অনুবাদ গল্প

লাশ

সাইফুল ভূঁইয়া
 | প্রকাশিত : ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৪৭

মূল: লুই হোর্হে বোর্হেস ইংরেজি অনুবাদ: এন্ড্রু হার্লি

অনুবাদ: সাইফুল ভূঁইয়া

বেঞ্জামিন ওতালোরা, বুয়েনাস আইরেস শহরের পাশের কোনো এক বস্তির এক বিষণ্ন গুন্ডা, বেপরোয়া জীবনের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছাড়া উল্লেখ করার মতো যার আর তেমন কোনো যোগ্যতা নেই এমন একজনের ব্রাজিল-উরুগুয়ে সীমান্তে দুর্গম চারণভূমিতে চোরাকারবারীদের দলনেতা হবার বাসনায় বেরিয়ে পড়াই স্বাভাবিক, যদিও তা অনেকের কাছেই অসম্ভব মনে হতো আর যারা এমন ভাবতো, আমি তাদের বেঞ্জামিন ওতালোরার পরিণতির ব্যাপারে জানাতে চাচ্ছি ব্যাল্ভেনারার যে এলাকায় তার দুরন্ত তারুণ্য কেটেছে এর আশেপাশের এলাকার মানুষের মাঝে ওতালোরার কোনো স্মৃতিই আর অবশিষ্ট ছিল না হিও গ্র্যান্দে দ্য সুল প্রদেশের সীমান্তের কাছে এক বন্দুকযুদ্ধে বুলেটবিদ্ধ হয়ে তার করুণ মৃত্যু হয় সেই অভিযান সম্বন্ধে আমার খুব বিশদ জানা নেই, তবে আমাকে যদি তথ্য সংগ্রহের সুযোগ দেওয়া হয় তবে ভবিষ্যতে আমি এই লেখা সংশোধন বর্ধিত করবো এই সংক্ষিপ্ত লেখা আপনাদের কারো সাময়িক উপকারে আসলেও আসতে পারে

১৮৯১ সালের দিকে বেঞ্জামিন ওতালোরা ছিল ঊনিশ বছরের এক ফিটফাট তরুণ যার নিচু কপাল, ব্যগ্র নীল চোখ আর সুস্বাস্থ্য তার বাস্ক পূর্বপুরুষদের কথা মনে করিয়ে দেয় জিন্সের পকেট থেকে বেরিয়ে থাকা ছুরির বাট তার নিজের কাছেই নিজেকে অদম্য সাহসী করে তুলতো; প্রতিপক্ষের মৃত্যু বা নিজের হঠাৎ দেশ ছাড়ার চিন্তা তাকে একেবারেই বিচলিত করতো না আসলে দেশ ছাড়ার কথা তার ভাবনায়ও আসেনি কখনো কিন্তু দলের এক আঞ্চলিক নেতা তাকে আজবেদো ব্যান্দেরিয়া নামের উরুগুয়ের কোনো এক নেতার উদ্দেশ্যে একটি চিঠি দিয়ে মন্টিভিডিও চলে যেতে বললো পরদিন সকালে ওতালোরা মন্টিভিডিওর উদ্দেশ্যে জাহাজে চেপে বসলো সামুদ্রিক ঝড় আর প্রবল ঢেউ ঠেলে একদিন পর জাহাজ বন্দরে পৌঁছলো তারপর শহরের রাস্তায় রাস্তায় সে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে লাগলো অপরিচিত শহরের রাস্তায় নিজেকে স্বদেশের জন্য কাতর আর প্রত্যাখ্যাত এক ভবঘুরে মনে হচ্ছিল সারা শহরে ঘুরেও আজবেদো ব্যান্দেরিয়ার কোনো হদিস না পেয়ে মাঝরাতে প্যাস দ্যল মলিনো এলাকার এক ছোটো সেলুনে ঢুকেই আচমকা দুইদল কাউবয়ের হাঙ্গামার মধ্যে পড়ে গেল তারই মাঝে ওতালোরার দৃষ্টি আটকে গেল টেবিলের উপর পড়ে থাকা একটি চকচকে ছুরিতে তার কোনো ধারণাই ছিল না কোন পক্ষ সঠিক আর কোন পক্ষেই তার যাওয়া উচিত তবে আসন্ন বিপদটা সে ঠিকই ধরতে পেরেছিল, যেভাবে কিছু মানুষ জুয়া আর সংগীতে আকৃষ্ট হয়ে যায় এই সংশয়ের মাঝেই প্রশস্ত ধার-ওয়ালা হ্যাট আর নোংরা পঞ্চো গায়ে এক গাউচো ইন্ডিয়ান কাউবয়ের উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত একটি ছুরি সে আটকে দিল যখন সে জানতে পারলো যে, এই হ্যাট মাথার কাউবয়টিই আজবেদো ব্যান্দেরিয়া, তখন তার উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিটি কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেললো যদিও তার শরীর ছিল শক্তিশালী আর পেটানো তবুও চেহারায় লাম্পট্য আর জালিয়াতির স্পষ্ট ছাপ ছিল তার বিশাল মুখাবয়বে ছিল ইহুদি, নিগ্রো আর ইন্ডিয়ান চেহারার মিশ্রণ হাবভাবে ছিল বানর বাঘের মিশেল মুখের আড়াআড়ি কাটা দাগটি তার রুক্ষ কালো গোঁফের মতোই তার অবয়বে আরো এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অলংকার হিসেবে যোগ হয়েছিল মারামারি যেভাবে আচমকা শুরু হয়েছিল সেভাবেই হঠাৎ থেমে গেল হতে পারে সেটা ছিল পুর্বনির্ধারিত লোকদেখানো মারামারির এক প্রদর্শনী অথবা অতিরিক্ত মদ্যপানের পরিণতি ওতালোরা গাউচো কাউবয়দের সাথে সারারাত মদ্যপান আর হুল্লোড় করে কাটালো, তারপর সূর্য মাথার উপর উঠতে উঠতে পুরোনো শহরের একটি বাড়িতে পৌঁছে গেল বাড়ির পেছনের উঠানে অন্য কাউবয়দের ঘোড়ার জিনের সাথে গুটিয়ে রাখা কম্বল বিছিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো ওতালোরার চোখে ভেসে উঠছিল গতরাতের ঘটনা আর তুলনা করছিল আজকের বন্ধুবেষ্টিত নিরাপদ স্থানের সাথে আগের রাতের অপরিচিত পরিবেশ আর আসন্ন বিপদের চিন্তা যাই হোক, বুয়েনাস আইরেসের জন্য সে মোটেই কাতর ছিল না ওতালোরা বিকেল, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত পর্যন্ত ঘুমালো যতক্ষণ না তাকে ডেকে উঠালো সেই কাউবয়, যে আজবেদো ব্যান্দেরিয়াকে ছুরি মারতে চেয়েছিল সে তখন মনে করতে পারছিল যে, অন্যান্য কাউবয়দের সাথে আগের রাতে সে বেশ উদ্দাম এক সময় কাটিয়েছে, সারা শহর ঘুরে বেড়িয়েছে আর আজবেদো ব্যান্দেরিয়া তাকে পাশে বসিয়ে গ্লাসের পর গ্লাস মদ গিলিয়েছে কাউবয়টি জানালো যে, তার নেতা তাকে পাঠিয়েছে ওতালোরাকে নিয়ে যেতে বাড়ির সম্মুখে লম্বা প্রবেশপথে এক সুসজ্জিত অফিসের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে ওতালোরা দেখলো আজবেদো ব্যান্দেরিয়া একান্তে এক স্বর্ণকেশী তরুণীর সাথে বসে তার জন্যই অপেক্ষা করছে তাকে স্বাগত জানিয়ে গতরাতের ঘটনায় তার সাহসের প্রশংসায় ভাসিয়ে এক গ্লাস ব্র্যান্ডি খেতে আমন্ত্রণ জানালো- আর জানালো সে রাতেই তারা উত্তরে যাচ্ছে বিশাল একপাল গরু ফিরিয়ে আনতে ওতালোরা তাদের সাথে যেতে রাজি হলো, সূর্যের আলো উঠার আগেই তারা তাকেরেম্বোর পথে নেমে গেল

সেই মুহূর্তেই শুরু হলো ওতালোরার নতুন জীবন, যে জীবনে থাকে বিশাল সূর্যোদয় আর জিনের উপর ঘোড়ার গন্ধময় দীর্ঘ দিন যদিও এই জীবনটা ছিল তার অপরিচিত এবং কখনো যা অসহনীয় যন্ত্রণাময়ও হয়ে যেতে পারে, তবে এটা তার রক্তেই ছিল আর তাই ভিনদেশের একজন হয়েও উত্তাল সমুদ্র জয় করে সে এখানে এসেছে অসীম সমভূমিতে ঘোড়ার খুরের শব্দের টানে আস্তাবলের মালিক, গাড়োয়ান আর মুচিদের মাঝে বেড়ে উঠে এক বছরের মধ্যেই সে একজন জাত গাউচো হয়ে উঠেছিল একজন কাউবয়ের প্রয়োজনীয় অনেক কৌশলই সে শিখে গিয়েছিল; যেমন- ঘোড়ার পিঠে চড়া, পশুর পাল কাছাকাছি রাখা, জবাই করা পশুর চামড়া ছড়ানো, দড়ির ফাঁস ছুঁড়ে গলায় লাগানো আর ক্লান্তি, শীত, রোদ বা ঝড়ের সময় টিকে থাকা আর শিস দিয়ে পশুদের এক জায়গায় জড়ো করা তার এই কাউবয় জীবনের শুরুতে মাত্র একবারই সে আজবেদো ব্যান্দেরিয়াকে দেখেছে; কিন্তু তবু ব্যান্দেরিয়ার লোক হিসেবে সকলে তাকে যে বিশেষ নজরে রাখতো আর সমীহ করতো, তাতেই আজবেদো ব্যান্দেরিয়ার শারীরিক উপস্থিতি না থাকলেও সর্বক্ষণই তার অদৃশ্য উপস্থিতি টের পেতো যেকোনো সাহসিকতা বা কৃতিত্বের বিষয় এলেই গাউচোরা ব্যান্দেরিয়ার প্রসঙ্গ টানতো হিও গ্র্যান্দে দ্যা সুলের ব্রাজিলিয়ান অংশে আজবেদো ব্যান্দেরিয়ার জন্ম, কথা শুনে ওতালোরার চোখের সামনে ভেসে উঠতো গহীন অরণ্য, দুর্ভেদ্য জলাভূমি আর দুর্গম পথ

ওতালোরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল চোরাচালানই ব্যান্দেরিয়ার প্রধানতম আগ্রহের বিষয় তার কাছে মনে হচ্ছিল পশুপালক হচ্ছে দাস বা ভৃত্য, তাই কোনো একদিন সে চোরাকারবারিদের দলে যোগ দেয়ার পণ করলো এক রাতে তার দুজন সহযোগী যখন সীমান্ত পেরিয়ে মদের চালান আনার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ওতালোরা তখন তাদের একজনকে উত্ত্যক্ত করে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে আহত করলো তারপর সে তার স্থান দখল করলো উচ্চাকাক্সক্ষাই তাকে সামনে পরিচালিত করেছিল কিন্তু তার মাঝে মনিবের প্রতি অদৃশ্য আনুগত্যও ছিল সে এমন একটা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতো যে, কোনো এক দিন ব্যান্দেরিয়া এসে দেখবে গাউচোদের মধ্যে ওতালোরাই সবচেয়ে যোগ্য এবং দক্ষ

ইতোমধ্যে কেটে গেছে এক বছর তারা আবার মন্টিভিডিওর পথে নেমে সীমান্ত ঘুরে বিশাল এক নগরে প্রবেশ করলো আজবেদো ব্যান্দেরিয়া বাড়িতে পৌঁছে সবাই পেছনের উঠানে কম্বল বিছিয়ে বিশ্রামের আয়োজন করলো কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও ওতালোরা ব্যান্দেরিয়ার দেখা পেলো না ভয়ে ভয়ে কেউ কেউ বলছে যে আজবেদো ব্যান্দেরিয়া অসুস্থ; প্রতিদিন সন্ধ্যায় একজন নিগ্রোকে চায়ের কেটলি নিয়ে উপরে যেতে দেখা যেত এক সন্ধ্যায় কিছু জিনিস নিয়ে উপরে যেতে ওতালোরার ডাক পড়লো, সে তাতে অপমানিত বোধ করলেও কিছুটা গর্বও হয়েছিল

ব্যান্দেরিয়ার বিশাল শয়নকক্ষটি ছিল জীর্ণ আর অন্ধকার, পশ্চিমমুখী ঝুলবারান্দায় বসে সূর্যাস্ত দেখা যেত একটা লম্বাটে টেবিলের উপর এলোমেলোভাবে পড়েছিল চকচকে হাতলযুক্ত চাবুক, গুলির বেল্ট, বন্দুক, পিস্তল, আর ছুরি দেওয়ালে ঝুলছিল পুরোনো ঝাপসা হয়ে যাওয়া একটি আয়না ছাদের দিকে মুখ করে শুয়েছিল ব্যান্দেরিয়া; ঘুমের মাঝে বিড়বিড় করে অস্পষ্ট কিছু বলছিল, মনে হয় দুঃস্বপ্ন দেখছিল ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা বিশাল বিছানায় তাকে অনেক ছোটো আর কালো দেখাচ্ছিল তার পাকা চুল, অবসন্নতা, নিস্তেজ শরীর আর গভীর বলিরেখাগুলো ওতালোরার নজরে পড়েছিল এমন একটা বৃদ্ধ-অথর্ব মানুষের প্রভুত্বে সে নিজেকে সমর্পণ করে আছে ভেবেই তার নিজের উপর অনেক রাগ হয়েছিল সে ভাবলো এক ঘুষিতে তাকে শেষ করে দেয় সেই মুহূর্তেই ঝাপসা আয়নায় টের পেল কেউ একজন কক্ষে প্রবেশ করেছে স্বর্ণকেশী সেই নারী, খালি পায়ে অবিন্যস্ত কাপড়ে এক শীতল কৌতূহল নিয়ে তার দিকে তাকিয়েছিল এরই মধ্যে ব্যান্দেরিয়া বিছানায় উঠে বসেছিল গত দুই বছরের ব্যবসার কথা বলছিল আর স্বর্ণকেশী নারীর চুলে আঙুল দিয়ে খেলতে খেলতে গ্লাসের পর গ্লাস ভেষজ চা পান করছিল তারপর ওতালোরাকে চলে যেতে অনুমতি দিল

কয়েকদিন বাদে তারা আবার উত্তরের পথে নামলো; সেই অসীম সমভূমির কোনো এক স্থানে এক পরিত্যক্ত খামারে পৌঁছাল, যেখানে কোনো গাছ বা জলাশয় নেই সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তীব্র রোদ সবকিছু পুড়িয়ে দিচ্ছিল সেখানে হাড্ডিসার লম্বা-শিংওয়ালা পশুগুলোর জন্য পাথরের পাঁচিলে ঘেরা একটা খোঁয়াড় ছিল; এইসব ধ্বংস-প্রায় দালানসহ এই রেঞ্চটার নাম ছিলশেষ দীর্ঘশ্বাস অন্য কাউবয়দের সাথে আগুন পোহাতে-পোহাতে ওতালোরা এক রাতে শুনতে পেল, অচিরেই আজবেদো ব্যান্দেরিয়া মন্টিভিডিও ছেড়ে এদিকে আসবে সে জানতে চাইলো কোন উদ্দেশ্যে ব্যান্দেরিয়া আসবে একজন বললো তাদের মাঝে কোনো এক বিদেশি গাউচো আছে তাকে বিশেষ এক পুরস্কার দিতে হয়তো আসছে ওতালোরা এই কথাকে ইয়ার্কি ভেবে তেমন বিশ্বাস করলো না আরো শুনতে পেল যে আজবেদো ব্যান্দেরিয়ার কিছু বিশেষ রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল, সেগুলো তখন আর নেই; এটা শুনে ওতালোরা বেশ খুশি হয়েছিল

এরই মাঝে বাক্সো ভর্তি গোলা-বারুদ আসতে থাকলো; চলতে থাকলো ব্যান্দেরিয়া আগমনের সকল আয়োজন যে কক্ষে সেই স্বর্ণকেশী নারী থাকার কথা রয়েছে, সেই কক্ষে রুপালি রংয়ের পানির পাত্র আর ওয়াস-বেসিন বসলো; দরজা জানালায় লেগে গেল সূক্ষ্ম জরিরকাজ খচিত পর্দা এক সকালে পাহাড়ের ওপাশ থেকে ভারী পোশাক গায়ে এক দাড়িওয়ালা, গোমড়ামুখো অশ্বারোহী হাজির হলো তার নাম আলপিয়ানো স্যুয়ারেজ, এক সুঠামদেহী ব্রাজিলিয়ান, আজবেদো ব্যান্দেরিয়ার দেহরক্ষী ব্রাজিলিয়ান উচ্চারণে ভারী গলায় খুব ধীরে ধীরে অল্প কথা বলে এটাই কি তার চরিত্রের ধাঁচ, না কি অন্যদের প্রতি তার অবজ্ঞা সেটা ওতালোরা ঠিক ঠাওর করতে পারছিল না কিন্তু তার বিশ্বাস ছিল কোনো একদিন তাদের দুজনের বিশেষ বন্ধুত্ব হয়ে যাবে

এই বেঞ্জামিন ওতালোরার গল্পের পাশাপাশি আরো একটি গল্প আছে এক কালো পায়ের ঘোড়ার (বে-হর্স) গল্প তার পিঠে থাকতো রুপায় মোড়ানো জিন আর তাতে চিতার চামড়াখচিত কম্বল; ব্যান্দেরিয়া যেটা এনেছিল দক্ষিণ থেকে এই তেজি ঘোড়াটি তার ক্ষমতার প্রতীক, তাই এটার উপর তরুণ কাউবয়দের ছিল বিশেষ লোভ আর স্বর্ণকেশী নারীকে কাছে পেতেও তাদের একইরকম লোভ ছিল তাই যার দখলে সেই নারী, কারুকার্যময় জিন আর তেজী ঘোড়া থাকবে ওতালোরা তাকেই ধ্বংস করে দিতে চাইত

আর এখানেই গল্পটা আবার বাঁক খেলো আর আরো গভীরে গেল সত্য আর চাতুরীর মিশ্রণে ধীরে ধীরে কাউকে ক্রমাগত অপমান করে যাওয়ার এক পৈশাচিক শিল্প ব্যান্দেরিয়ার জানা আছে আর ওতালোরা ভবিষ্যতে এই কৌশলটাই তার উপর প্রয়োগ করার পরিকল্পনা করছিল সে ব্যান্দেরিয়াকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিতে শপথ করলো, তবে সে এটাও জানতো এর জন্য অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে

এক সাথে বিভিন্ন বিপদ মোকাবিলা করতে করতে এক সময় সেই সুঠামদেহী ব্রাজিলিয়ান স্যুয়ারেজের সাথে তার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল তার পরিকল্পনার কথা স্যুয়ারেজকে জানালে সে তাকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিল ইতোমধ্যে অনাকাক্সিক্ষত অনেক ঘটনা ঘটতে শুরু করেছিল- ওতালোরা ব্যান্দেরিয়ার নির্দেশনা অমান্য এবং উপেক্ষা করতে থাকলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরাসরি দ্বন্দ্বেও জড়িয়ে যাচ্ছিল; আশেপাশের সবকিছুই যেন তার সাথে ষড়যন্ত্রে নেমে গেল এবং সবকিছু খুব দ্রুতই ঘটতে থাকলো

এক দুপুরে তাকেরেম্বো-প্রেইরি সীমান্তে ব্রাজিলের এক দল চোরাচালানির সাথে গোলাগুলি বেঁধে যায়; ওতালোরা সেই যুদ্ধে ব্যান্দেরিয়ার স্থানে উরুগুয়ানদের নেতৃত্ব দিল সেই লড়াইয়ের মাঝে একটি বুলেট এসে তার কাঁধে আঘাত করলো, তারপর সে বিকেলে সেই ঘোড়ায় চড়েশেষ দীর্ঘশ্বাস”- ফিরলো তার ঝরেপড়া রক্তের কয়েক ফোঁটা ঘোড়ার জিনের চিতার চামড়াকে রঞ্জিত করেছিল আর সে রাতেই স্বর্ণকেশী নারীর সাথে ওতেলোরা রাত কাটালো অন্য ঘটনাগুলোও একইভাবে পাল্টে যেতে লাগলো যেন এমনই চলে আসছিল, এটা কেবল একটি দিনের ঘটনা ছিল না ব্যান্দেরিয়া তখন কেবল নামে মাত্র এক নেতা, তার আদেশ আর কোনো অর্থ বহন করছিল না; কেউ তার কোনো নির্দেশ মানছিল না ভান্দেরিয়া একা উপরতলায় তার কক্ষে পড়ে রইলো, যদিও ওতালোরা তাকে কিছুই করেনি, কেবল করুণা দিয়ে তাকে একা করে দিয়েছিল

এই গল্পের শেষ দৃশ্য দৃশ্যায়িত হলো ১৮৯৪ সালের বর্ষ-বিদায়ী নৈশ উৎসবের উন্মাদনার মাঝে সেই রাতেশেষ দীর্ঘশ্বাস”-এর সবাই তাজা জবাই করা পশুর মাংস খেলো, ইচ্ছেমতো পান করলো; আর তার প্রভাবে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে নেমে পড়েছিল কয়েকজন বিরতিহীনভাবে গিটারে একের পর এক মিলঙ্গা বাজাচ্ছিল আর প্রায় সবাই গলা মিলিয়ে নেচে যাচ্ছিল টেবিলের একপাশে বসে ওতালোরা বেশ আয়েশে পান করে যাচ্ছিল আর একের পর এক বিজয়োল্লাস করছিল সেদিনের সেই জমকালো উৎসবমুখর দুর্গ ছিল তার দুর্দমনীয় নিয়তির প্রতীক ব্যান্দেরিয়া এই চিৎকার-চেঁচামেচির মাঝেও ছিল নীরব আর রাতটা বিজয়োৎসবের কোলাহলের মধ্যে প্রবাহিত হতে দিল

অবশেষে ঘড়িতে রাত বারোটার ঘণ্টা বাজতেই ব্যান্দেরিয়া উঠে দাঁড়ালো যেন হঠাৎ কিছু অসমাপ্ত কাজের কথা মনে পড়লো ধীরে ধীরে হেঁটে গেল সেই নারীর দরজার সামনে, কড়া নাড়তেই বেরিয়ে এলো, যেন সে প্রস্তুতই ছিল এই ডাকের জন্য নগ্ন পায়ে আর অবিন্যস্ত পোশাকে সে বেরিয়ে এলো ব্যন্দেরিয়া মেয়েলি মৃদুস্বরে এক আদেশ করলো: “যেহেতু তুমি আর এই আর্হেন্তাইন পরস্পরকে এত ভালোবাসো, তাই তোমরা এই মুহূর্তে প্রকাশ্যে সবার সামনে চুম্বন করবেসে আরো কিছু অশ্লীল বর্ণনা ব্যবহার করলো সেই নারী কিছু বাধা দিতে চাইলেও দুজন পুরুষ তাকে দুই বাহুতে ধরে ওতালোরার সামনে ছুড়ে ফেললো অশ্রুসজল চোখে সেই নারী তার মুখ আর বুকে চুম্বন করলো; স্যুয়ারেজের আঙুলে ঘুরছিল রিভলবার মৃত্যুর আগে ওতালোরা বুঝতে পেরেছিল প্রথম থেকেই সে বিশ্বাসঘাতকতা করে আসছিল তাকে ভালোবাসতে, হুকুম দিতে আর বিজয়োৎসব করতে দেওয়া হয়েছিল কারণ তার সঙ্গীরা আগে থেকেই তাকে মৃত হিসেবে ধরে নিয়েছিল ব্যান্দেরিয়ার কাছে সে আগেই একজন মৃত মানুষ স্যুয়ারেজ তাকে ঘৃণায় আর অবজ্ঞায় রিভলবার থেকে দুটো গুলি করলো

অলংকরণ : রেজাউল হোসেন

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :