ঐতিহাসিক বদর দিবস ও ইসলামের প্রথম বিজয়
বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ যা মুসলিম ও কাফিরদের মধ্যে দ্বিতীয় হিজরীতে সংগঠিত হয়। এই যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিমরা সংখ্যায় অনেক কম হয়েও মক্কার কাফির শক্তিকে পরাজিত করে ইসলামের স্বর্নোজ্জল সূচনার সৃষ্টি করেন। এর মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সূচিত হয়ে যায়। এজন্য এই যুদ্ধকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী বলা হয়। আল-কুরআনে এই দিনকে ইয়াওমূল ফুরক্বান বলা হয়।
বদর যুদ্ধের পরোক্ষ কারণ:
২য় হিজরী সনের ১৭ই রামাযান (৬২৪ খৃঃ ১১ই মার্চ শুক্রবার (সুলায়মান মানছূরপুরী বলেন, ৩রা মার্চ মঙ্গলবার) ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যা ছিল মদীনায় হিজরতের মাত্র ১ বছর ৬ মাস ২৭ দিন পরের ঘটনা। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ (দঃ)-কে মদীনা থেকে বের করে দেবার জন্য নানাবিধ অপচেষ্টা চালায়। যেমনভাবে তারা ইতিপূর্বে হাবশায় হিযরতকারী মুসলমানদের সেখান থেকে বের করে দেবার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু সেখানে তারা ব্যর্থ হয়েছিল ।
১. মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের নিকটে কুরাইশ নেতাদের পত্র প্রেরণ। সে তখনও ইসলাম গ্রহণ করেনি। রাসূলের আগমনের কারণে তার ইয়াছরিবের নেতৃত্ব লাভের মোক্ষম সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় সে ছিল দারুণভাবে ক্ষুব্ধ। রাসূলের প্রতি তার এই ক্ষোভটাকেই কুরাইশরা কাজে লাগায় এবং নিম্নোক্ত কঠোর ভাষায় হুমকি দিয়ে তার নিকটে চিঠি পাঠায়।-
انكم آويتم صاحبنا وإنا نقسم بالله تقاتله أ
لتجرجنه أو لنسيرن إليكم بأجمعنا حتى نقتل مقاتلتكم ونستبيح نساءكم-
‘তোমরা আমাদের লোকটিকে (মুহাম্মাদকে) আশ্রয় দিয়েছ। এজন্য আমরা আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, হয় তোমরা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে ও তাকে বের করে দিবে অথবা আমরা তোমাদের উপরে সর্বশক্তি নিয়ে হামলা করব এবং তোমাদের যোদ্ধাদের হত্যা করব ও মহিলাদের হালাল করে নেব’।
এই পত্র পেয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই দ্রুত তার সমমনাদের সাথে গোপনে বৈঠকে বসে গেল। খবর পেয়ে রাসূলুল্লাহ (দঃ) সেখানে গিয়ে বলেন, أتريدون أن تقاتلوا أبناءكم وإخوانكم ‘তোমরা কি তোমাদের সন্তান ও ভাইদের সাথে (অর্থাৎ মুসলমানদের সাথে) যুদ্ধ করতে চাও’? রাসূলের মুখে এ বক্তব্য শুনে বৈঠক ভেঙ্গে গেল ও দল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ।
২. আওস গোত্রের নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) ওমরাহ করার জন্য মক্কায় যান ও কুরাইশ নেতা উমাইয়া বিন খালাফের অতিথি হন। উমাইয়ার ব্যবস্থাপনায় দুপুরে নিরিবিলি ত্বাওয়াফ করতে দেখে আবু জাহল তাকে ধমকের সুরে বলে, ألا أراك تطوف بمكة آمنا وقد آويتم الصباة؟ তোমাকে দেখছি মক্কায় বড় নিরাপদে ত্বাওয়াফ করছ। অথচ তোমরা বেদ্বীনগুলোকে আশ্রয় দিয়েছ!
