দেশি ও ভূ-রাজনীতিতে কিছু সংকেতের আলামত

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
 | প্রকাশিত : ২৬ মে ২০২৪, ১১:১০

সম্প্রতি ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে কলকাতায় নৃশংসভাবে হত্যা করার ঘটনা সব মহলে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। তার হত্যার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন দেশে এবং কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছে। নিষ্ঠুর এই হত্যাকাণ্ডের বীভৎস বর্ণনা শুনতে অনেকেরই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, তার খণ্ড-বিখণ্ড দেহের অংশবিশেষ উদ্ধারের চেষ্টা ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অব্যহত রেখেছে। কিন্তু এখনো তারা সফল হতে পারেনি। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে অনেক ধরনের মোটিভ জড়িত ছিল এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন, আনারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও কী উদ্দেশ্যে আনারকে এভাবে হত্যা করেছে তা এখনো কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।

যথারীতি হত্যাকাণ্ডের মূল এই পরিকল্পনাকারী ইতোমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছে। তাকে কোনোদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে আনা যাবে কি না সেটি অনেকের কাছেই প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে শাহীন তার বন্ধুকে হত্যা করার পরিকল্পনাটি অনেক আগেই ঢাকায় বসে নিয়েছিল, কিলিং মিশন বাস্তবায়ন করেছিল খুলনা অঞ্চলের এককালের সন্ত্রাসী ও বহু রাজনৈতিক নেতাকর্মী, সাংবাদিককে হত্যায় অংশ নেওয়া সৈয়দ আমানুল্লাহ এবং শিলাস্তি রহমান, ভারতে লুকিয়ে থাকা জিহাদ হাওলাদার।

মার্কিন প্রবাসী আক্তারুজ্জামান শাহীন ঢাকা এবং ঝিনাইদহে বছরের ৬ মাস করে থাকতেন এবং বর্তমানে বিশাল বিত্ত বৈভবের অধিকারী হয়ে ওঠেন তিনি। তার বাড়িতে সমাজের উচ্চবিত্ত, প্রশাসন, শিল্পসংস্কৃতির বহুজনের আনাগোনা ঘটতো। এইসব কল্পকাহিনী এখন যদিও মূল আলোচ্য বিষয় নয়, তবুও বন্ধুকে কলকাতায় নিয়ে এভাবে হত্যা করার পরিকল্পনা ও সুদূরপ্রসারী কর্মকাণ্ডের পেছনে অনেক কিছু রহস্যাবৃত রয়েছে সত্য। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ড নেপথ্যের সকল কারণ উদ্ঘাটন করা গেলে বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি এবং এর সঙ্গে জড়িত অর্থবিত্তসহ অনেককিছুরই জট খুলে যেতে পারে- যা দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আদর্শের পরিবর্তে ক্ষমতা, দ্বন্দ্ব, বিত্তবৈভবের স্বার্থ কতখানি অমানবিক হয়ে উঠেছে তার একটি ধারণা লাভ করা সম্ভব হতে পারে।

এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ঘাতকরা কয়েক দশক আগে থেকে খুলনা অঞ্চলে সর্বহারা নামে যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল তারও বেশ কিছু ঘটনার কথা লোকচক্ষুর অন্তরাল থেকে এখন বের হয়ে এসেছে। আবার এরাই ঢাকায় বসে স্থানীয় নেতার হত্যার কাজে এখনো যে সক্রিয় রয়েছে সেটিও আনার হত্যার মাধ্যমে জানা গেছে। আনোয়ারুল আজিম আনার পরপর তিন মেয়াদের একজন সংসদ সদস্য ছিলেন। এর আগে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান, স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার পর্যায়েও জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছিলেন। তার এই হত্যাকাণ্ড যেভাবে কলকাতায় তার বন্ধু সংঘটিত করার মাধ্যমে তাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করেছিল সেটি খুবই অভিনব এবং রহস্যাবৃত।

সংসদ সদস্য আনার কীভাবে এই মৃত্যুর ফাঁদে পা দিয়েছিলেন সেটিও অনেকের কাছে এখনো বোধগম্য নয়। তবে এই হত্যাকাণ্ডটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতার জন্ম দিলো যা রাজনীতিবিদদের জীবনযাপন, চলাফেরাসহ সবকিছুকে নিয়ে নতুনভাবে ভাবনাচিন্তা করার অশনিসংকেত দিয়ে গেছে বললেও কম বলা হবে। অনেক রাজনীতিবিদই নিয়মনীতি এবং শৃঙ্খলা মেনে চলার ক্ষেত্রে যে চরম উদাসীনতা প্রদর্শন করেন, আনারের মৃত্যু তেমনই কিছু যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে। চিকিৎসার জন্য কলকাতায় আনার গেলেন সত্য কিন্তু কাউকেই সঙ্গে নিলেন না। সেখানে গোপাল নামের এক বন্ধুর বাড়িতে আতিথেয়েতা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরদিন ডাক্তারের কাছে যাওয়ার নাম করে তিনি বের হওয়ার পর পরিবার কিংবা বন্ধু গোপালের সঙ্গেও যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। সেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর থেকেই তিনি আক্তারুজ্জামান শাহীনের নিয়ন্ত্রণেই বোধহয় চলে গিয়েছিলেন।

আমরা এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে এই মুহূর্তে আর বিশেষ কিছু বলতে চাই না। তবে আওয়ামী লীগের মতো বিশাল এই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যারা জড়িত আছেন, মন্ত্রী-এমপি ইত্যাদি পদপদবী যারা অলংকৃত করেন তাদের রাজনীতি নিয়ে এমন আলোচনা-সমালোচনার জন্ম যাতে না ঘটে সেটি বোধহয় গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার সময় এসেছে। আওয়ামী লীগের বহু এমপি, প্রভাবশালী নেতার আচার, আচরণ, বিত্ত বৈভব এবং প্রভাব বলয় নিয়ে সর্বত্র নানা কথা গুঞ্জরিত হয় যা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে খুব একটা যায় না। সময় বদলে গেছে, ক্ষমতার বৃত্ত ভয়ানক রকম পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। এসবের নিয়ন্ত্রণ দলের কোনো কোনো পর্যায়ে থাকা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। দল যদি এখনই এসবের দিকে মনোযোগী না হয়, তাহলে শুধু দলকেই নয়, দেশের রাজনীতিকেও এরজন্য আরো ব্যাপকভাবে জনগণের কাছ থেকে পিছিয়ে পড়তে হতে পারে।

প্রায় একই সময়ে আলোচনায় ঝড় তুলেছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। তার সম্পদ, অর্থবিত্ত নিয়ে বেশ কিছুদিন আগেই পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামতে বাধ্য হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন এ পর্যন্ত তার সম্পদ কেনার ৮৩টি দলিল জব্দ করেছে। আদালত তার ৩৩টি ব্যাঙ্ক একাউন্ট জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এর বাইরেও বেনজীর আহমেদের আরো বহু সম্পদ রয়েছে, এটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। গুলশানে তার ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় তার রিসোর্টসহ প্রচুর ভূসম্পত্তি রয়েছে। বেনজীর আহমেদকে নিয়ে কানাঘুষা অনেক আগে থেকেই ছিল। তিনি যে দম্ভভরে চলতেন সেটি সকলেই দেখেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো সরকারের আইজিপির মতো একটি মর্যাদাপূর্ণ পদে বসে তিনি যেসব সম্পদ অর্জন করেছেন তা নিশ্চয়ই সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের দৃষ্টির বাহিরে ছিল না। তাছাড়া তিনি আইজিপি পদে বসেই এত সম্পদের মালিক হয়েছেন তা নয়। পূর্ববর্তী যেসব পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন তার সব ক্ষেত্রেই তিনি ক্ষমতার নিশ্চয়ই অপব্যবহার করেছিলেন। নতুবা একজন সরকারি চাকরিজীবীর পক্ষে এত বিপুল সম্পদের অধিকারী হওয়া অনেকটাই কল্পনার বাইরের বিষয়।

বেনজীর আহমেদকে বাহির থেকে সকলেই একজন শিক্ষিত এবং রাষ্ট্র-সমাজ ও বিশ্ব সম্পর্কে পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষ বলেই জানতেন। একজন যথার্থ শিক্ষিত মানুষ কখনো এত সম্পদের পেছনে ছোটেন বলে বিশ্বাস করা যায় না। এত ব্যাংক একাউন্টই বা কেন তার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তার এইসব কর্মকাণ্ড যেকোনো বড়ো পদে নিয়োগপ্রাপ্তির আগে নিশ্চয়ই আমলনামা হিসেবে সরকারের দেখার কথা। কেন তখন বেনজীর আহমেদের এসব তলিয়ে দেখা হয়নি সেটি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। আইজিপি পদে অতীতে অনেকেই দায়িত্ব পালন করে গেছেন। সবাই যে খুব সুনাম কুড়িয়ে গেছেন তা বলবো না। কিন্তু বেশ কয়েকজন আইজিপির নাম এখনো শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়ে থাকে। বেনজীর আহমেদ অবসরে যাওয়ার আগমুহূর্ত থেকেই নানা কানাঘুষার জন্ম দিয়ে যে সন্দেহের সৃষ্টি করেছিলেন তাতে এখন যে চরম অগ্নি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তা নেভানোর ক্ষমতা বোধহয় তার অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের মধ্যে সঞ্চিত নেই।

এই ঘটনা যে শিক্ষাটি দিয়ে যায় তা হলো সরকারি উচ্চপদে যাকেই নিয়োগ দেওয়া হোক না কেন তার আমলনামাটি সরকারেরই দায়িত্ব হচ্ছে ভালোভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা। শুধু আইজিপি বেনজীর আহমেদের কথাই বলবো না, আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে অনেকেই সরকারের জন্য বিব্রতকর বহু পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সেসব ঘটনা গণমাধ্যমে পালাক্রমে লেখা হলেও অনেকসময় সেগুলো উপেক্ষিত হয়েছে। কিন্তু এর মাধ্যমে সরকারের জন্য তারা যে বদনাম রেখে গেছেন সেটি কোনোকালেই নিঃশেষিত হওয়ার নয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন যে, কারো ব্যক্তিগত দুর্নীতি ও বদনামকে সরকার প্রোটেক্ট করবে না। এটি খুবই যৌক্তিক কথা। কিন্তু বেনজীর আহমেদ আদালত থেকে নির্দোষ প্রমাণ করে বের হয়ে আসার আগ পর্যন্ত এর দায়ভার অনেকেই সরকারের ওপর দেবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু অভিযোগ এবং তার ও তার পরিবারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তিনি অবশ্য ৪ বছর আগেই অবসরে যাওয়ার পর এখন তার বিরুদ্ধে এইসব অভিযোগ মোটেও আইনের দৃষ্টিতে খুব একটা গ্রহণযোগ্য নয় বলেই অনেকে মনে করেন। আজিজ আহমেদ তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের প্রতিবাদ করেছেন এবং নিজেকে নির্দোষ বলে দাবিও করেছেন। ফলে আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে মার্কিন প্রশাসনের অভিযোগ অনেকটাই ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেখার বিষয়। সম্ভবত জুলাই মাসের দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরে যাচ্ছেন। সেকারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক কোনো সংকেতের মাধ্যমে জানানো হতে পারে। বাংলাদেশকে অনেককিছুই দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বৃহৎ শক্তিবর্গের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়কে বিবেচনায় যেমন নিতে হয়, আবার পাশ কাটিয়েও যেতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে কতটা পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে যাওয়া সম্ভব হবে?

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: ইতিহাসবিদ, কলাম লেখক ও সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :