সেনাবাহিনীতে যোগদানে আপত্তি, তরুণ-তরুণীদের গ্রেপ্তার করছে মিয়ানমার জান্তা

সেনাবাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক–সংক্রান্ত আইনটি কার্যকর করার পর থেকে অসংখ্য তরুণ-তরুণীকে গ্রেপ্তার করেছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। এর মধ্যে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শুধু মান্দালয়ের শহরের ছয় টাউনশিপে অন্তত ৮০ তরুণ-তরুণীকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেছে। তবে এই সংখ্যা বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম দ্য ইরাবতি।
মান্দালয়ের বাসিন্দাদের বরাতে ইরাবতি বলছে, গত ১৫ ফেব্রুয়ারির পর থেকে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়েছে। জান্তা সেনা, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা যৌথভাবে ঘরে ঘরে গিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছেন। প্রতিটি বাড়ির লোকসংখ্যা গণনা করে দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে সেই বাড়িতে অন্য কেউ রাতে থাকেন কি না, তারও খোঁজ করা হচ্ছে।
মান্দালয়ের এক বাসিন্দা ইরাবতিকে বলেন, সেনাবাহিনীতে তরুণ-তরুণীদের বাধ্যতামূলক যোগদান আইনটি কার্যকর করার পর থেকে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি বেড়েছে। তল্লাশির সময় তরুণ-তরুণীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগ-সংক্রান্ত একটি আইন কার্যকর করার ঘোষণা দেন মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং। এ আইন অনুযায়ী ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সি পুরুষ এবং ১৮ থেকে ২৭ বছর বয়সি নারীরা সর্বনিম্ন দুই বছর ও সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে বাধ্য থাকবে।
মিয়ানমারের বিভিন্ন রাজ্যে লড়াইরত সশস্ত্র বিদ্রোহীদের মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে জান্তা বাহিনী। দেশটির বেশ কিছু রাজ্যে জান্তা বাহিনী বিদ্রোহীদের কাছে সামরিক ঘাঁটি, সেনাচৌকি ও শহরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।
২০২১ সালে এক অভ্যুত্থানে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর থেকে মিয়ানমারে বিশৃঙ্খলা চলছে। গত অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্রোহীদের কাছে বিভিন্ন রাজ্যে ব্যাপক পরাজয়ের পর নতুন নিয়োগে আইনটি কার্যকর করা হয়। যা কর্তৃপক্ষকে ব্যক্তিগত বাড়িগুলোতে পরোয়ানাহীন তল্লাশি চালানোর অনুমতি দেয় এবং সমস্ত বাড়িতে আগত অতিথিদের নিবন্ধন করতে হয়। আগে এই ধরনের অনুসন্ধানগুলো মূলত রাতে পরিচালিত হতো। তবে জান্তা সৈন্যরাও দিনের বেলা মান্দালেতে বাড়িঘরে তল্লাশি চালাচ্ছে।
এদিকে মান্দালয়ের একজন সাবেক রাজনৈতিক বন্দি বলেছেন, ‘জান্তার এই ধরনের পদক্ষেপ অর্থের জন্য। জান্তা সৈন্যরা অতিথিদের নিবন্ধন অজুহাতে আটক ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করছে এবং অর্থ প্রদানের পর আটক ব্যক্তিদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।’
প্রসঙ্গত, গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক জান্তার নতুন করে ক্ষমতা দখলের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। তবে প্রথম আড়াই বছর সামরিক বাহিনী দমনপীড়নের মাধ্যমে যতটা সহজে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছে, পরে সে দৃশ্য অনেকটাই বদলে গেছে।
২০২১ সালের এপ্রিলেই ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেতৃত্বে নির্বাচনে জয়ী সদস্যরা জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করে, যাকে সংক্ষেপে বলা হয় এনইউজি। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরাও এতে যোগ দেয়।
সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে থাকা বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে মিলে তারা প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে এবং সব গোষ্ঠীর সমন্বয়ে তৈরি করে ‘পিপল ডিফেন্স ফোর্স’।
সামরিক বাহিনীর দমনপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা সক্রিয় থাকলেও এটি নতুন মাত্রা পায় উত্তরাঞ্চলের তিনটি বিদ্রোহী বাহিনীর এককাট্টা হয়ে আক্রমণ শুরুর পর।
২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর একজোট হয়ে হামলা চালায় দেশটির উত্তরের জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু তিনটি বিদ্রোহী বাহিনী, যাদের একসঙ্গে ডাকা হচ্ছে 'থ্রি গ্রুপ অ্যালায়েন্স' নামে।
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ) নিয়ে এই জোট গঠন করা হয়েছে। তারা একে নাম দেয় ‘অপারেশন ১০২৭’। এছাড়াও শত শত স্বেচ্ছাসেবী জাতিগত বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয়। তাদের সাথে অস্ত্রে সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে দুই বছরের আপাত অচলাবস্থার অবসান ঘটে। ফলে সামরিক বাহিনীকে এই মুহূর্তে নানা ধরনের হামলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আর তা কেবল একটি জায়গাতেই না বরং দেশব্যাপী।
দেশটির থিংক ট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি এন্ড পলিসি (আইএসপি) মিয়ানমারের তথ্য অনুযায়ী, সামরিক বাহিনী এরই মধ্যে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে ৪৩ শতাংশেরও বেশি জায়গা হারিয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/২৯ফেব্রুয়ারি/এমআর)

মন্তব্য করুন