আল্লাহর কসম! যদি তুমি আবু ছাফওয়ানের (উমাইয়া বিন খালাফের) সাথে না থাকতে, তবে নিরাপদে ফিরে যেতে পারতে না’। একথা শুনে সা‘দ চীৎকার দিয়ে বলে ওঠেন, তুমি আমাকে এখানে বাধা হয়ে দাঁড়ালে আমি তোমার জন্য এর চেয়ে কঠিন বাধা হয়ে দাড়াবো- আর সেটা হ’ল মদীনা হয়ে তোমাদের ব্যবসায়ের রাস্তা বন্ধ হবে’।
৩. কুরায়েশ নেতারা ইহুদীদের সাথে গোপনে আঁতাত করলো। অতঃপর মুহাজিরগণের নিকটে হুমকি পাঠালো এই মর্মে যে, ‘মক্কা থেকে তোমরা নিরাপদে ইয়াছরিবে পালিয়ে যেতে পেরেছ বলে অহংকারে ফেটে পড়ো না। ওখানে গিয়েই আমরা তোমাদের ধ্বংস করে দেবার ক্ষমতা রাখি’। তাদের এই হুমকি কেবল ফাঁকা বুলি ছিল না। বরং তারা হর-হামেশা তৎপর ছিল মুহাজিরগণের সর্বনাশ করার জন্য। রাসূলুল্লাহ (দঃ) এতই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতেন না।
আল্লাহর আদেশ:
কুরাইশদের সন্ত্রাসমূলক অপতৎপরতা ও প্রকাশ্যে হামলা সমূহ মুকাবিলার জন্য আল্লাহ পাক মুসলমানদেরকে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে এ সময় নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন,
أُذِنَ لِلَّذِيْنَ يُقَاتَلُوْنَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوْا وَإِنَّ اللهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيْرٌ- ‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হ’ল ঐ লোকদের। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে, একারণে যে, তারা অত্যাচারিত হয়েছে। আর তাদেরকে সাহায্য করার ব্যাপারে অবশ্যই আল্লাহ ক্ষমতাবান’ (হজ্জ ২২/৩৯)।
এরপর ১ম হিজরীর রামাযান মাস থেকে কুরাইশদের হামলা প্রতিরোধে মদীনার বাইরে নিয়মিত সশস্ত্র টহল অভিযান সমূহ প্রেরিত হয়ে থাকে। যা একবছর অব্যাহত থাকে। অতঃপর ২য় হিজরীর শা‘বানে নাখলা যুদ্ধের পর বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে জিহাদ ফরয হয় এবং উক্ত মর্মে সূরা বাক্বারার ২/১৯০-১৯৩ এবং সূরা মুহাম্মাদ ৪৭/৪-৭ ও ২০ আয়াত সমূহ নাযিল হয়।
বদর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ:
রাসূলুল্লাহ (দ.) সিরিয়া ফেরত মক্কার ব্যবসায়ী কাফেলার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও তাদের সকল খবরাখবর সংগ্রহের জন্য তালহা বিন উবায়দুল্লাহ ও সাঈদ বিন যায়েদকে প্রেরণ করেন। তারা ‘হাওরা’ (الحوراء) নামক স্থানে পৌঁছে জানতে পারেন যে, আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে বিরাট এক ব্যবসায়ী কাফেলা সত্বর ঐ স্থান অতিক্রম করবে; যাতে রয়েছে এক হাযার উট বোঝাই কমপক্ষে ৫০,০০০ স্বর্ণমুদ্রার মাল-সম্পদ এবং তাদের প্রহরায় রয়েছে আমর ইবনুল আছ সহ মাত্র ৪০ জন সশস্ত্র জোয়ান। উল্লেখ্য যে, এই বাণিজ্যে মক্কার সকল নারী-পুরুষ অংশীদার ছিল। তারা দ্রুত মদীনায় ফিরে এসে রাসূলকে এই খবর দেন। রাসূলুল্লাহ (দঃ) চিন্তা করলেন যে, এই বিপুল মাল-সম্পদ মক্কায় পৌঁছে গেলে তার প্রায় সবই ব্যবহার করা হবে মদীনায় মুহাজিরগণকে ধ্বংস করার কাজে। অতএব আর মোটেই কালক্ষেপন না করে তখনই বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন ওই কাফেলাকে আটকানোর জন্য।
বদর যুদ্ধের বিবরণ:
মাদানী বাহিনীর অগ্রযাত্রা : ২য় হিজরীর ১৭ রামাযান ৬২৪ খৃঃ ১১ মার্চ শুক্রবার । বিগত অভিযানগুলির ন্যায় এ অভিযানেরও উদ্দেশ্য ছিল কুরাইশ কাফেলাকে আটকানো। তাই অন্যান্য অভিযানের মতই এটাকে ভাবা হয়েছিল। ফলে রাসূলুল্লাহ (দঃ) কাউকে অভিযানে যেতে বাধ্য করেননি। অবশেষে ৮ অথবা ১২ই রামাযান তারিখে ৩১৩, ১৪ বা ১৭ জনের কাফেলা নিয়ে সাধারণ প্রস্তুতি সহ তিনি রওয়ানা হলেন।
সৈন্য ও যুদ্ধ সরঞ্জাম:
সৈন্যদের মধ্যে ৮২, ৮৩ বা ৮৬ জন ছিলেন মুহাজির এবং বাকীগণ ছিলেন আনছার। আনছারগণের মধ্যে ৬১ জন ছিলেন আউস গোত্রের এবং ১৭০ জন ছিলেন খাযরাজের। বি’রে সুক্বইয়া নামক স্থানে এসে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ক্বায়েস ইবনু আবী ছা‘ছা‘কে সংখ্যা গণনা করতে বললেন। পরে সংখ্যা জানতে পেরে রাসূল (দঃ) খুশী হয়ে বললেন, তালূতের সৈন্য সংখ্যাও তাই ছিল। এটা বিজয়ের লক্ষণ। তিন শতাধিক লোকের এই বাহিনীতে মাত্র ২টি ঘোড়া ছিল যুবায়ের ইবনুল আওয়াম এবং মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদের এবং ৭০টি উট ছিল।
বাহন কম হওয়াতে দু’তিন জন করে পালাক্রমে সওয়ার হয়ে চলতে হ’ত। রাসূল (দঃ), আলী ও মারছাদ বিন আবী মারছাদ গানাভীর জন্য একটি উট বরাদ্দ ছিল। তারা পায়ে হাঁটার পালা আসলে রাসূল (দঃ) নিজেও হাঁটতেন। এ সময় মদীনায় আমীর নিযুক্ত হন অন্ধ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম। পরে ‘রাওহা’ بئر الروحاء নামক স্থানে পৌঁছে আবু লুবাবা ইবনু আবদিল মুনযিরকে ‘আমীর’ নিযুক্ত করে পাঠানো হয়।
অপর পক্ষে কাফেলার পতাকা বহনের দায়িত্ব দেওয়া হয় মদীনার প্রথম দাঈ মুসআব বিন উমায়েরকে। ইতিপূর্বেকার সকল পতাকার ন্যায় আজকের এ পতাকাও ছিল শ্বেত বর্ণের। ডান বাহুর সেনাপতি নিযুক্ত হন যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম এবং বাম বাহুর জন্য মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ)। পুরা বাহিনীতে এ দু’জনেরই মাত্র দু’টি ঘোড়া ছিল। আর পশ্চাদ্ভাগের সেনাপতি নিযুক্ত হন ক্বায়েস ইবনু আবী ছা‘ছা‘আহ (রাঃ)। এতদ্ব্যতীত মুহাজিরগণের পতাকা বাহক হন আলী (রাঃ) এবং আনছারগণের সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ)। আর সার্বিক কম্যান্ডের দায়িত্বে থাকেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (দঃ) নিজেই।
কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলার অবস্থা:
এদিকে কুরাইশ কাফেলার নেতা আবু সুফিয়ান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পথ চলছিলেন। যাকেই পেতেন, তাকেই মদীনা বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। তিনি একটি সূত্রে জানতে পারলেন যে, কাফেলার উপরে হামলা করার জন্য মুহাম্মাদ (দঃ) নির্দেশ দিয়েছেন।
এ সংবাদে ভীত হয়ে আবু সুফিয়ান একজনকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন, যাতে দ্রুত সাহায্যকারী বাহিনী পৌঁছে যায়। এরপর বদর প্রান্তর অতিক্রম করার আগেই তিনি কাফেলা থামিয়ে দিয়ে নিজে অগ্রসর হন ও মদীনা বাহিনীর খবর নেন এবং জানতে পারেন যে, দু’জন উষ্ট্রারোহীকে তারা দেখেছিল, যারা টিলার পাশে তাদের উট বসিয়ে মশকে পানি ভরে নিয়ে চলে গেছে। সুচতুর আবু সুফিয়ান সঙ্গে সঙ্গে টিলার পাশে গিয়ে উটের গোবর থেকে খেজুরের অাঁটি খুঁজে পেয়ে বুঝে নিলেন যে, এটি মদীনার উট।
ব্যস! তখনই ফিরে এসে কাফেলাকে নিয়ে বদরের পথ ছেড়ে ডান দিক দিয়ে উপকূলের পথে চলে গেলেন এবং এভাবে তিনি স্বীয় কাফেলাকে মদীনা বাহিনীর কবল থেকে বাঁচিয়ে নিতে সক্ষম হ’লেন। অতঃপর তিনি নিরাপদে পার হয়ে আসার খবর মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন। যাতে ইতিপূর্বে পাঠানো খবরের রেশ ধরে তারা অহেতুক যুদ্ধে বের না হয়।
আবু জাহেলের প্রস্তুতি:
কিন্তু এখবর যখন মক্কায় পৌঁছাল, তখন আবু জাহেলের নেতৃত্বে ১৩০০ মাক্কী ফৌজ রওয়ানা হয়ে জুহফা নামক স্থানে পৌঁছে গেছে। অতঃপর আবু সুফিয়ানের এ খবর পেয়ে মাক্কী বাহিনীর সবাই মক্কায় ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করল। কিন্তু আবু জাহলের অহংকারের ফলে কারো মতামত গ্রাহ্য হল না। কিছু গোত্র তাকে উপেক্ষা করে ফিরে যায়।
কিন্তু আবু জাহেল বদর অভিমুখে রওয়ানা হন এবং গর্বভরে বলেন, "আল্লাহর কসম! আমরা বদরে যাব ও সেখানে তিনদিন থাকব ও আমোদ-ফূর্তি করে পান ভোজন করব। এর ফলে সমগ্র আরব জাতির উপরে আমাদের শক্তি প্রকাশিত হবে ও সকলে ভীত হবে"। এই সময় সব মিলিয়ে মাক্কী বাহিনীতে এক হাযার ফৌজ ছিল। তন্মধ্যে দু’শো অশ্বারোহী, ছয়শো লৌহবর্ম ধারী এবং গায়িকা বাঁদী দল তাদের বাদ্যযন্ত্রাদি সহ ছিল। প্রতি মনযিলে খাদ্যের জন্য তারা ১০টি করে উট যবেহ করত।
আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলার নিরাপদে নিষ্ক্রমন এবং আবু জাহেলের নেতৃত্বে মাক্কী বাহিনীর দ্রুত ধেয়ে আসা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (দঃ) যাফরানে (ذفران) অবস্থান কালেই যথাসময়ে অবহিত হন। এই অনাকাংখিত পরিস্থিতি এবং অবশ্যম্ভাবী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মুকাবিলা কিভাবে করা যায়, এ নিয়ে তিনি উচ্চ পর্যায়ের পরামর্শ বৈঠক আহবান করলেন।
রাসুল (দ.) এর পরামর্শ আহ্বান:
মুহাজিরগণের মধ্যে হযরত আবুবকর ও ওমর (রাঃ) তাদের মূল্যবান পরামর্শ দান করলেন। অতঃপর মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ) দাঁড়িয়ে তেজস্বিনী ভাষায় বললেন, يارسول الله امض لما أراك الله فنحن معك والله لا نقول لك كما قالت بنو اسرائيل لموسى اذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلاَ إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُوْنَ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর দেখানো পথে আপনি এগিয়ে চলুন। আমরা আপনার সঙ্গে আছি।
আল্লাহর কসম! আমরা আপনাকে ঐরূপ বলব না, যেরূপ বনু ইস্রাঈল তাদের নবী মূসাকে বলেছিল যে, ‘তুমি ও তোমার রব যাও যুদ্ধ কর গিয়ে,আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদাহ ৫/২৪)।
বরং আমরা বলব, اذهب انت وربك فقاتلا انا معكما مقاتلون، ‘আপনি ও আপনার রব যান ও যুদ্ধ করুন, আমরা আপনাদের সাহায্যে যুদ্ধরত থাকব’।فو الذى بعثك بالحق لوسرت بنا إلى برك الغماد لجادلنا معك من دونه حتى تبلغه، সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, যদি আপনি আমাদেরকে নিয়ে আবিসিনিয়ার ‘বারকুল গিমাদ’ (برك الغماد) পর্যন্ত চলে যান, তবে আমরা অবশ্যই আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সেই পর্যন্ত পৌঁছে যাব’। মিক্বদাদের এই জোরালো বক্তব্য শুনে আল্লাহর রাসূল খুবই প্রীত হ’লেন এবং তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন’ (دعا له بخير)।
সংখ্যালঘু মুহাজিরগণের উপরোক্ত তিন নেতার বক্তব্য শোনার পর সংখ্যাগুরু আনছারদের পরামর্শ চাইলে আউস গোত্রের নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) বললেন, হে রাসূল! আপনি হয়ত আশংকা করছেন যে, আমাদের সঙ্গে আপনার চুক্তি অনুযায়ী আনছারগণ কেবল (মদীনার) শহরে অবস্থান করেই আপনাদের সাহায্য করা কর্তব্য মনে করে। জেনে রাখুন, আমি আনছারদের পক্ষ থেকেই বলছি, যেখানে ইচ্ছা হয় আপনি আমাদের নিয়ে চলুন। যার সঙ্গে খুশী আপনি সন্ধি করুন বা ছিন্ন করুন- সর্বাবস্থায় আমরা আপনার সাথে আছি। যদি আপনি অগ্রসর হয়ে হাবশার বারকুল গিমাদ পর্যন্ত চলে যান, তাহ’লে আমরা আপনার সাথেই থাকব। والله لئن استعرضت بنا هذا البحر فخضته لخضناه معك আর যদি আমাদেরকে নিয়ে আপনি এই সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তবে আমরাও আপনার সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ব’। ما تخلف منا رجل واحد، فسر بنا على بركة الله، ‘আমাদের একজন লোকও পিছনে থাকবে না। অতএব আপনি আমাদের নিয়ে আল্লাহর নামে এগিয়ে চলুন’। হযরত সা‘দের উক্ত কথা শুনে আল্লাহর রাসূল (দঃ) খুবই খুশী হ’লেন ও
উদ্দীপিত হয়ে বললেন, سيروا وأبشروا فان الله تعالى قد وعدنى إحدى الطائفتين، والله لكانى الآن انظر إلى مصارع القوم، ‘চলো এবং সুসংবাদ গ্রহণ কর। কেননা আল্লাহ তা‘আলা আমাকে দু’টি দলের কোন একটির বিজয় সম্পর্কে ওয়াদা দান করেছেন। আল্লাহর কসম! আমি এখন ওদের বধ্যভূমিগুলো দেখতে পাচ্ছি’।
সিদ্ধান্ত গ্রহণ:
পরামর্শ সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর আল্লাহর রাসূল (দঃ) বদর অভিমুখে রওয়ানা হলেন। অতঃপর বদর প্রান্তরের নিকটবর্তী স্থানে অবতরণ করেন। বদর হ’ল মদীনা থেকে ৬০ মাইল পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত একটি বাণিজ্য কেন্দ্রের নাম। যেখানে পানির প্রাচুর্য থাকায় স্থানটির গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। ২য় হিজরীর ১৭ রামাদান মোতাবেক ৬২৪ খৃষ্টাব্দের ১১ই মার্চ শুক্রবার এখানেই সংঘটিত হয় তাওহীদ ও শিরকের মধ্যকার প্রথম সশস্ত্র মুকাবিলা।
কুরাইশের ওপর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ:
এরপর রাসূলুল্লাহ (দঃ) আলী, যুবায়ের ও সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছের নেতৃত্বে একটি গোয়েন্দা দল পাঠান শত্রু পক্ষের আরও তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য। তারা গিয়ে দেখেন যে, দু’জন লোক বদরের ঝর্ণাধারা থেকে পানির মশক ভরছে। তাঁরা তাদের পাকড়াও করে নিয়ে এলেন। অতঃপর জিজ্ঞাসাবাদে ও সামান্য পিটুনী দেওয়ার পরে জানতে পারলেন যে, তারা কুরাইশ বাহিনীর লোক এবং কুরাইশ বাহিনী উপত্যকার শেষপ্রান্তে টিলার অপর পার্শ্বে শিবির গেড়েছে। তবে তারা সঠিক সংখ্যা বলতে পারল না। রাসূলুল্লাহ (দঃ) জিজ্ঞেস করলেন, দৈনিক কয়টা উট যবহ করা হয়? তারা বলল, নয়টি অথবা দশটি। রাসূলুল্লাহ (দঃ) বললেন, তাহ’লে ওদের সংখ্যা নয়শত অথবা হাজার এর মধ্যে হবে’। তারপর ওদের নেতৃবর্গের নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি মক্কার সেরা ব্যক্তিবর্গের নামগুলি শুনে দুঃখে ও বিস্ময়ে বলে উঠলেনهذه مكة قد ألقت إليكم أفلاذ كبدها- ‘মক্কা তার কলিজার টুকরাগুলোকে তোমাদের কাছে নিক্ষেপ করেছে’।
