মনিপুরে ‘রাজভবনে’ ভারতীয় পতাকা সরিয়ে মেইতি পতাকা টানিয়েছে শিক্ষার্থীরা
কুকি ও মেইতেই জাতিগত সংঘাতে সাম্প্রতিক সমেয় উত্তাল ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর। প্রায় চার মাস শান্ত থাকার পর সম্প্রতি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর পর নতুন করে বিক্ষোভ দানা বেধেছে রাজ্যটিতে।
এরই মধ্যে রাজ্যের থৌবাল জেলার রাজভবনে ভারতের জাতীয় পতাকা সরিয়ে সেখানে মেইতেই জাতিগত প্রতিকের (মণিপুরি/মেইতি) পতাকা লাগিয়েছে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।
সোমবার দুপুরে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মেইতি পতাকা নিয়ে একটি র্যালি শেষে জেলার ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) অফিসে (রাজভবন) নিজস্ব জাতিগত পতাকা ওড়ায়। এদিন বিকালে ভারতীয় গণমাধ্যম ফ্রি প্রেস জার্নাল এ খবর দিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রাজ্যটির থৌবাল জেলায় অবস্থিত রাজভবনে হামলা চালায় শিক্ষার্থীরা। পরে তারা রাজভবনের ওপর টাঙানো ভারতের পতাকা নামিয়ে ফেলে এবং মেইতি পতাকা স্থাপন করে।
ফ্রি প্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়, মণিপুরের ছাত্ররা সোমবার সরকারি ভবনে হামলা চালিয়ে তাদের বিক্ষোভ তীব্রতর করে। এদিন সকালে বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজ্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, বিশেষ করে রাজ্যের নিরাপত্তা উপদেষ্টার অপসারণ, বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত ‘ইউনিফাইড কমান্ড’ এর দায়িত্ব রাজ্য সরকারের কাছে হস্তান্তর, আধাসামরিক বাহিনী প্রত্যাহার এবং রাজ্য বিধায়কদের পদত্যাগের দাবিতে রাজধানী ইম্ফলের রাস্তায় নামে।
বিক্ষোভে শিক্ষার্থীরা ‘মণিপুর দীর্ঘজীবী হোক’, ‘সমস্ত অযোগ্য বিধায়ক পদত্যাগ করুন’, ‘রাজ্য সরকারকে নিরাপত্তার দায়িত্ব দিন’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়।
শিক্ষার্থীরা মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং এবং রাজ্যপাল এল আচার্যের সঙ্গে দেখা করেন।
রাজ্যপালের সঙ্গে বৈঠক শেষে ছাত্র প্রতিনিধিরা সাংবাদিকদের বলেন, তারা সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার অভিযোগে পুলিশ মহাপরিচালক (ডিজিপি) এবং রাজ্য সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টার অপসারণসহ ছয়টি দাবি জানিয়েছে। তারা বর্তমানে সিআরপিএফের প্রাক্তন ডিজি কুলদীপ সিং-এর সভাপতিত্বে ইউনিফাইড কমান্ড সিংকে হস্তান্তর করার আহ্বান জানিয়েছে।
কলেজের ছাত্র এম সানাথোই চানু সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা কোনো বাধা ছাড়াই অবাধে পড়াশোনা করতে চাই। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দ্বন্দ্ব শেষ করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি।’
পৃথকভাবে এদিন রাজ্যের থৌবল ও কাকচিং জেলায় সন্দেহভাজন কুকি জঙ্গিদের দ্বারা সাম্প্রতিক বেসামরিক হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এতে হাজার হাজার মেইতেই জাতিগোষ্ঠীর ছাত্র-জনতা অংশ নেয়। এক পর্যায়ে থৌবলের রাজভবনে ভারতীয় পতাকা সরিয়ে মেইতি পতাকা স্থাপন করে শিক্ষার্থীরা।
বিক্ষোভ থেকে সাসপেনশন অফ অপারেশনস (এসওএস) চুক্তি বাতিলের আহ্বান এবং বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা মোকাবেলায় আরও সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে মণিপুরে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি রাজ্যের রাজধানীতে সন্ত্রাসী হামলায় এক মহিলাসহ দুইজনের মৃত্যু হয়, আহত হন একাধিক ব্যক্তি। সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা ইম্ফলের পাহাড় থেকে কৌত্রুক ও পার্শ্ববর্তী কাদাংবন্দের নিচু এলাকা লক্ষ্য করে হামলা চালায়। হতাহতের পাশাপাশি বহু বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশেই রয়েছে কুকি জনবহুল পার্বত্য জেলা কাংপোকপি। অভিযোগ রয়েছে, সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা কুকি সম্প্রদায়ভুক্ত। এমনকি গত ৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় মণিপুর রাইফেলসের দুটি ব্যাটেলিয়নের অস্ত্রাগার লুট করার চেষ্টা করা হয়। এরপর থেকেই বারবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মণিপুরের পরিস্থিতি।
এছাড়া মণিপুরের জিরিবাম জেলায় সহিংসতায় চারজন সন্দেহভাজন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্য ও এক বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। জিরিবামে মেইতেই সম্প্রদায়ের এক প্রবীণ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ। এই ঘটনার পর সহিংসতা আরও ছড়িয়ে পড়ে। রাজ্যে সাম্প্রতিক সহিংসতায় অত্যাধুনিক ড্রোন ও আরপিজি (রকেট চালিত বন্দুক) ব্যবহার করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, এ ধরনের অস্ত্র সাধারণত যুদ্ধের সময় ব্যবহার করা হয়। পুলিশ সন্দেহ করছে, বোমার বিস্ফোরণে ওই প্রবীণ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। সেটি ছোড়া হয়েছিল সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মাইরেমবাম কোইরেঙের বাড়িকে লক্ষ্য করে।
কাছাকাছি একটি জায়গায় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ওই প্রবীণ। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়েছে, যিনি মেইতেই সম্প্রদায়ের। গত সপ্তাহে একাধিক জায়গায় বোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। মেইতেইরা বরাবরই এই হামলার জন্য কুকিদের দায়ী করছে।
(ঢাকাটাইমস/০৯সেপ্টেম্বর/এসআইএস)