শরীয়তপুরে ঐতিহ্যবাহী দীঘিতে মাছ ধরার উৎসব
শরীয়তপুরের ঐতিহ্যকে ধরে রেখে প্রতি বছরের মতো এবছরও দুইশত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরার উৎসবে মেতেছেন শতাধিক জেলে। এমন দৃশ্যের আনন্দ উপভোগ করতে পুকুরের চারপাশে ভিড় করেছেন হাজারেরও অধিক দর্শনার্থী ও ক্রেতা।
শনিবার সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার কনেশ্বর ইউনিয়নের শুতলকাঠি গ্রামের ফোরকার পাড়ের ঐতিহ্যবাহী পুকুরে চলে এই মাছ ধরার উৎসব।
স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ ও মাছ ধরার আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা যায়, শুতলকাঠি গ্রামের ফোরকার পাড় নামক স্থানে ঐতিহ্যবাহী পুরোনো একটি বিশাল পুকুর (দীঘি) রয়েছে। শুরু থেকেই পুকুরটির মাছ উৎসব করে ধরা হয়। কিন্তু কে বা কারা প্রথমে এমন আয়োজন করে মাছ ধরার শুরুটা করেছিলেন, তা কেউই সঠিকভাবে বলতে না পারলেও স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠদের ভাষ্যমতে কমপক্ষে ২০০ বছরের অধিক সময় ধরে এভাবেই এই পুকুরটির মাছ ধরা হয়। প্রতি বছরের মতো এ বছরও শনিবার দিনটিকে মাছ ধরার জন্য নির্ধারণ করে পুকুরের ৩২ জন মালিক ও মাছ ধরা আয়োজক কমিটি। মাছ ধরার সময় নির্ধারণ হওয়ার পরে গত কয়েকদিন ধরে জেলার বিভিন্ন উপজেলার ১১১ জন জেলে আয়োজক কমিটির নিয়ম মেনে মাছ ধরার জন্য দুই হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা মূল্যের টিকিট ক্রয় করেন। এরপর শনিবার সকাল থেকে একযোগে ঝাঁকি জালের মাধ্যমে মাছ ধরা শুরু করেন তারা। জেলেদের মাছ ধরা দেখতে পুকুরের চারপাশে ভিড় করেছেন বিভিন্ন উপজেলার প্রায় ৩ হাজার দর্শনার্থী ও ক্রেতা। জেলেদের জালে বড় কোনো মাছ ধরা না পড়লেই পুকুরের চারপাশ থেকে এসব দর্শনার্থী ও ক্রেতারা জয়ধ্বনি করে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। মাছ ধরে বিক্রির এমন উৎসবকে কেন্দ্র করে পুকুরের এক প্রান্তে বসেছে অস্থায়ী মেলা। প্রতি বছর দলবদ্ধ হয়ে মাছ শিকারের বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে পুকুর পাড়ে জড়ো হওয়ার পর একযোগে ছন্দের তালে তালে পানিতে নেমে মাছ ধরা যেন বাঙালির ঐতিহ্যের জয়গান।
আব্বাস সরদার নামের একজন বলেন, এই দীঘিটির বয়স প্রায় ২০০ বছরের অধিক। দীঘিটি থেকে আমার বাবা ও দাদাও উৎসব করে মাছ শিকার করেছেন। বয়সের কালে আমিও উৎসব করে মাছ শিকার করতাম। আজ আমার ছেলেরা মাছ শিকার করছে। আমি দর্শক হয়ে আনন্দ করে মাছ শিকার দেখছি।
শফিকুল ইসলাম বলেন, আমি জানতে পেরেছি পুকুরটি ২০০ বছরের পুরোনো। ২০০ বছর ধরেই উৎসব করে মাছ শিকার করা হয় পুকুরটি থেকে। এসে দেখলাম শতাধিক জেলে কলা গাছের ভেলা ভাসিয়ে উৎসব করে মাছ শিকার করছেন। পুকুরের চারপাশে হাজারো দর্শক উৎসবের সঙ্গে মাছ শিকারের দৃশ্য দেখছেন। তাদের সঙ্গে আমিও মাছ শিকারের এমন দৃশ্য উপভোগ করেছি। যাওয়ার সময় আমার সাধ্যমতো মাছ আমি ক্রয় করব পরিবারের সদস্যদের জন্য।
মাছ ধরা আয়োজক কমিটির সদস্য বিল্লাল হোসেন বলেন, আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি। ফোড়কার পাড়ের এই পুকুরটি থেকে মাছ শিকারের বিষয়টি ২০০ বছরের ঐতিহ্য। আমরা প্রতি বছর একই দিনে, একই সময়ে মাছ ধরার এমন আয়োজন করে থাকি। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে জেলে ও দর্শনার্থীরা এখানে আসেন। বর্তমান প্রজন্ম হয়তো কিছুদিন পড়ে ভুলেই যাবে পুকুর থেকে মাছ ধরা যায়। এভাবে মাছ শিকারের বিষয়টি পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বাঙালির ঐতিহ্যকে বয়ে নিয়ে যাবে বলে আমি আশাবাদী। ২০০ বছরের ধারাবাহিকতা আমরা বজায় রেখেছি। জেলেরা উৎসব করে মাছ শিকার করছেন। অন্যদিকে উৎসবের সঙ্গে দর্শনার্থীরা দেখছেন, ক্রেতারা ক্রয় করছেন। আগামী বছর মাছ ধরার এই আয়োজনকে আরও সমৃদ্ধ করব ইনশাআল্লাহ।
কনেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান বাচ্চু বলেন, ফোড়কার পাড়ের পুকুরটি ২০০ বছরের অধিক পুরোনো। জানতে পেরেছি ২০০ বছরের অধিক সময় ধরে এভাবেই উৎসব করে মাছ ধরা হয় পুকুরটি থেকে। বাঙালির অবিচ্ছেদ্য বিষয় হলো মাছ। মাছ শিকারের এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে আয়োজক কমিটিকে আমি ধন্যবাদ জানাই।
(ঢাকা টাইমস/২১এপ্রিল/প্রতিনিধি/এসএ)