এরপর রাসূলুল্লাহ (দ.)-এর নির্দেশে মুসলিম বাহিনী দ্রুত গিয়ে এশার সময় বদরের উপরে দখল নেন, যা ছিল ঝর্ণাধারার পাশেই’। রাসূলুল্লাহ (দ.) সামরিক বিষয়ে দক্ষ ছাহাবী হোবাব ইবনুল মুনযির ইবনুল জামূহ-এর পরামর্শে কুরাইশ বাহিনীর নিকটবর্তী পানির প্রস্রবণ দখলে নেন।
১৭ই রামাযান শুক্রবারের রাত, বদর যুদ্ধের পূর্বরাত। সৈন্যদের শ্রেণীবিন্যাস শেষ হয়েছে। সবাই ক্লান্ত-শ্রান্ত। হঠাৎ বৃষ্টি এলো। মুসলিম বাহিনী ঘুমে এলিয়ে পড়ল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বাহিনীর সকল ক্লান্তি দূর হয়ে গেল এবং যুদ্ধের জন্য দেহমন প্রস্ত্তত হয়ে গেল। বালু-কংকর সব জমে শক্ত হয়ে গেল। ফলে চলাফেরায় স্বাচ্ছন্দ্য এলো। সেই সাথে অধিক হারে পানি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেল।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, إِذْ يُغَشِّيْكُمُ النُّعَاسَ أَمَنَةً مِّنْهُ وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُم مِّنَ السَّمَاءِ مَاءً لِّيُطَهِّرَكُمْ بِهِ وَيُذْهِبَ عَنْكُمْ رِجْزَ الشَّيْطَانِ وَلِيَرْبِطَ عَلَى قُلُوبِكُمْ وَيُثَبِّتَ بِهِ الأَقْدَامَ-
‘স্মরণ কর সে সময়ের কথা, যখন তোমাদের স্বস্তির জন্য তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করা হয় এবং তোমাদের উপরে তিনি আসমান হতে বারি বর্ষণ করেন। তোমাদেরকে পবিত্র করার জন্য, তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা দূরীভূত করার জন্য। তোমাদের হৃদয়গুলি পরস্পরে আবদ্ধ করার জন্য এবং তোমাদের পাগুলি দৃঢ় রাখার জন্য’ (আন‘ফাল ৮/১১)।
প্রত্যুষে কুরাইশ বাহিনী পাহাড় থেকে নীচে অবতরণ করে হতবাক হয়ে গেল। পানির উৎসের উপরে রাতারাতি মুসলিম বাহিনীর দখল কায়েম হয়ে গেছে। হাকীম বিন হেযাম সহ অতি উৎসাহী কয়েকজন কুরাইশ সেনা সরাসরি রাসূলের (দঃ) টিলার সম্মুখস্থ পানির কূপের দিকে অগ্রসর হল।
রাসূলুল্লাহ (দ.) তাদেরকে পানির কূপ ছেড়ে দেবার নির্দেশ দিলেন। ফলে যারা সেখান থেকে পানি পান করল, তারা সবাই পরে যুদ্ধে নিহত হল। একমাত্র হাকীম পান করেনি। সে বেঁচে গেল। পরে সে পাক্কা মুসলমান হ’ল।
কুরাইশ নেতারা অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে পারল এবং নিজেদের বোকামিতে দুঃখে-ক্ষোভে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল। তারা মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ও অবস্থা নিরূপনের জন্য উমায়ের বিন ওয়াহাব আল-জুমাহী নামক একজন অশ্বারোহীকে প্রেরণ করল। সে গিয়ে মুসলিম বাহিনীর চারদিক প্রদক্ষিণ করে এসে বলল, তিন শো বা তার কিছু কমবেশী হবে’। এরপর আবু জাহলের নেতৃত্ত্বে কুরাভশরা দ্রুত ধেয়ে এল মুসলিম বাহিনীর দিকে।
রাসূলুল্লাহ (দঃ) আল্লাহর নিকটে বিজয়ের জন্য দো‘আ করলেন। অতঃপর লাল উটের উপরে সওয়ার উৎবা বিন রাবী‘আহর দিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, إن يطيعوه يَرْشُدُوْا ‘যদি তার দল তার আনুগত্য করত, তাহ’লে তারা সঠিক পথে থাকতো’। অর্থাৎ যদি তারা উৎবাহর কথামত মক্কায় ফিরে যেত, তাহ’লে তাদের মঙ্গল হ’ত। এর মধ্যে রাসূলের শান্তিবাদী নীতি ফুটে ওঠে।
মাক্কী বাহিনী যখন মাদানী বাহিনীর নিকটবর্তী হ’ল, তখন আবু জাহল আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করে বললেন, اللهم أقطعَنا للرحم وآتانا بما لايعرف فأحنه الغداة- ‘হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যকার অধিক আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী এবং অজানা বিপদ সমূহের আনয়নকারী যে দল, তুমি তাদেরকে আগামীকাল সকালে ধ্বংস করে দাও’। এভাবে তিনি নিজের প্রার্থনা দ্বারা নিজের উপর ধ্বংস ডেকে নিলেন।
যুদ্ধের মাঠে হযরতের দয়ার নির্দেশ:
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (দ.) তাদেরকে বললেন, চূড়ান্ত নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কেউ যুদ্ধ শুরু করবে না। ব্যাপক হারে তীরবৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত কেউ তীর ছুঁড়বে না এবং তোমাদের উপরে তরবারি ছেয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তরবারি চালনা করবে না।
তিনি আরও বলেন যে, বনু হাশেমকে জোর করে যুদ্ধে আনা হয়েছে। তাদের সাথে আমাদের কোন যুদ্ধ নয়। অতএব তাদের কোন ব্যক্তি সামনে পড়ে গেলে তাকে যেন কেউ আঘাত না করে। আববাসকে যেন হত্যা না করা হয়। অনুরূপভাবে আবুল বুখতারী বিন হেশামকেও হত্যা করো না। কেননা এরা মক্কায় আমাদের কোনরূপ কষ্ট দিত না। বরং সাহায্যকারী ছিল। এই সময় বদর যুদ্ধের যে পতাকা রাসূলের হাতে ছিল, তা ছিল হযরত আয়েশার ওড়না দিয়ে তৈরী।
বদর যুদ্ধের সম্মুখ দামামা:
এরপর যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠলো এবং সে যুগের নিয়ম অনুযায়ী কুরাইশ পক্ষ মুসলিম পক্ষের বীরযোদ্ধাদের দ্বৈতযুদ্ধে আহবান করল। তাদের একই পরিবারের তিনজন সেরা অশ্বারোহী বীর উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ এবং অলীদ বিন উৎবা এগিয়ে এল। জবাবে মুসলিম পক্ষ হ’তে মু‘আয ও মু‘আবিবয বিন আফরা কিশোর দুই ভাই ও আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা তিনজন আনছার তরুণ যুবক বীরদর্পে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু কুরাইশ পক্ষ বলে উঠলো হে মুহাম্মাদ! আমাদের স্বগোত্রীয় সমকক্ষদের পাঠাও’।
তখন রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলেন, হে ওবায়দাহ, হে হামযাহ, হে আলী তোমরা যাও। অতঃপর আলী তার প্রতিপক্ষ অলীদ বিন উৎবাহকে, হামযাহ তার প্রতিপক্ষ শায়বাহ বিন রাবী‘আহকে এক নিমিষেই খতম করে ফেললেন। ওদিকে বৃদ্ধ ওবায়দাহ ইবনুল হারেছ তার প্রতিপক্ষ উৎবা বিন রাবী‘আহর সঙ্গে যুদ্ধে আহত হ’লেন। তখন আলী ও হামযাহ তার সাহায্যে এগিয়ে এসে উৎবাহকে শেষ করে দেন ও ওবায়দাহকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। কিন্তু অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের ফলে যুদ্ধশেষে মদীনায় ফেরার পথে ৪র্থ বা ৫ম দিন ওবায়দাহ শাহাদাত বরণ করেন।
শুরুতেই কুরাইশ দিশোহারা:
প্রথম আঘাতেই সেরা তিনজন বীরযোদ্ধা ও গোত্র নেতাকে হারিয়ে কুরাইশ পক্ষ মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ সময় আল্লাহর রাসূল (দঃ) আল্লাহর নিকটে আকুলভাবে নিম্নোক্ত প্রার্থনা করেন,
اللَّهُمَّ أَنْجِزْ لِىْ مَا وَعَدْتَنِىْ اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَنْشُدُكَ عَهْدَكَ وَوَعْدَكَ ... اللَّهُمَّ إِنْ تَهْلِكْ هَذِهِ الْعِصَابَةُ لاَ تُعْبَدْ فِى الأَرْضِ بَعْدَ الْيَوْمِ أبَدًا-
‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে যে ওয়াদা দিয়েছিলে তা পূর্ণ কর। হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তোমার অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণের প্রার্থনা জানাচ্ছি।
হে আল্লাহ! যদি এই ক্ষুদ্র দলটি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে আজকের দিনের পরে তোমার ইবাদত করার মত কেউ আর ভূপৃষ্ঠে থাকবে না’।
তিনি প্রার্থনায় এমন আত্মভোলা ও বিনয়ী হয়ে ভেঙ্গে পড়লেন যে, তার স্কন্ধ হ’তে চাদর পড়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে আবুবকর ছুটে এসে তার চাদর উঠিয়ে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, حسبك يا رسول الله الححت على ربك হে রাসূল! যথেষ্ট হয়েছে, আপনার পালনকর্তার নিকটে আপনি চূড়ান্ত প্রার্থনা করেছেন’।
এ সময় আয়াত নাযিল হ’ল- إِذْ تَسْتَغِيْثُوْنَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّيْ مُمِدُّكُمْ بِأَلْفٍ مِّنَ الْمَلآئِكَةِ مُرْدِفِيْنَ- ‘যখন তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকটে কাতর প্রার্থনা করছিলে, তখন তিনি তোমাদের দো‘আ কবুল করলেন। আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা, যারা হবে ধারাবাহিক ভাবে অবতরণকারী’।
রাসূলুল্লাহ (দঃ) সালাত অবস্থায় এক সময় সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি হাসতে হাসতে জেগে উঠে বলেন, أبشر أبا بكر! أتانا نصر الله، هذا جبريل آخذ بعنان فرسه، عليه أداة الحرب- আবুবকর! সুসংবাদ নাও। আল্লাহর সাহায্য এসে গেছে। ঐ যে জিবরিল (আঃ) যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে তার ঘোড়ার লাগাম ধরে টিলার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। অতঃপর তিনি سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّوْنَ الدُّبُرَ- (‘সত্বর দলটি পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালাবে’)
মুসলিম বাহিনীর এই হামলার প্রচন্ডতার সাথে সাথে যোগ হয় ফেরেশতাগণের হামলা। ইকরিমা বিন আবু জাহল (যিনি ঐ যুদ্ধে পিতার সাথে শরীক ছিলেন এবং মক্কা বিজয়ের পরে মুসলমান হন) বলেন, ঐদিন আমাদের লোকদের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যেতো, অথচ দেখা যেতো না কে মারলো (তাবাক্বাতে ইবনু সা‘দ)।
আবু দাঊদ আল-মাযেনী বলেন, আমি একজন মুশরিক সৈন্যকে মারতে উদ্যত হব। ইতিমধ্যে তার ছিন্ন মস্তক আমার সামনে এসে পড়ল। আমি বুঝতেই পারলাম না, কে ওকে মারল’।
রাসূলের চাচা আব্বাস (রাঃ)যিনি বাহ্যিকভাবে মুশরিক বাহিনীতে ছিলেন, জনৈক আনছার তাকে বন্দী করে আনলে, তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! আমাকে এ ব্যক্তি বন্দী করিনি। বরং যে ব্যক্তি বন্দী করেছে, তাকে এখন দেখতে পাচ্ছি না। তিনি একজন চুল বিহীন মাথা বিশিষ্ট ও সুন্দর চেহারার মানুষ এবং বিচিত্র বর্ণের একটি সুন্দর ঘোড়ায় তিনি সওয়ার ছিলেন।
আনছার বললেন, হে রাসূল! আমিই এনাকে বন্দী করেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (দঃ) উক্ত আনছারকে বললেন, اسكت فقد أيدك الله بملك كريم চুপ কর। আল্লাহ এক সম্মানিত ফেরেশতা দ্বারা তোমাকে সাহায্য করেছেন’। কোন কোন হাদীসে এসেছে যে, ফেরেশতারা কোন মুশরিকের উপরে আক্রমণ করার ইচ্ছা করতেই আপনা-আপনি তার মস্তক দেহ হ’তে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। (হাকেম)
মুসলিম বাহিনীর দুর্ধর্ষ আক্রমনে পর্যুদস্ত মুশরিক বাহিনী প্রাণভয়ে পালাতে থাকল। এ দৃশ্য দেখে তাদের ধরে রাখার জন্য আবু জাহল তার লোকদের উদ্দেশ্যে জোরালো ভাষণ দিয়ে বলে উঠলো, সোরাক্বার ( এ সেই ইবলীস যে মক্বাবাহিনীর সাথে বেশ ধরে এসেছিলো পরে পলায়ন করে) পলায়নে তোমরা ভেঙ্গে পড়ো না।সে আগে থেকেই মুহাম্মাদের চর ছিল। ওৎবা, শায়বা, ওয়ালীদের মৃত্যুতেও ভীত হওয়ার কারণ নেই। কেননা তাড়াহুড়োর মধ্যে তারা মারা পড়েছেন। লাত ও উয্যার শপথ করে বলছি, ওদেরকে শক্ত করে রশি দিয়ে বেঁধে না ফেলা পর্যন্ত আমরা ফিরে যাব না। অতএব তোমরা ওদেরকে মেরো না। বরং ধরো এবং বেঁধে ফেল’।
কিন্তু আবু জাহলের এই তর্জন-গর্জন অসার প্রমাণিত হ’ল। আনসারদের বানু সালামাহ গোত্রের কিশোর দু’ভাই মু‘আয ও মু‘আউভিয বিন ‘আফরা তীব্র বেগে ছুটে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং মু‘আয প্রথম আঘাতেই আবু জাহেলের পা তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। এ সময় তার কাঁধে ইকরিমা বিন আবু জাহলের তরবারির আঘাতে মু‘আযের একটি হাত কেটে ঝুলতে থাকলে সে নিজের পা দিয়ে চেপে ধরে এক টানে সেটাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। তারপর ছোট ভাই মু‘আউভিযের আঘাতে আবু জাহল ধরাশায়ী হলে তারা উভয়ে রাসূলের কাছে এসে গর্বভরে বলে উঠলো।
হে রাসূল! আবু জাহলকে আমি হত্যা করেছি। রাসূলুল্লাহ (দঃ) বললেন, তোমাদের তরবারি মুছে ফেলেছ কি? তারা বলল, না। তারপর উভয়ের তরবারি পরীক্ষা করে রাসূলুল্লাহ (দঃ) বললেন, كلاكما قتله ‘তোমরা উভয়ে তাকে হত্যা করেছ’। অবশ্য এই যুদ্ধে মু‘আউভিয বিন আফরা পরে শহীদ হন এবং মু‘আয বিন আফরা হযরত উসমানের খেলাফতকাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।
পরে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ গিয়ে দেখেন আবু জাহলের তখনও নিঃশ্বাস চলছে। তিনি তার দাড়ি ধরে মাথা কেটে নেবার জন্য ঘাড়ে পা রাখলে সে বলে ওঠে, রে বকরীর রাখাল, তুই এতদূর বেড়ে গিয়েছিস? উল্লেখ্য যে, ইবনু মাসঊদ (রাঃ) মক্কায় বকরীর রাখাল ছিলেন। তারপর বলল, فَلَوْ غَيْرَ أَكَّارٍ قَتَلَنِيْ! ওহ্! আমাকে যদি (মদীনার) ঐ চাষারা হত্যা না করে অন্য কেউ হত্যা করতো!
এভাবে মক্কার বড় ত্বাগূতটা শেষ হয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (দঃ) তার মৃতদেহ দেখার পর বলেন, رحم الله ابنى عفراء فهما شركاء فى قتل فرعون هذه الأمة ‘আল্লাহ আফরার দুই পুত্রের উপর রহম করুন! তারা এই উম্মতের ফেরাঊনকে হত্যায় অংশীদার ছিল। অন্য অংশীদার ছিলেন ফেরেশতা এবং ইবনু মাসঊদ’।
যুদ্ধের ফলাফল:
এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ৬জন মুহাজির ও ৮ জন আনসার শহীদ হন। কাফের পক্ষে ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বন্দী হয়। তাদের বড় বড় ২৪ জন নেতাকে বদরের একটি পরিত্যক্ত দুর্গন্ধময় কূপে (القليب) নিক্ষেপ করা হয়। তাদের মধ্যে হিজরতের প্রাক্কালে মক্কায় রাসূলকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী আবু জাহল সহ ১৪ নেতার ১১ জন এই যুদ্ধে নিহত হয়। বাকী তিনজন আবু সুফিয়ান, জুবায়ের বিন মুতব‘ইম ও হাকীম বিন হেযাম পরে মুসলমান হন।
যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ (দঃ) বদরে তিনদিন অবস্থান করেন। রাসূলুল্লাহ (দঃ) সব মাল তার নিকটে জমা করতে বলেন। অতঃপর বদর থেকে রওয়ানা দিয়ে ছাফরা (الصفراء) গিরি সংকট অতিক্রম করে একটি টিলার উপরে গিয়ে বিশ্রাম করেন এবং সেখানে বসে গনীমতের সমস্ত মালের এক পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে বাকী মাল সৈন্যদের মধ্যে সমভাবে বণ্টন করে দেন।
বন্দীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন:
রাসূল (দ.)-এর আগমনের একদিন পরে বন্দীদের কাফেলা মদীনায় পৌছে। রাসূলুল্লাহ (দ.) তাদেরকে সাহাবীগণের মধ্যে বণ্টন করে দেন এবং তাদের সাথে উত্তম ব্যবহারের আদেশ দেন। তাঁর নির্দেশ যথাযথভাবে পালিত হয় এবং ছাহাবীগণ নিজেরা খেজুর খেয়ে বন্দীদের রুটি খাওয়ান। কেননা ঐ সময় মদীনায় খেজুর ছিল সাধারণ খাদ্য এবং রুটি ছিল মূল্যবান খাদ্য। অতঃপর তিনি সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করেন।
আবুবকর (রাঃ) তাদেরকে রক্তমূল্য নিয়ে ছেড়ে দিতে বলেন। কেননা এর ফলে কাফেরদের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের হেদায়াত নসীব করতে পারেন এবং তারা আমাদের জন্য সাহায্যকারী হতে পারে।
কিন্তু ওমর ফারূক (রাঃ) স্ব স্ব আত্মীয়কে স্ব স্ব হস্তে হত্যা করার পরামর্শ দেন। দয়ার নবী আবু বকরের পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং অধিকাংশ বন্দীকে রক্তমূল্য নিয়ে ছেড়ে দেন। আবুল ‘আছ সহ কয়েকজনকে রক্তমূল্য ছাড়াই মুক্তি দেন। আবুল ‘আছ ছিল খাদীজার সহোদর বোনের ছেলে এবং রাসূল কন্যা যয়নবের স্বামী।
শিক্ষার বিনিময়ে মুক্তি:
কয়েকজনকে মাথা প্রতি ১০ জনকে লেখাপড়া শিখানোর বিনিময়ে মদীনাতেই রেখে দেন। তাদের মেয়াদ ছিল উত্তম রূপে পড়া ও লেখা শিক্ষা দান করা পর্যন্ত। এর দ্বারা শিক্ষা বিস্তারের প্রতি রাসূলের আকুল আগ্রহের প্রমাণ মেলে। যা কোন যুদ্ধবন্দী বিনিময়ের ইতিহাসে নযীর বিহীন।
পরিশেষে বিশ্বের নাজুক পরিস্থিতি তথা করোনার করাল রাহুগ্রাস থেকে মুক্তিই যেন বদরের যুদ্ধের আত্মত্যাগের উসিলা হয়। তাদের আত্মত্যাগ ইসলামের বিশ্বজয়ের সূতিকাগার সূচিত হয়েছিল। ফিরে আসুক সেই শান্তির বারতা, বদরের শিক্ষা যেন প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়ে রেখাপাত করে। আমিন।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, উত্তর রাঙ্গুনিয়া উচ্চ বিদ্যালয়।
(ঢাকাটাইমস/২৮মার্চ/এআর)