তিরই বহুল উচ্চারিত অনুচ্ছেদ ৪১(১) এ বলা হয়েছে "কোন কূটনীতিক তাঁকে গ্রহণকারী দেশের অর্থাৎ তিনি যে দেশে দায়িত্ব পালন করছেন সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। অবশ্য এই আইনের অধিকাংশ বিষয় হলো বিদেশী মিশন ও সেখানকার রাষ্ট্রদূত বা কূটনীতিকরা কী কী অধিকার ভোগ করবেন তার বিবরণ। যেমন দূতাবাসসমূহ হবে অলঙ্ঘনীয় স্থান। কূটনীতিকদেরকে ফৌজদারি কিংবা সিভিল কোন অভিযোগে বিচার বা আটক করা যাবে না। তাদের কোন দলিল দস্তাবেচ, কাগজপত্র খুলে দেখা যাবে না বা আটক করা যাবে না। তারা কোন কর বা শুল্কের আওতায় পড়বে না। তাদের অবাধ চলাফেরা ও যোগাযোগের সুযোগ করে দিতে হবে। তাদের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

অপরদিকে জেনেভা কনভেনশন হলো একটি আন্তর্জাতিক মানবিকতা বিষয়ক আইন যা চারটি চুক্তি ও তিনটি প্রোটকল এর সমন্বয়ে গঠিত হয়। ১৯৪৯ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

যুদ্ধকালীন সময়ে একজন আহত বা আত্মসমর্পণকারী সেনা বা যুদ্ধবন্দী সৈনিকদের মানবিক অধিকার, চিকিৎসা এবং বা অসামরিক নাগরিক যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন নাই বা পক্ষভুক্ত হন নাই যুদ্ধ এলাকায় তাদের নিরাপত্তা বিধান ইত্যাদি এ চুক্তির মূল বিষয়। সাধারণভাবে জেনেভা কনভেনশন স্বাক্ষরের সময় কাল হিসেবে ১৯৪৯ সালকে উল্লেখ করা হলেও এর প্রথম প্রস্তাবনাটি স্বাক্ষর হয়েছিল ১৮৬৪ সালে জেনেভায়। এর সাথে জড়িত রয়েছে বিখ্যাত আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা সংস্থা রেডক্রসের জন্ম এবং শান্তিতে প্রথম নোবেল বিজয়ী Henry Dunant এর হৃদয়বান উদ্যোমি উদ্যোগের ইতিহাস। একটু বিস্তারিত বলা যাক।

তখনো পাশাপাশি অবস্থিত তিনটি দেশ ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, ইতালি ইত্যাদি দেশের মানচিত্র আজকের মত রূপ পায়নি। বেশ কয়েক বছর হল তৎকালীন ইতালি এলাকায় নতুন জাতীয়তাবোধ শক্তিশালী হয়ে উঠছিলো একক ইতালি রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবিতে। দীর্ঘদিন ধরে ইতালির এ এলাকাগুলো ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও স্পেন এর অংশ হিসেবে এবং কোন কোন এলাকা স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিলো। ইতালি এলাকার এ রাজ্য গুলো একটি একক স্বাধীন ইতালি রাজ্য হিসেবে একীভূত হতে চাচ্ছিল। অন্যদিকে ফ্রান্সের নেতা নেপোলিয়ন চাইছিলেন অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্য'র প্রভাবকে খর্ব করতে। ভূ- রাজনৈতিক লাভের আশায় তিনি সার্দিনিয়ার (বর্তমানে ইতালি র অংশ) সাথে জোট করে অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাজি হলেন। শুরু হলো ফ্রান্স -সারদিনিয়া বনাম অস্ট্রিয়া যুদ্ধ।

১৮৫৯ সালের ২৪ জুন ভোর চারটা। নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফ্রান্স বাহিনী আর তার সঙ্গী ভিক্টর ইমানুয়েল এর নেতৃত্বে সারদিনিয়ান বাহিনী যাদের যৌথ নাম Franco-Sardian Alliance তাবু থেকে বেরিয়ে পড়ল মিনসিও নদীর ডানতীর দখলে নিয়ে ঘাঁটি করার উদ্দেশ্যে। ওদিকে অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের সম্রাট Franz Josep নিজেই যুদ্ধক্ষেত্রে নিজ বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। নেপালিয়ানের আগমনের খবর পেয়ে ফ্রান্স- সারদিনিয়ান বাহিনীকে প্রতিরোধে এগিয়ে আসলেন অস্ট্রিয়া সম্রাট। ভোর ছয়টায় যখন গ্রীষ্মের আলো ইতালির ল্যাম্বারডো'র এ পাহাড়ি এলাকায় উজ্জ্বল হয়ে কিরণ ছড়াচ্ছিল, তখন এ এলাকার Solferino গ্রামের আশেপাশে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। ইউরোপের ইতিহাসে এটিই সম্ভবত শেষ কোন বিখ্যাত যুদ্ধ যেখানে রাজা বা সম্রাটরা ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন। উভয় পক্ষের তিন লক্ষ সৈনিক। ৯ ঘন্টার এ যুদ্ধে দুপক্ষের ক্ষতি প্রায় সমান। ২৩৮৬, অস্ট্রিয়ান সৈন্য, ২৪৯২ জন ফ্রাঙ্কো -সারদিয়ান সৈন্য প্রাণ হারায়। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হয়ে পড়েছিল উভয় পক্ষের প্রায় ২০-২৫ হাজার সৈন্য। উভয় পক্ষই গুলি এবং বেয়োনেট ব্যবহার করে আহতদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যুদ্ধের বিভীষিকা বাড়িয়ে দিয়েছিল। বিশাল সংখ্যক আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার মতো সক্ষমতা কোন পক্ষেরই ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রের পাশেই ক্যাষ্টিগলিয়ন নামক স্থানে এক চার্চে তখন অবস্থান করছিলেন সুইজারল্যান্ডের এক তরুণ ব্যবসায়ী। নাম হেনরি ডোন্যান্ট। ব্যবসায়িক কাজেই তিনি ওই এলাকায় গিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে যুদ্ধক্ষেত্রের এখানে ওখানে পড়ে থাকা আহত সৈন্যদের দুর্দশা দেখে তিনি স্থির থাকতে পারলেন না। স্থানীয় মহিলা স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তা নিয়ে তিনি তাদের শুশ্রষা-চিকিৎসায় লেগে গেলেন। পক্ষ দেখেননি তিনি। উভয়পক্ষের সৈনিকদের প্রতি মানবিকতা দেখানোর জন্য তিনি স্থানীয় সবাইকে উৎসাহ দিয়ে বলতে লাগলেন.futti fratelli (all brothers/সকলেই ভাই). এই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি একটি বই লিখলেন -A memory of Solferino। এই ঘটনার পর নিজ দেশে ফিরে গিয়ে পক্ষপাতহীন ও নিরপেক্ষ মানবিক সহায়তা সংগঠন গড়ার কাজে হাত দিলেন। যুদ্ধাহতদের সহায়তা করার জন্য স্বেচ্ছায় ত্রান দানের জন্য তার এ প্রচেষ্টা থেকেই পরবর্তীতে ১৮৬৩ সালে International Committee of the Redcross প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অবদানের জন্য ১৯০১ সালে পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ডুন্যান্ট শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

আইসিআরসি প্রতিষ্ঠার পরের বছরই সুইজারল্যান্ড সরকার সকল ইউরোপীয় দেশের সরকার সহ আমেরিকা, ব্রাজিল এবং মেক্সিকোকে কূটনৈতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানায় জেনেভায়। ১৮৬৪ সালের ২২ আগস্ট এ সম্মেলনে গৃহীত হয় "প্রথম জেনেভা কনভেনশন" যার শিরোনাম ছিল- "The Amelioration of the condition of the wounded in Armies in the field." যুদ্ধক্ষেত্রের সৈন্যদের অবস্থার উন্নয়ন বিষয়ে চুক্তি। ১৬ টি দেশের ২৬ জন প্রতিনিধি অংশ নিলেও প্রথমবার ১২ টি দেশ চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মত হয়।

এরপর ১৯০৬ সালেও যুদ্ধাহত সৈনিকদের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে দ্বিতীয়বার কনভেনশন গৃহীত হয়।

এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা মাথায় নিয়ে ১৯২৯ সালের জুলাইয়ে দুটি কনভেনশন গৃহীত হয়। দুটিকে একত্রে থার্ড কনভেনশন বলা হয়। এখানে যুদ্ধবন্দির চিকিৎসা বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়।

এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ১৯৪৯ সালে অসামরিক ব্যক্তিদের সুরক্ষার বিষয় সংযুক্ত করে চতুর্থ কনভেনশনটি গৃহীত হয়। এচারটি কনভেনশনের পাশাপাশি চুক্তির অংশ হিসেবে কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগের নিমিত্ত পরবর্তীতে তিনটি পালনীয় আচার নির্দেশিকা (কূটনৈতিক শিষ্টাচার) বা প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়।

উল্লেখ্য কনভেনশন স্বাক্ষর করা মানেই প্রটোকল স্বাক্ষর করা বাধ্যতামূলক নয়। যেমন, বাংলাদেশ ০৪টি কনভেনশন ও দুটি প্রোটকল স্বাক্ষর করেছে অপরদিকে ভারত,পাকিস্তান মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশগুলি ০৪টি কনভেনশন স্বাক্ষর করলেও কোন প্রটোকল স্বাক্ষর করেনি। প্রটোকল গুলো মূলত আন্তর্জাতিক ও অ- আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংঘাত বিষয়ক।

বস্তুত যুদ্ধকালে যুদ্ধবন্দী, যুদ্ধাহত আত্মসমর্পণকারী, শত্রু সৈন্যদের মানবিক অধিকার সুরক্ষা এবং যুদ্ধাবস্থায় অসামরিক নিরস্ত্র জনসাধারণের সুরক্ষা ইত্যাদি হলো জেনেভা কনভেনশনের মূল বিষয়।

লেখক: শাব্বির আহম্মদ

সংবাদটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ

যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভে নিজের গায়ে আগুন দিলেন এক ব্যক্তি

নাসরুল্লাহর ‘উত্তরসূরির’ সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়েছে হিজবুল্লাহ

বৈরুতে বোমা হামলা, গাজার মসজিদে হামলায় ২১ ফিলিস্তিনি নিহত

গাজার ৭৯ শতাংশ মসজিদ ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েল

আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই: লেবাননের প্রবাসী গৃহকর্মী

লেবাননে ইসরায়েলের হামলায় নিহতের সংখ্যা ২০০০ ছাড়িয়েছে

ছত্তীসগড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৩৬ মাওবাদী নিহত

৯ বছর পর পাকিস্তান সফরে যাচ্ছেন ভারতের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী

জাতিসংঘ মহাসচিবকে নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন, নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন

ইসরায়েলে হামাস ও ইরানের হামলা ‘বৈধ’: আয়াতুল্লাহ খামেনি

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :