শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষাদানের আদিঅন্ত কথকতা
গুরুগণ শিষ্যদেরকে ধন সম্পদ দিতে পারেন না। তারা অন্তর্লোকের ধনের সন্ধান দিতে পারেন অথবা ইহজাগতিক ধনাগারের পথ চিনিয়ে দিতে পারেন। গুরুর গৌরব এই দানের মধ্যেই। আদি গুরুর গৌরব আজকের গুরুদের মধ্যে নেই। সেজন্যই বুঝি আজ চারদিকে শিক্ষাগুরুর লাঞ্ছনার খবর। গুরু জাতি আজ সাধারণের নিকট কুণ্ঠিত, সংকুচিত। শিক্ষকগণ দুর্নীতিপরায়ণ, দালাল অভিধা পাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের হাতে লাঞ্ছিত, অপমানিত হয়ে অনেকেই এই মহৎ পেশা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন। বাংলাদেশে কোথায় নাই দুর্নীতি? খোদার ঘর মসজিদেও দুর্নীতি হয় এ দেশে। দ্যা মোস্ট করাপ্টেড অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে বিগত সরকারের প্রিয়ভাজন লোকজন এখনো বহাল তবিয়তে কাজ করছেন। অনাকাঙ্ক্ষিত বদলী, অপসারণও হচ্ছেন। কিন্তু শিক্ষকদের মতো চরম অপমানিত, লাঞ্ছিত হয়ে কেউ পদত্যাগ করতে বাধ্য হননি। কিন্তু এখন কেন এমনটা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমার নিজস্ব কিছু ভাবনা আমি এখানে তুলে ধরছি।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি কবিতা খুব আপ্লোড হচ্ছে। মোগল বাদশাহ আলমগীরের পুত্রকে শিক্ষা দান করতেন দিল্লির এক মৌলভী সাহেব। একদিন প্রত্যুষে বাদশাহ দেখলেন তার পুত্র শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালছেন আর শিক্ষক স্বহস্তে তার পদদ্বয় প্রক্ষালন করছেন। হঠাৎ মৌলভী সাহেবও বাদশাহকে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। মৌলভী সাহেবের তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার জোগাড়। না জানি আজ তার কপালে কী আছে! পরদিন মৌলভীকে তলব করলেন বাদশাহ আলমগীর। মৌলভী সাহেব ভয়ে ভয়ে হাজির হলেন বাদশাহর খাস কামরায়। বাদশাহ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, মৌলভী সাহেব কি তার পুত্রকে আদবকেতা ঠিকঠাক শেখাচ্ছেন? কবি কাজী কাদের নেওয়াজ রচিত শিক্ষাগুরুর মর্যাদা নামক বিখ্যাত একটি কবিতার বিষয়বস্তু এটি। প্রাথমিক পর্যায়ের এই কবিতাটি বহুকাল ধরে পঠিত হচ্ছে।
গুরু মহাশয় পা প্রক্ষালন অবস্থায় বাদশাহকে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেন ভীত হয়ে পড়লেন? শিক্ষকের পদযুগলে ছাত্র কর্তৃক সামান্য পানি ঢেলে দেওয়া এমন কী অপরাধ? মৌলভী সাহেবের ভীতি থেকেই বোঝা যায় সেসময় সমাজে তার অবস্থান কোথায় ছিল। শিক্ষকের মর্যাদা হয়তো ছিল কিন্তু তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না। উজির নাজির, আমীর ওমরাহ, অভিজাত সম্প্রদায় পরিবেষ্টিত শাসন ব্যবস্থায় গুরুর গুরুত্ব ছিল না ততটা। কারণ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র কাঠামোতে গুরুজিকে অতটা দরকার নেই।
আবার রাষ্ট্র কিন্তু ঠিকই গুরুজিকে কারণ দর্শানো নোটিশ করেছে, কেন বাদশাহ নন্দনকে সঠিক আদবকেতা শেখানো হয়নি? বাদশাহ তাকে কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন। তাকে তো আর শূলে চড়ানো বা গর্দান নেবার দণ্ডাদেশ দেননি। যাক গুরুর আত্মা যেন ধড়ে এলো। তাই তো গুরুজি খুশিতে গদগদকণ্ঠে বাদশাহর প্রশস্তি করতে লাগলেন। এতে এটাই প্রতীয়মান হয়, এই যে শিক্ষককে বাদশাহ কর্তৃক সম্মান প্রদান, এটা যেন বাদশাহর মহানুভবতা। এটা তো সতঃসিদ্ধ ন্যায্য প্রাপ্তি নয়। কিন্তু গুরু বা শিক্ষকের সম্মান তো চিরকালীন। যেটা ন্যায্য পাওনা সেখানে মহানুভবতা কেন? চারশ বছর পূর্বের শিক্ষকের মর্যাদা এবং ব্যক্তিত্ববোধ আর আজকের শিক্ষকের অনুরূপ অবস্থার মধ্যে পার্থক্যটা কি খুব বেশি?
সুপ্রাচীনকাল থেকেই রাষ্ট্র কাঠামোর বাইরে রাখা হয়েছিল শিক্ষক সম্প্রদায়কে। অতি প্রাচীনকালে গুরুজিদের রাখা হয়েছিল তপোবনে। নাগরিক সমাজ থেকে ছিল তারা আলাদা। সেই তপোবন থেকে এলো আশ্রমে। তারপর টোলে। আমতলায়, জামতলায় কুঁড়ে ঘরের দাওয়ায় চলতো শিক্ষা দান। সেই টোল থেকে ছড়িয়ে পড়লো শহরে বন্দরে। গুরুজিরা যখন তপোবনে ছিলেন শিষ্যরাই সেখানে পড়তে যেতেন। পাঁচ, দশ বা বারো বছর ধরে শিষ্যগণ বিদ্যালাভ করতেন সেখানে। মাহিনা ছিল না গুরুজির। গুরুদেবের গরু পালন, বাগান পরিচর্যা, ফলমূল সংগ্রহ, গুরুজির স্ত্রী সন্তানদেরকে খেদমত এগুলোই ছিল শিষ্যের কাজ। গুরুজিদের জীবনযাপন ছিল সাদামাটা। পরিধান করতেন গাছের বল্কল। আহার করতেন বনজ ফলমূল, গাভীর দুধ, লতাপাতা সেদ্ধ। শিক্ষাজীবন নির্বাহ শেষে শিষ্যদের থেকে কিছু গুরুদক্ষিণা লাভ করতেন। এরকমই ছিল তাদের শিক্ষাদান ও জীবনযাপনের চালচিত্র। সেসময় গুরুজিরা ছিলেন একেকটি সায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। যেমনটা আজকের দিনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
গুরুদক্ষিণা আদায়ের ক্ষেত্রে গুরুরা অনেক সময় অন্যায়, অনৈতিক এবং নিষ্ঠুর পদ্ধতিও গ্রহণ করতেন। মহাভারতের দ্রোণাচার্য গুরুদক্ষিণাস্বরূপ শিষ্য একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে নিয়েছিলেন। গুরু শুক্রাচার্য বৃহস্পতিপুত্র কচকে বারো বছর যাবৎ সঞ্জীবনী বিদ্যা শিখিয়ে দক্ষিণাস্বরূপ কৌশলে একমুহূর্তে কচের সমস্ত সাধনা ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। পরশুরাম শিষ্য কর্ণকে করেছিলেন অভিসম্পাত। যার ফলশ্রুতিতে কুরুক্ষেত্রে তার করুণ মৃত্যু। অনেকক্ষেত্রেই গুরুজিরা শাসকবর্গকে খুশি করার জন্য এমন হীন কাজ সম্পাদন করতেন।
শাসকবর্গ গুরুজিদেরকে রাজনীতির অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করেছেন। দ্রোণাচার্যকে যেমন ব্যবহার করেছিল কৌরবগণ। সম্রাট আলেকজান্ডার রাজনীতির নেপথ্যে যুক্ত করেছিলেন তার শিক্ষাগুরু এরিস্টটলকে। এরকম বহু নজির রয়েছে ইতিহাসে। প্রশাসনিক কাঠামোতে গুরু নাও থাকতে পারে কিন্তু প্রয়োজনে তাকে ব্যবহার করা তো যায়। তাই রাষ্ট্রও শিক্ষককে শ্রেণিকরণের প্রান্তিক সীমায় রাখতে পছন্দ করে। যাই হোক, রাষ্ট্রব্যবস্থা যুগে যুগে এটাই চেয়েছে যে, গুরুজিরা যেহেতু গো-পালনে অভ্যস্ত অতএব তারা তাই করুক এবং নিরীহ গোবেচারা হয়েই থাকুক। যেহেতু তপোবনের সেই স্বাধীনচেতা জীবনযাপন এবং প্রখর ব্যক্তিত্ব কালে কালে গুরুদের ব্যক্তিত্বকে স্পর্শ করেছে তাই আলমগীর বাদশাহর পুত্রের শিক্ষকের মতো কখনো কখনো তারা ছুরির পিঠে হঠাৎ সূর্যালোক পড়ার মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠে। আবার পরক্ষণেই প্রশাসনের সামান্য পিঠ বুলানোতেই তাদের মেরুদণ্ড বিনয়ে নুয়ে পড়ে।
সুশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান বৃটিশ সরকারের অধীনে শিক্ষাগুরুদের কেমন সম্মান ছিল সে তো আমরা সেই নিম্ন মাধ্যমিকে পণ্ডিত মশাই (সৈয়দ মুজতবা আলী) গল্পটি পড়েই জেনেছি। স্কুল ভিজিটে আসা লাট সাহেবের কুকুরের তিন টা ঠ্যাং ছিল। তিন ঠ্যাং-এর জন্য মাসিক খরচ হতো ৭৫ টাকা। প্রতি ঠ্যাং-এ খরচ ২৫ টাকা। পণ্ডিত মশাইয়ের মাসিক বেতন ২৫ টাকা। পণ্ডিত মশাইয়ের পরিবারের সদস্য একুনে ৮ জন। সেদিন পণ্ডিত মশাইয়ের মুখ লজ্জায়, বিতৃষ্ণায় ছাত্রদের সামনে নত হয়ে গিয়েছিল।
এরপর আসি তালসোনাপুরের তালেব মাস্টার ( ড. আশরাফ সিদ্দিকী)-এর কথায়। বৃটিশরা এদেশ থেকে চলে যাবার পর সকলের স্বপ্নের পাকিস্তানে অভাবপীড়িত তালেব মাস্টারকে দেখি। তার অনেক ছাত্র তখন দেশ বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। মাস্টার মশায় সক্ষোভে বলেছেন স্বাধীন দেশে অনেকেরই ভাগ্য খুলেছে কিন্তু তার ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। টাকার অভাবে ছেলেটার পড়া বন্ধ হয়ে যায়। অবশেষে ছেলেটি কলেরায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। ওদিকে অভাবে বস্ত্র সংকট ঘোচানোর জন্য গলায় কলসি বেধে পানিতে ডুবে তালেব মাস্টারের মেয়ে আত্মবিসর্জন দিয়ে নিজের লজ্জা রক্ষা করে। দরিদ্র তালেব মাস্টারের করুণ চিত্র আমরা দেখি। প্রায় শত বছর পরে আজকের পণ্ডিত মশাইগণ এই তরতাজা, নতুন, দৃঢ়, মজবুত স্বাধীন দেশে খোলা ময়দানে, রাস্তায় না খেয়ে শুয়ে থাকে বেতনবৃদ্ধির জন্য। এই পণ্ডিত মশাইগণ ঈদের দিন বাচ্চাদেরকে এককেজি গরুর মাংস কিনে খাওয়াতেও ব্যর্থ হন।
এবার বলি শিক্ষকদের মর্যাদাদানে বাংলা সিনেমা নাটকের অবদানের কথা। বাংলা সিনেমা গুরুজিকে আদর্শিক এক টাইপ চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছে। নিরীহ, গোবেচারা, সৎ, আবেগপ্রবণ এক ভিন্ন মাত্রার টিপিকাল চরিত্র। কথাবার্তা, আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ সমস্তই আদর্শের ছাঁচে ঢালা। আদর্শিক বঙ্গীয় মাস্টার মশাই। ছাঁচের বাইরে তিনি বেরুতে পারেন না। তার মুখাগ্রে সর্বদা নীতিবাক্য, গৃহে দীনতার ছাপ। তবুও তাতে তিনি তৃপ্ত। অসৎ পথে উপার্জিত সন্দেহ হলে এক লোকমা ভাতও গলা দিয়ে নামে না তার। প্রবল আত্মাভিমানী। চেয়ারম্যানের ছেলে টুঁটি চেপে ধরলে বলে আমি শিক্ষক, আমি মানুষ গড়ার কারিগর। পরিবার নিয়ে গলায় কলসি বেঁধে ডুবে মরে তবু অভাবের কথা কাউকে জানতে দেয় না। মহল্লার মাস্তান, পলিটিকাল লিডার মেয়েকে ধর্ষণ করলে মেয়ের সাথে গুরুজিও বিষপান করে আত্মাহুতি দেন। বাস্তব কথা হচ্ছে আমাদের মননে ও মস্তিষ্কে শিক্ষকদের এই চিরন্তন প্রতিকৃতি খোদিত হয়ে গেছে যে, শিক্ষকদের কোনো ব্যক্তিগত প্রত্যাশা থাকবে না। থাকবে না কোনো আকাক্সক্ষা অথবা অপ্রাপ্তির ক্ষোভ। কিন্তু মনুষ্য মাত্রই তার ক্ষোভ থাকবে, প্রত্যাশা থাকবে, প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা থাকবে। যখন এ সকল সহজাত প্রবৃত্তিকে অবদমিত করে রাখার চেষ্টা করা হয় তখন সেগুলোর বিকৃত বহিঃপ্রকাশ ঘটে। শাসক পরিবর্তন হয় কিন্তু শাসকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তনীয়। শাসকগোষ্ঠী আজও শিক্ষকদের ব্যবহার করছেন এবং নড়বড়ে মেরুদণ্ডের শিক্ষকগণও ব্যবহৃত হচ্ছেন। বিগত পনেরো বছরে বাংলাদেশে অত্যন্ত শক্তিশালী বৃহৎ আকারের মোসাহেব শ্রেণি গড়ে উঠেছিল। তন্মধ্যে শিক্ষক শ্রেণি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র এরা সক্রিয় ছিল। এরা ছিল একাধারে তোষণজীবী এবং রাজনীতিবিদ। ফ্যাসিস্ট শাসননীতি বর্তমান প্রজন্মকে একটা বশংবদ গোষ্ঠীতে পরিণত করতে চেয়েছিল। এটা করার প্রথম ও প্রধান মাধ্যম শিক্ষা ও শিক্ষক। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সর্বস্তরে এমন পাঠ্যসুচি প্রবর্তন করা হয় যেখানে রীতিমত দলীয় চর্চা, রাজবন্দনা, রাজতন্ত্রের চর্চা ছিল ব্যাপকভাবে। শিক্ষকদের মাধ্যমেই এর বাস্তবায়ন সম্ভব। দলীয় আচার অনুষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্রীয় আচার অনুষ্ঠানে রূপান্তর করা হয়েছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এগুলো পালন করা বাধ্যতামুলক করা হয়। এর মাধ্যমেই শিক্ষকদের মধ্যে একটা শ্রেণি বিদূষক এবং সরকার দলীয় রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেন। তারা ছাত্রদের সম্মুখে রাজনীতিবিদদের মতো নিজেদেরকে উপস্থাপন করেন। বিভিন্ন প্রোগ্রাম বা অনুষ্ঠানে রাজনীতিবিদদের মতো বক্তব্য রাখেন। এর মাধ্যমে তারা শাসককুলের বিশেষ সদয় অনুগ্রহ লাভ করেন। রাজানুকুল্যে তারা তাদের ক্ষমতার দাপট দেখাতেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করতেন। নীতি নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়েছিলেন তারা। যারা এগুলো অপছন্দ করতেন তারাও কিছু বলতে পারতেন না ভয়ে। শিক্ষার্থীরা ও অন্য সহকর্মীদের নিকট এরা ভাঁড় হয়ে গিয়েছিলেন, খেলো হয়ে গিয়েছিলেন।
অপরদিকে যাদেরকে কেন্দ্র করে একজন শিক্ষিত ব্যক্তি শিক্ষক হয়ে ওঠেন, সেই শিক্ষার্থীদের শিক্ষকের প্রতি আচরণ কী বলবো! রবীন্দ্রনাথের ভাষায় 'তথৈবচ' এবং বর্তমানে এর অভাবিত নজির পাচ্ছি আমরা। যতদুর মনে পড়ে ২০০২/২০০৩ সালে শিক্ষক দ্বারা শিক্ষার্থী নির্যাতনের কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিল। ২ জন শিশুও নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। তখন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেত নিষিদ্ধ করা হয়। শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন করিয়ে দেওয়া হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে আর ভয় পায় না। অপর দিকে শক্ষার্থীদের শিখন একটা গুরুত্বপুর্ণ বিষয় এখানে। প্রাইমারি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য আবশ্যিক বিষয়। গত দেড় দশকে সেখানে যেসব কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে শিশু থেকে তরুণদের মনোজগতে তার বিশেষ প্রভাব পড়েছে। কেননা বাংলাসাহিত্যে বিদ্রোহাত্মক, বিপ্লবাত্মক বিষয় সম্বলিত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও অন্যান্য বিষয় সংযুক্ত হয়েছে। এসকল বিষয় পড়ে শিক্ষার্থীরা অবশ্যই অনুপ্রাণিত হয়। ওরা এটা রপ্ত করে ফেলেছে যেকোনো ব্যাপার নিজের কিঞ্চিত বিরুদ্ধে গেলেই সেখানে প্রতিবাদ করতে হবে। তাদের স্বভাবের মধ্যে একটা দুর্বিনীত ভাব জন্ম নিয়েছে। আজকে ছাত্ররা শিক্ষকদের নিকট জ্ঞান প্রত্যাশী নয়। তারা যেন শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ঠাণ্ডা যুদ্ধ বা স্নায়ু যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে। সমস্ত কিছু মিলিয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক আজ তিক্ততায় পর্যবসিত হয়েছে।
আজ এ কথা স্বীকার করতে লজ্জা লাগবে না যে, শিক্ষকদের সত্যিকার অর্থেই মেরুদণ্ড নাই। এটা বিগত দেড় দশক ধরে প্রমাণিত হয়ে আসছে। এখনো হচ্ছে। আমাদের ব্যক্তি মনস্তত্ত্ব এবং সামষ্টিক মনস্তত্ত্বে সেই তপোবন থেকে আজকের শিক্ষকদের এমন একটা রূপ চিত্রিত হয়ে গেছে যে, শিক্ষকগণ এমন একটি প্রজাতি যাদেরকে ভাঙা যায়, মোচড়ানো যায়, নিংড়ানো যায় আবার ফেলে রেখে জং ধরানোও যায়। অতএব মর্যাদাবোধের ন্যাকামি, আত্মসম্মানের আদিখ্যেতা গুরুজিরা কীভাবে দেখাতে পারেন?নীলুফার ইয়াসমিন: কলাম লেখক ও সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, সরকারি মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ, টাঙ্গাইল