গল্প
অপহরণ

গতকাল ছিল শনিবার।
রাত পৌনে বারোটায় জেলা সদরের হাসপাতালে যখন তাকে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে আনা হয় তখন জ্ঞান না হারালেও নিজের মধ্যে ছিল না সে। কারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল, কীভাবে এনেছিল, আর সে কোন অবস্থায় ছিল- কিছুই মনে করতে পারে না এ মুহূর্তে। তবে তার আগে তার সঙ্গে কী ঘটেছিল সবই ধীরে ধীরে মনে পড়ছে। গত রাতের ঘটনাগুলো স্পষ্টভাবে স্মৃতির আয়নায় ফিরে আসায় এক ধরনের অস্থিরতা পেয়ে বসে তার, নিজেকে কোনোভাবে শান্ত রাখতে পারে না মাধুরী।
এতক্ষণ পর্যন্ত শরীরটা যেন অবশ, অনুভূতিহীন ছিল। ধীরে ধীরে হলেও শরীরটা জেগে ওঠায় এক ধরনের ব্যথাভাব ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি কোষে কোষে। এবার সে নিজেকে যেন নতুনভাবে আবিষ্কার করে।
কলেজে ক্লাস শেষে ঝাউতলা রোডে টুসিদের বাসায় গিয়েছিল মাধুরী।
ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া মেয়েটিকে পড়ায় সে। মানে মেয়েটির প্রাইভেট টিউটর। এরকম আরেকজন ছাত্রী রয়েছে তার। ঐ মেয়েটি পড়ে ক্লাস সিক্সে। দুটি টিউশনি থেকে মোটামুটি ভালো টাকা পায় মাধুরী। সংসারে বাবা নেই। সরকারি চাকরি করতেন। রিটায়ারমেন্টের অনেক আগেই হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গেছেন। মাধুরীর আরেকটি ভাই রয়েছে। সে পড়ে হাইস্কুলে। আগামী বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে। সংসারের যাবতীয় খরচ মেটানোর পাশাপাশি দুই ভাইবোনের পড়াশোনার খরচও বাবার পেনশন এবং ব্যাংকে রাখা সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকায় চালাতে হিমশিম খেতে হয় মাধুরীর মা নিলুফার বেগমকে। এই দুর্মূল্যের বাজারে সব পরিবারের একই অবস্থা। তবে অনেকে অসহায় এই পরিবারটিকে সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও শেষ পর্যন্ত কাউকে পাশে দেখা যায়নি। বলা যায়, অনেকটা টেনে হেঁচড়ে কঠিনভাবে পার করতে হচ্ছে দিনগুলো। সংসারের দুরবস্থা নিজের চোখে দেখছে মাধুরী। ভালোভাবেই উপলব্ধি করছে।
অনার্স পাস করতে পারলেই একটা চাকরিতে ঢুকে যাবে। পাশাপাশি মাস্টার্স পড়ার ইচ্ছে রয়েছে। যে করেই হোক সংসারের হাল ধরতে চায় মাধুরী। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। সংসারে যদি একজন বড়ো ভাই থাকতো, তাহলে এত ভাবনা ছিল না। সে-ই দেখতো সবকিছু। এখন বড়ো সন্তান হিসেবে তার দায়িত্ব কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। হোক না সে মেয়ে। তাতে কী হয়েছে? এখন ছেলে-মেয়ের মধ্যে তেমন ভেদাভেদ নেই। মেয়েরাও যোগ্যতায়-অভিজ্ঞতায়-দক্ষতায় বেশ এগিয়ে থাকছে। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেদেরও পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে।
মাধুরী মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা মেয়ে। আটপৌরে সাদামাটা জীবন। সাধারণ সরকারি চাকুরে বাবার সীমাবদ্ধ আয়ের সংসারে বিলাসিতা কিংবা কোনোকিছুতে বাড়াবাড়ির সুযোগ হয়নি। তবে আগামী দিনগুলো এই সীমাবদ্ধতার গণ্ডিতে আটকে রাখতে চায় না সে। নিজের যোগ্যতা ও চেষ্টায় অনেক দূর যেতে চায়। আশপাশে, চেনাজানা আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে অনেককেই তো দেখছে। মেয়ে হলেও বেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তারা।
আজকাল যেকোনো চাকরি-বাকরি ও কাজকর্মে কম্পিউটারজ্ঞান থাকা জরুরি। এটা ছাড়া কোনো চাকরি-বাকরিতে সুবিধা করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিং কাজে জড়িয়ে পড়ছে অনেক ছেলেমেয়েই। একটা ল্যাপটপ অথবা ডেস্কটপ কম্পিউটার নিয়ে কাজে লেগেপড়ে প্রতিমাসে হাজার হাজার টাকা উপার্জন করছে। এজন্য গ্রাম কিংবা মফস্বল শহর ছেড়ে রাজধানী ঢাকা অথবা বড়ো কোনো শহরে যাবার দরকার পড়ছে না। গ্রামে কিংবা মফস্বলে নিজ বাড়িতে থেকে দেশ-বিদেশের কাজ করে তারা বেশ ভালো উপার্জন করছে। মাধুরী তাই কম্পিউটার লার্নিং কোর্সে ভর্তি হয়েছে কয়েকমাস আগে। এর মধ্যে অনেকটাই রপ্ত করে ফেলেছে। তবে আরও বেশ কয়েকটা উচ্চতর কোর্স কমপ্লিট করতে পারলে আমেরিকা-ইউরোপীয় দেশ থেকে আসা কাজগুলো অনায়াসে ধরতে পারবে।
উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে এখানেই তেমন উন্নত ট্রেনিং কোর্স চালু হবে আগামী মাসে। তবে সেই ট্রেনিং কোর্সে সুযোগ পাওয়াটা অনেক কঠিন। প্রচুর ছেলেমেয়ে ক্যান্ডিডেট। সবাই প্রথম ব্যাচে ভর্তি হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। তবে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও সাহেব এবং স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের চেনাজানা ঘনিষ্ঠজনদের সুযোগ পেতে তেমন সমস্যা হবে না। স্থানীয় হোমরা-চোমরাদের সুপারিশের জোরে তারা এখানেও এগিয়ে থাকবে। এখানেই শুধু নয়, গোটা দেশটাতেই একই অবস্থা। প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় থাকতে পারলে অনেক দ্রুত তরতর করে এগিয়ে যাওয়া যায়। সব কাজ সহজেই হয়ে যায়।
মাধুরী এতসব জানে এবং ভালোভাবেই বুঝে। তার প্রচণ্ড ইচ্ছে, উপজেলায় শুরু হতে যাওয়া কম্পিউটার লার্নিং-এর উচ্চতর ট্রেনিং কোর্সের প্রথম ব্যাচে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার। কিন্তু তার সঙ্গে এখানকার প্রভাবশালী মানুষজনের তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই। তবে এলাকার অনেকেই তাকে চেনে। তাদের পরিবারের কথা জানে। মাধুরীর বাবা সরকারি অফিসে চাকরি করতেন। অকালে হঠাৎ করেই মারা গেছেন। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটি হঠাৎ যদি এভাবে বিদায় নেয়, তখন বাকি মানুষগুলোর দুরবস্থা কতটা চরমে পৌঁছে সেটা সেই পরিবারের ভুক্তভোগীরা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারে না।
মাধুরীর ভীষণ ইচ্ছে কম্পিউটারের উচ্চতর লার্নিং কোর্স প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে ট্রেনিং শেষে আউটসোর্সিং কাজে নেমে পড়ার। এজন্য উপজেলা চেয়ারম্যান জামান সিকদারের অফিসে কয়েকবার ধরনাও দিয়েছে। কিন্তু সেখানে কোনো পাত্তা পায়নি। অফিসের লোকগুলোর হাবভাব তার তেমন পছন্দ হয়নি। তারা যেন এর আগে মেয়ে মানুষ কোনোদিন দেখেনি। চোখের লোলুপ দৃষ্টিতে গিলে খাচ্ছিল তাকে। চরম অস্বস্তিতে তার সারা শরীর কেমন শিরশির করছিল। বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি সেখানে। অসহ্য মনে হওয়ায় প্রতিবারই ফিরে এসেছে।
এরপরও একেবারে হাল ছেড়ে দেয়নি মাধুরী। এলাকার কয়েকজন ছাত্রনেতা গোছের তরুণ তাকে পরামর্শ দিয়েছে, উপজেলা চেয়ারম্যান জামান সিকদারের সঙ্গে দেখা করে নিজের সমস্যা দুঃখ-দুর্দশার কথা খুলে বলে কম্পিউটার লার্নিং কোর্সের একজন ক্যান্ডিডেট হিসেবে সুযোগ করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে।
এক সময়ের সন্ত্রাসী ক্যাডার জামান সিকদার জোর-জবরদস্তি করে সব প্রতিপক্ষকে ঠেকিয়ে নির্বাচনে জিতে কীভাবে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছে তার সবকিছুই এলাকাবাসীর মতো মাধুরীও কমবেশি জানে। লোকটির নানা কাণ্ডকীর্তি গোটা এলাকাজুড়ে এক ধরনের ভয়ের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে। যদিও জামান সিকদার তার যাবতীয় অপকর্ম আড়াল করতে সব সময় তৎপর থাকে। নিজেকে একজন ভালোমানুষ, নিপাট ভদ্রলোক হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরতে নানা কলাকৌশলের আশ্রয় নেয়, ছলচাতুরি করে। তারপরও বেশির ভাগ মানুষ তাকে মোটেও পছন্দ করে না। উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে মন থেকে মেনে নিতে পারে না। এসব নিয়ে তার মধ্যে কোনো বিব্রতভাব নেই। বলা যায়, ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে চলাফেরা করে জামান সিকদার। নিজের ক্ষমতার দাপট, প্রভাব, প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখতে এলাকার সন্ত্রাসী, দাগি, চিহ্নিত অপরাধীদের নিয়ে শক্তিশালী ক্যাডারবাহিনী গড়ে তুলেছে লোকটা। তারা দিনদুপুরে রাস্তাঘাট, দোকানপাট, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর থেকে লোকজনদের তুলে নিয়ে যায়। টর্চার সেলে আটকে রেখে নির্যাতন করে। কথামতো কাজ না করার জন্য শাস্তি দেয়। এদের হাতে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হলেও উপযুক্ত প্রমাণ, সাক্ষী-সাবুদ না থাকায় আসল অপরাধী এবং এর হোতাদের পুলিশ আটক করতে পারেনি। মামলা হলেও স্থানীয় থানার পুলিশ নিষ্ক্রিয়, নিস্পৃহ থেকেছে। যে কারণে উপজেলা চেয়ারম্যানের রাজত্বে তার বিপক্ষে কিছু করার কিংবা কিছু বলার সাহস করে না কেউ সাধারণত। তেমন প্রতিবাদী হলে গুম হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। তেমন কয়েকটি ঘটনার পর থেকে সিকদার চেয়ারম্যানের রাজত্ব অনেকটা পাকাপোক্ত হয়েছে। এখানে তার কথায় সবকিছু চলে।
যদিও সুন্দরপুর উপজেলার একই চিত্র সারা দেশের আরো অনেক জায়গায় দেখা যায়। সেসব জায়গায় জামান সিকদারের মতো একই চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে দোর্দণ্ড দাপট নিয়ে রাজত্ব করছে অন্য কেউ।
মন থেকে কোনোভাবে সায় না দিলেও আশপাশের চেনাজানা কাছের অনেকের পরামর্শে উপজেলা চেয়ারম্যানের অফিসে গিয়ে সিরিয়াল দিয়ে অপেক্ষা করে জামান সিকদারের সঙ্গে দেখা করেছে মাধুরী। সে নিজের পরিবারের সমস্যার কথা তুলে ধরেছে। কম্পিউটার লার্নিং-এর উচ্চতর কোর্সটা করতে পারলে তার অনেক উপকার হবে। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আউটসোর্সিং-এর কাজগুলো করতে পারবে তখন। তাতে মোটামুটি একটা আয়-উপার্জনের সুযোগ হবে। মাধুরীর কথা শুনে উপজেলা চেয়ারম্যানের রিভলভিং চেয়ারে বসে আয়েশি ভঙ্গিতে জামান সিকদার বলেছে- আরে এখানে ক্যান্ডিডেট-এর তো অভাব নাই। সবাই প্রথম ব্যাচে ট্রেনিং-এ ঢুকতে চায়। কতজন সুপারিশ নিয়া আসছে। কিন্তু সিট তো লিমিটেড। আমরা কারে বাদ দিয়ে কারে নিমু। আমার পলিটিক্যাল বেশকিছু ছেলে-মেয়ে আছে। তাদের দাবি, আগে সুযোগ দিতে হবে। এখন আমি কী করবো?
‘তারপরও যদি আমাকে একটু সুযোগ দেওয়া সম্ভব হয়। আমার ফ্যামিলি অনেক কষ্টে আছে। ট্রেনিংটা করতে পারলে কিছু কাজ করার সুযোগ হতো, লোকটাকে ভেতরে ভেতরে অনেক অপছন্দ হলেও এখন সমীহভাব দেখিয়ে কথাগুলো বলে মাধুরী।
আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি কাল সন্ধ্যায় এ বিষয়টা নিয়ে ফাইনাল ডিসিশানের জন্য মিটিং করবো আমার ঝাউতলা রোডের অফিসে। তুমি যদি সেখানে উপস্থিত থাকতে পারো, তাহলে কমিটির সবাইকে বলে-কয়ে তোমার নামটা ঢুকিয়ে দেবো। অন্য সবাই তোমার কথা শুনলে না করবে না, সিওর।
জামান সিকদার কথা দিয়েছে কমিটির অন্য সবাইকে বলে কিছু একটা করবে তার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কতটা কী করে কে জানে। একটা সংশয়ের দোলাচলে দুলতে থাকে মাধুরীর মনটা।
টুসিকে পড়িয়ে বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এরপর জোড়পুকুর পাড়ে রুহিদের বাসায় যাবার কথা মাধুরী। মেয়েটা ক্লাস সিক্সের ছাত্রী। তার গত পরীক্ষার রেজাল্ট তেমন ভালো হয়নি। এজন্য অভিভাবকদের একটু চাপ রয়েছে। যাতে একটু বেশি কেয়ার নিয়ে পড়িয়ে এর পরের পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা যায়।
ঝাউতলা রোডে জামান চেয়ারম্যানের অফিস। সেই পথ ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় খেয়াল পড়ে আজ সন্ধ্যায় কম্পিউটার লার্নিং কোর্সের সিলেকশন কমিটির মিটিং হবে। হয়তো এতক্ষণে মিটিং শুরু হয়ে গেছে। চেয়ারম্যান মাধুরীকে সেখানে উপস্থিত থাকার কথা বলেছিল। সেখানে কমিটির অন্যান্য লোকজন তার সমস্যার কথা শুনে সহানুভূতিশীল হতে পারেন। কিন্তু এই সন্ধ্যায় একাকী একজন মেয়ে হয়ে কীভাবে ঐ অফিসে এত মানুষজনের মধ্যে যাবে- এক ধরনের দ্বিধা, সংকোচ, ভয় তাকে গ্রাস করে। কিন্তু পরক্ষণেই কম্পিউটার লার্নিং কোর্সে ভর্তির সুযোগ পাবার তাগিদ মাধুরীকে কেমন যেন দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলে। কিছুক্ষণ আগের দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, যা হবার হোক, সে গিয়ে দাঁড়াবে কমিটির মিটিং-এ সদস্যদের সামনে। বেশিক্ষণ তো নয়, অল্পকিছুটা সময়ের জন্য সেখানে যাবে। তারপর সে রুহিকে পড়াতে ওদের বাসায় চলে যাবে।
মনে কিছুটা সাহস জড়ো করে ঝাউতলা রোডে উপজেলা চেয়ারম্যানের অফিসের দিকে পা বাড়ায় মাধুরী। অফিসে ঢুকে তার খেয়াল হয়, আজ তেমন লোকজনের হইচই, সাড়া-শব্দ নেই। কেমন সুনসান নীরবতা ছড়িয়ে আছে এখানে। তাহলে কি কম্পিউটার লার্নিং কোর্সের সিলেকশন কমিটির আজকের মিটিংটা হচ্ছে না, নাকি ততক্ষণে মিটিং শেষ হয়ে গেছে। এত তাড়াতাড়ি মিটিং হয়ে যাবার কথা নয়। কৌতূহলী হয়ে একটি রুমে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই জামান সিকদারকে দেখতে পায়। সেখানে আরও দু’জন মানুষের সঙ্গে কথা বলছে উপজেলা চেয়ারম্যান। মাধুরীকে দেখতে পেয়ে কথা বন্ধ করে তার প্রতি মনোযোগী হয় লোকটা।
ওহ, তুমি আসছো! আজ তো মিটিংটা ক্যান্সেল হয়ে গেছে। ইউএনও সাহেব হঠাৎ জরুরি কাজে ঢাকা গেছেন। ঢাকা থেকে আসার পর মিটিংটা করতে হবে, বলেছেন তিনি।
‘দুঃখিত, আমি জানতাম না। তাই না জেনে, না বুঝে ঢুকে পড়েছি এখানে। ঠিক আছে আমি যাই’ বলে ফিরে যেতে উদ্যত হয় মাধুরী।
‘আরে, তুমি এত কষ্ট করে আশা নিয়ে আসছো। তুমি হতাশ হয়ো না। তোমার কাজটা হয়ে যাবে। আমি তো আছিই। আমিই তোমার জন্য স্টংলি বলবো। চিন্তা করবা না। বসো। তোমাকে চা দিতে বলি’, অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে জামান সিকদার।
তাদের কথোপকথনের মধ্যে রুমে থাকা দু’জন মানুষ কখন যে উঠে চলে গেছে, খেয়াল করতে পারে না মাধুরী।
‘নাহ স্যার, আমি চা খাই না। আমি এখন যাই। আমার জরুরি একটা কাজ আছে, টিউশনিতে যেতে হবে’ বলেই সে রুম ছেড়ে বাইরে চলে যেতে দরজার দিকে এগোয়। দরজা খুলে বাইরে যেতে উদ্যত হতেই দেখতে পায় দরজাটা বন্ধ। কিন্তু ভেতরের ছিটকিনি কিংবা তালা কোনোটিই বন্ধ নেই। তাহলে সে দরজাটা খুলতে পারছে না কেন? হাত দিয়ে টানাটানি করে ব্যর্থ হয় সে। খুলতে পারে না দরজাটা। তার মানে বাইরে থেকে কেউ দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যাপারটা মোটেও ভালো লাগছে না তার। তার এখানে আসাটা ভীষণ ভুল হয়েছে- এখন সে ভালোভাবেই উপলব্ধি করে। একা একা না এসে সাথে কাউকে নিয়ে আসা উচিত ছিল, বুঝতে পারে।
‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, দরজাটা বাইরে থেকে কে বন্ধ করলো, ভয় পেয়ো না’, বলতে বলতে জামান সিকদার তার দিকে এগিয়ে আসে। কাছে এগিয়ে এসেই তাকে জড়িয়ে ধরে দুহাতে। নিজের বুকের মধ্যে শক্তভাবে চেপে ধরে লোকটা তাকে।
হঠাৎ এমন একটা ঘটনা ঘটবে কল্পনা করতে পারেনি মাধুরী। বাঘের থাবায় আটকে গেছে সে। ভয়ংকর বিপদ ঘটতে যাচ্ছে। এরপর কী ঘটবে- ভাবতে পারে না আর। নিজেকে একজন শক্ত সামর্থ্যবান পুরুষের দুই হাতের বন্ধন থেকে মুক্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালায় মাধুরী। কিন্তু তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এক পর্যায়ে অসহায় এই তরুণী চিৎকার করে বাইরের কারো সাহায্য চায়। কিন্তু অবাক ব্যাপার! তার আর্তচিৎকার সেই ঘরের বাইরে যায় না। ঘরের চার দেয়ালের মধ্যেই যেন প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। বাইরে থেকে কেউ জানতে পারে না উপজেলা চেয়ারম্যানের অফিসে ঘটতে থাকা ভয়ংকর কিছু ঘটনার কথা। একজন অসহায় তরুণী কলেজ ছাত্রীর সর্বস্ব হারানোর কথা বাইরে থেকে কেউ জানতে পারে না।
দুই
এখন বিকেল। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে।
বিভাগীয় শহরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সামনে এ মুহূর্তে লোকজনের তেমন ভিড় নেই। তবে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং টিভি চ্যানেলের স্থানীয় সাংবাদিক, পুলিশের লোকজনসহ মানবাধিকার সংগঠনের অনেক কর্মীর ভিড়ে এ জায়গাটা কেমন গমগম করছিল। কলেজের কিছু ছাত্রছাত্রী এসে মিছিল করে সেøাগান দেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু পুলিশ এসে তাদের মৃদু লাঠিচার্জ করে সরিয়ে দিয়েছে। পরে তারা মেডিকেল কলেজের বাইরে গিয়ে জটলা করে আবার মিছিলের চেষ্টা করতেই পুলিশ তাদের ধাওয়া করে। সেই ধাওয়ায় টিকতে না পেরে তারা যে যার মতো চলে গেছে।
শহরের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে নারী সংগঠন ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা কিছু সংগঠনের নারী-পুরুষ কর্মীরাও যোগ দিয়েছিল। গত রাতে ধর্ষণের শিকার কলেজ ছাত্রী নুসরাত মাধুরীর পক্ষে প্রতিবাদ এবং এ ঘটনার উপযুক্ত বিচারের দাবি জানাতে তারা সবাই জড়ো হয়েছিল। ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত উপজেলা চেয়ারম্যান প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা জামান সিকদারকে অবিলম্বে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছে তারা।
ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান জামান সিকদার আড়ালে চলে গেছে। বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকরা এ ঘটনা সম্পর্কে জানার জন্য তাকে ফোন দিলেও ধরছে না কেউ ওই প্রান্তে। ফলে তার সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে না। তবে তার নিজ রাজনৈতিক সংগঠনের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আতাহার মন্ডল অনেকটা তার পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য সাংবাদিকদের কাছে বলেছে, ‘কিছুদিন আগে ইলেকশন হয়েছে। এরপর সাধারণত দেখা যায়, প্রতিপক্ষ অথবা নিজের দলের লোকজন একে অন্যকে ফাঁসাতে চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে তেমনটা হতে পারে। প্রতিপক্ষ জামান সিকদারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তেমন ঘটনা সাজিয়ে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার, তার সামাজিক মর্যাদাহানির অপচেষ্টা করছে হয়তো। তাছাড়া মেয়েটি তো থানা বা আমাদের রাজনৈতিক দলের জেলা কমিটির কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে আমরা তদন্ত করে সে অনুযায়ী অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। সত্যি সত্যি সে অপরাধ করে থাকলে এবং তা প্রমাণিত হলে আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে।
গতকাল অনেক রাত হয়ে যাবার পরও টিউশনি শেষ করে বাসায় না ফেরায় মাধুরীর মা নিলুফার বেগম চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। মোবাইল ফোন দিয়েও তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে কয়েকজন লোক এসে খবর দেয়, হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় মাধুরী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যে কারণে সে বাসায় ফিরতে পারছে না।
মেয়ের দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নিলুফার তার ভাই মনজুর আহমেদকে ডেকে আনেন বাড়িতে। এরপর তারা ছুটে যান ঝাউতলা রোডে উপজেলা চেয়ারম্যানের অফিসের দিকে। সেখানে গিয়ে অচেতন অবস্থায় মাধুরীকে একটি সোফায় পড়ে থাকতে দেখেন। মা হয়ে নিলুফার বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত অবস্থায় মেয়েকে দেখে ঘটনা অনেকটা আঁচ করতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা সিএনজিতে করে বিভাগীয় শহরের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। রাতেই ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে মাধুরীকে ভর্তি করা হয়।
আগের চেয়ে কিছু ভালো বোধ করলেও এক ধরনের আতঙ্ক তাকে গ্রাস করেছে। চরম অস্বস্তি আর ভয় মাধুরীকে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে দিচ্ছে না। হঠাৎ এমন একটি ভয়ংকর ঘটনার শিকার হবে, সে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। তার অভিযোগের কারণে গাইনি ওয়ার্ডের ডাক্তাররা এসে বেশ কিছু পরীক্ষা করেছেন। ওই পরীক্ষায় পাওয়া নানা আলামত, তথ্য প্রমাণ তারা যথারীতি লিখে নিয়েছেন। পরে সেগুলো রিপোর্ট আকারে জমা দেবেন।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এর মধ্যে স্থানীয় থানায় যোগাযোগ করেছিল। থানা থেকে একজন ইনসপেক্টর এসে হাসপাতালে মাধুরীর সঙ্গে কথা বলে গেছেন। তিনি মাধুরীকে থানায় অভিযোগ করার পরামর্শ দিলেও সে তাতে রাজি হয়নি। সে এখন আদালতে মামলা করতে চায়।
থানায় অভিযোগ করলেও তেমন কোনো কাজ হবে না। এটা বুঝে গেছে মাধুরী এবং তার পরিবার। কারণ, এখানকার গোটা প্রশাসন, থানা-পুলিশ সবই উপজেলা চেয়ারম্যান জামান সিকদারের কথায় উঠে-বসে। তার প্রচণ্ড দাপটের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে কিছুই করার সাহস কিংবা সামর্থ্য নেই কারো।
বিকেলেই মাধুরীকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেলেও সে হাসপাতাল ছেড়ে যায়নি। মা ও মামাসহ হাসপাতাল থেকে ডাক্তারদের রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। সে ডাক্তারদের দেয়া রিপোর্টসহ আদালতে যাবে মামলা করতে। কিন্তু আজকের মধ্যে সেই রিপোর্ট দেয়া সম্ভব নয়, হাসপাতাল থেকে বার বার বলা হচ্ছে।
তারপরও মাধুরী চাইছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে ধর্ষণের অভিযোগ এনে জামান সিকদারের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে। আইনি ব্যবস্থা নিতে বেশি দেরি হয়ে গেলে অভিযোগের প্রমাণ অনেক সময় দুর্বল হয়ে যায়। তখন অপরাধীর পার পেয়ে যাওয়া অনেকটা সহজ হয়ে যায়।
হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সামনে এখন আর তেমন জটলা নেই। কাছেই একটি কালো রঙের মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে আছে। তাতে কয়েকজন মানুষ বসে আছে। সন্ধ্যার আবছা আলো-আঁধারীতে তাদের চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তাদের মধ্যে দু’জন মোবাইলে কার সঙ্গে কথা বলছে।
এ রকম অনেকই হরহামেশা মাইক্রোবাস নিয়ে হাসপাতালের সামনে বসে অপেক্ষা করে। অনেক সময় রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে সাথে থাকা আত্মীয়স্বজনসহ এই সব মাইক্রোবাসে চড়ে বাড়িঘরে ফিরে যায়। আবার হাসপাতালে থাকা রোগী দেখার জন্য দূরবর্তী এলাকা থেকে লোকজন আসে মাইক্রোবাস নিয়ে। রোগী দেখা শেষে তারা এই সব মাইক্রোবাসে করে আবার যে যার মতো ফিরে যায়।
অপেক্ষমাণ কালো রঙের মাইক্রোবাসটিও কী তেমন? এ নিয়ে এখানকার কেউ তেমন ভাবছে না। অপেক্ষমাণ গাড়িটিকে এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক একটি ব্যাপার হিসেবে দেখছে তারা।
আজ আর ডাক্তারদের রিপোর্ট পাওয়া যাবে না। কাল এসে নিতে হবে। এটা উপলব্ধি করতেই নিলুফার বেগম তার মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। সাথে আসা ভাইকে বলেন একটা সিএনজি ডেকে আনতে। ‘এখানে হাসপাতালের সামনে অনেক সিএনজি, অটো পাওয়া যাবে। দাঁড়িয়ে প্যাসেঞ্জারের অপেক্ষা করছে সেগুলো। ওখান পর্যন্ত হেঁটে গেলেই পাওয়া যাবে কোনো একটা,’ মাধুরীর মামা মনজুর আহমেদ বলেন।
‘ঠিক আছে, চলো। আমরা এগোই,’ বলে অসুস্থ দুর্বল শরীরের কন্যা মাধুরীকে একহাতে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে থাকেন নিলুফার।
হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে মাধুরীর। বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে শরীরটা। বলতে গেলে গতকাল দুপুর থেকে আজ এখন পর্যন্ত কিছুই খাওয়া হয়নি। অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে আনার পর তাকে একটা স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। আর দু-একটা ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। এর বাইরে কিছুই খাওয়া হয়নি তার। মনজুর মামা বিস্কুট-কলা কিনে এনেছিল তার জন্য। কিন্তু মাধুরী কিছুই খেতে পারেনি। কেমন একটা গা বমি-বমি ভাব তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। কিছুই খেতে ইচ্ছে করছিল না। এখনও সে ভাবটা রয়েছে।
মায়ের শরীরে ভর করে ধীর পায়ে হাঁটছে মাধুরী। আর একটু পথ হাঁটলেই সিএনজি, অটো কিছু একটা পেয়ে যাবে তারা। কালো রঙের মাইক্রোবাসটা যেখানে দাঁড়িয়েছিল তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আচমকা কয়েকজন অচেনা মানুষ তাদের চারপাশে ঘিরে দাঁড়ায়। তাদের প্রত্যেকেরই মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক পরা। যে কারণে তাদের দেখে চেনা যায় না। একজনের হাতে পিস্তল দেখা যায়। মুখে কিছু বলে না তারা। যার হাতে পিস্তল সে শুধু মাধুরী এবং তার মা ও মামাকে ইশারা করে মাইক্রোবাসে চড়ে বসার জন্য।
হাসপাতালের সামনে এমন একটা ঘটনা ঘটছে, আশপাশে কারো কারো নজরে এলেও তারা অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। তবে ব্যাপারটি চোখের সামনে ঘটতে দেখে জেলা মানবাধিকার সংগঠনের তরুণ কর্মী রতন খান স্থির থাকতে পারে না। সাথে থাকা ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে দ্রুত ছবি তুলতে তৎপর হতেই হঠাৎ সেখানে অপেক্ষা করে থাকা কয়েকজন ষণ্ডামার্কা যুবক লাঠি, রামদা নিয়ে ছুটে এসে তাকে আক্রমণ করে। রতনকে রক্ষা করতে তার সংগঠনের কয়েকজন সঙ্গী এগিয়ে এলেও তাদেরকে লাঠি দিয়ে এলোপাথাড়ি পেটাতে থাকে ষণ্ডামার্কা যুবকের দল। রামদা উচিয়ে ভয় দেখালেও তারা আঘাত করে না।
এখানে রক্তারক্তি নয়, স্রেফ ভয় দেখানোর জন্যই আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে বসেছিল এরা। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মাধুরীদের রক্ষা করতে স্থানীয় সাংবাদিক এবং বিভিন্ন মানবাধিকার ও ছাত্র সংগঠনের মানুষজন, কর্মীরা এগিয়ে আসতে পারে। তেমন চিন্তাভাবনা থেকেই তাদের ঠেকানোর জন্য বসেছিল তারা এতক্ষণ ধরে।
অস্ত্রের মুখে হতভম্ব হয়ে যান মাধুরীর মা নিলুফার বেগম। সাথে থাকা মাধুরীর মনজুর মামাও তেমন পরিস্থিতিতে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। জীবনে এরকম পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়েননি। তারা নিরীহ, শান্তিপ্রিয়, সাধারণ মানুষ। জীবনে কোনো সময় তেমন সিরিয়াস ঝামেলায় জড়াননি।
সন্ত্রাসী চক্রের মুখোমুখি হতে হতেই দুর্বল শরীর নিয়েও কেমন যেন বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চেষ্টা করে মাধুরী । একটা গা ঝাড়া ভাব এসে যায় তার মধ্যে। মা নিলুফার বেগমকে এক হাতে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলতে থাকে, আম্মু ভয় পেয়ো না, ওরা আমাদের কিছু করতে পারবে না। চলো, আমরা সামনে এগোই। এদেরকে ভয় পেলে চলবে নাÑ
কিন্তু পিস্তল হাতে থাকা লোকটি ঝাঁঝালো গলায় বলে ওঠে, ‘এক পা আগাইলে কিন্তু একদম শেষ কইরা ফেলামু। কোনো কথা নাই, চুপচাপ তোমরা তিনজন গাড়িতে ওঠো। আমাদের কথার নড়চড় হইলেই কিন্তু ঠাস ঠাস গুলি করমু। আমি নাওশাদ, সময়মতো গুলি করতে কখনও দেরি করি না। এইখানে তোমাদের কেউ বাঁচাইতে কিংবা হেল্প করতে আগাইয়া আইবো না। হাসপাতালের গেটের বাইরে গেলে আরও বড় বিপদ হইবো তোমাদের। তাই কথা না বাড়াইয়া, বিপ্লবী বেগম না হইয়া চুপচাপ গাড়িতে উঠো, আর দেরি কইরো না। লোকটির কথা বলার ধরন দেখে মাধুরী দমে যায় অনেকটা। লোকটির হাতে পিস্তল রয়েছে। এলাকার অনেক ত্রাস সৃষ্টিকারী নাওশাদের নাম আগেও কয়েকবার শুনেছে সে। একটি রাজনৈতিক দলের বড় ক্যাডার সে। পিস্তলের টিগার টিপতে একটুও দ্বিধা করে না সে। সে এর আগে অনেক নির্মম, নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটিয়েছে।
সাথে থাকা মা ও মামার কথা ভেবে চুপসে যায় মাধুরী। নাওশাদের কথা অমান্য করে এগোতে চাইলে হয়তো সে সত্যি সত্যি গুলি করবে। তার জন্য মা এবং মামা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাক, এটা কোনোভাবেই হতে দিতে পারে না সে।
সম্পূর্ণ অনিচ্ছায়, বাধ্য হয়ে মা ও মামাকে নিয়ে কালো মাইক্রোবাসে চড়ে বসে মাধুরী। তাদের চড়ার পর সাথে সাথে গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর মেডিকেল কলেজের চত্বর ছাড়িয়ে গেট পেরিয়ে চোখের পলকে বড়ো রাস্তায় নেমে আসে সেই কালো রঙের মাইক্রোবাস। শাঁই শাঁই করে দ্রুত গতিতে অজানা গন্তব্যের দিকে ছুটে যেতে থাকে।
অলংকরণ : রেজাউল হোসেন

মন্তব্য করুন