আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কে দিয়েছে?
প্রকৃত কবিরা ত্রিকালদর্শী হয়ে থাকেন। তারা ভবিষ্যৎকে নিজের বর্তমানে দাঁড়িয়েই দেখতে পান। যে কারণে গভীর বোধ নিয়ে বলতে পারেন ভবিষ্যতের কথা কিংবা রেখে যেতে পারেন কিছু অমরবাণী- যা সব সময়ই প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকে। কিছুদিন ধরে নিজে নিজেই গুমড়ে মরছি, কিছু বলার ভাষা নেই, তবু কিছু বলতে চাই। শিক্ষকদের অপমান; তাদের নির্যাতন, গলায় জুতার মালা দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ানো- এসব ভাবা যায় না। এ ধরনের অপমান সহ্য করতে না পেরে একজন শিক্ষক স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণও করেছেন। এই পর্ব শেষ না হতেই শুরু হলো আমাদের দেশে সব পির পয়পম্বগর, পির মাশায়েকদের মাজার ভাঙা। এই সময়ে দুএকদিনের ব্যবধানে পিটিয়ে হত্যা করা হলো চারজনকে। এই যে অমানবিক কাজ-কর্ম তা সত্যিই আমাদের হতাশাগ্রস্ত ও মর্মাহত করছে। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় যেন আমাদের সেই সব কথাই বলতে চেয়েছিলেন। ‘মানুষ মেরেছি আমি- তার রক্তে আমার শরীর/ ভ’রে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার/ ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু/ হৃদয়ে কঠিন হয়ে বধ ক’রে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর/ কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে/ বধ ক’রে ঘুমাতেছি- তাহার অপরিসর বুকের ভিতরে/ মুখ রেখে মনে হয় জীবনের স্নেহশীল ব্রতী/ সকলকে আলো দেবে মনে ক’রে অগ্রসর হ’য়ে/ তবুও কোথাও কোনো আলো নেই ব’লে ঘুমাতেছে।’
কিছু কিছু মৃত্যু আমাদের হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়। ২০১৯ সালের ৬ই অক্টোবর বুয়েটের মেধাবি ছাত্র আবরার ফায়াদের মৃত্যুও সারা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এটাও সংঘটিত হয়েছিল ছাত্র নামে কিছু অছাত্র, মনুষ্যত্বহীন হায়েনাদের হাতে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ বিকেলে ক্যাম্পাসের একটি দোকানে ছিলেন- কিছু ছাত্র তাকে ঘিরে ধরে বেধড়ক মারপিঠ করে। তার অপরাধ ১৫ই জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও বহিরাগত সন্ত্রাসীদের হামলায় তিনিও যুক্ত ছিলেন। এই আঘাতের পর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক বলেন সে আগেই মারা গেছে। আবার বগুড়ারও একই ঘটনা। শেরপুর উপজেলায় ভোরে গোরু চোর সন্দেহে আসিফ প্রামাণিক (৪০) নামের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। কয়েকদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসুদ নামে পঙ্গু একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পানি পান করতে চাইলেও তাকে পানি দেওয়া হয়নি। সদ্য কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছিলেন মাসুদ। এর আগে আমরা দেখেছি আদালত চত্বরে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ওপর জনতার পঁচা ডিম নিক্ষেপ, সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি ও আরিফ খান জয়ের ওপর হামলা, সাংবাদিক ফারজানা রূপাকে থাপ্পড় মারা, রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনুকে দৌঁড়ে গিয়ে কিক মারা, বিচারপতি মানিককে মারধরের ঘটনা ইত্যাদি।
আমার প্রশ্ন কেউ অপরাধ যদি করেও ফেলে তাহলে তো তার বিচার করবে আইন। আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অপরাধীর বিচার হতে হবে। তাই বলে সন্দেহের বশীভূত হয়ে একজন মানসিক প্রতিবন্ধীকে এভাবে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করতে হবে? তাহলে কি আমরা বুঝে নেবো উচ্চশিক্ষা আমাদের মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে পারেনি। আমরা ডিগ্রিধারী হলেও আমাদের পশুত্বকে দমন করতে পারিনি। আমরা একজনকে চোখের সামনে কষ্ট দিয়ে দিয়ে হত্যা করছি এতেই আমাদের তৃপ্তি। আবার অপরাধীরা বলছে আবেগে তাকে অত্যাচার করেছি। ধিক্ ধিক্ তাদেরকে যারা সকল ছাত্রকে কলঙ্কিত করেছে। ঘৃণায় মানুষ থু-থু ছিটাচ্ছে ডাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি। সারা দেশের মানুষ আজ এক হয়ে চোখের জল ঝরিয়েছে ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলের উপর অমানবিক নির্যাতনের ভিডিয়ো দেখে। আবার এখানে বলা হয়েছে যারা অত্যাচার করেছে তারা ছাত্রলীগের দলছুট ছেলে। আমরা সবাই ভিডিয়োর কল্যাণে দেখেছি যে সময় তোফাজ্জলকে যেখানে পেটানো হয় সেখানে ১৫/২০ জনের মতো ছাত্র উপস্থিত ছিল। সেখানে কি সবাই ছাত্রলীগের ছাত্র ছিল। তাহলে কি আমরা বুঝেই নেবো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনো ছাত্রলীগের দখলেই রয়েছে। যে খুন করে সে তো খুনী তার আবার দল কী? সে যে দলেরই হোক না কেন সে তো খুনী। তার বিচার করতে হবে। এই লেখাটা লিখতে গিয়ে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল- বিশ্বজিতের কুপিয়ে হত্যা করার চিত্র। তাকে ২০১২ সালের ৯ই ডিসেম্বর পুরোনো ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের পাশে কুপিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়। সেই দৃশ্যও সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছিল এবং হতবাক হয়েছিল। যারা তাকে কুপিয়েছিল তারা সবাই ছিল ছাত্রলীগের কর্মী। সেদিন ছিল বিরোধী দলের ডাকা হরতালের দিন। এই মামলায় অভিযুক্তদের ২০১৩ সালের ১৮ই ডিসেম্বর ৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। হাইকোর্ট ২০১৭ সালে এই রায়ে দুজনকে মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে চারজনকে যাবজ্জীবন দেয়। শামীম প্রায় নয়/দশ বছর পূর্বেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রত্ব ঘুচিয়েছেন। জানা যায় ক্যাম্পাসের পাশেই তার বাড়ি। তার একটি পালিত কুকুরও ছিল। এই কুকুরের খাবারের জন্যই সে দোকানে এসেছিল। সেখান থেকেই তাকে পেটাতে পেটাতে ক্যাম্পাসের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তারা শামীমের কুকুরকেও পিটিয়ে হত্যা করে। শামীমকে এখান থেকে প্রক্টোরের অফিসে নিয়ে গেলেও সেখানে তাকে পেটানো হয় এবং একটা রুমে শামীমকে তালা মেরে রাখা হয়। পরে সেই তালা ভেঙে শামীমকে পিটিয়ে মারা হয়।
বরগুনা, পাথরঘাটার মেধাবী সন্তান তোফাজ্জল। ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাথরঘাটা কলেজে ভর্তি হয়, এ সময় স্থানীয় চেয়ারম্যানের মেয়ের সাথে প্রেম হয় তার; কিন্তু মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। মা-বাবাও রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তোফাজ্জলের। শোকে-দুঃখে সে পাগল হয়ে যায়। বড়ো ভাই ছিলেন পুলিশের এসআই! তিনি একমাত্র অভিভাবক- তিনিও লিভার ক্যান্সারে মারা যান। এই পাগল এতিমের আর দেখার কেউ ছিল না। তাই তো খাবারের জন্য ছুটে বেড়াতো তোফাজ্জল এখান থেকে সেখানে। ক্ষুধার জ্বালা বড়ো জ্বালা। তার তো চাহিদা বেশি ছিল না- মাত্র দশ/বিশ টাকা। যে ছেলেটা সমাজবিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স করেছে, একসময়ের ছাত্রনেতা, যার একটা আনন্দের পরিবার ছিল, সেই ছেলেটা বাবা মা ভাইকে হারিয়েছে, প্রেমের মানুষকে হারিয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে, হারিয়েছে স্বাভাবিক জীবন। ওর তো আর হারানোর কিছুই ছিল না। কিন্তু পেটের খিদের তাড়নায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরে ও খাবার চেয়ে বেড়াতো। হত্যা করার আগে ওকে পেটপুরে খাওয়ানো হয়েছে। যখন ওকে মারা হয় তখন এই ভাতের প্রতিটা দানা ওর শরীরের ভেতরেই জমে ছিল।
আমার প্রশ্ন- তোফাজ্জলকে মারার সময় তোমাদের একটু মায়াও করেনি? বুকের মধ্যে হু-হু করে ওঠেনি। কীসের শিক্ষিত তোমরা। তোমাদের শিক্ষা দিয়ে দেশের কী হবে? এ শিক্ষার কী দাম আছে? যে শিক্ষা ভালো-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণ করার শিক্ষা দেয় না, সেটা কীসের শিক্ষা। একটা মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে কীভাবে উৎসব করে করে হত্যা করা হলো। কয়েকদিন পর দেখলাম- চট্টগ্রামে একজনকে দুইহাত দুই দিকে বেঁধে গান বাজিয়ে পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলা হলো। আমাদের মনুষ্যত্ব কোথায় আজ? ধরেই নিলাম এরা সবাই অপরাধী, তাই বলে কি তাদের হত্যা করার এখতিয়ার কারো আছে? তাদের আইনে সোপর্দ করলে আইন তার বিচার করবে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু না, আমরা বিবেকহীন আর মধ্যযুগীয় বর্বরতায় ফিরে গিয়েছি- হত্যা করেছি জীবন্ত মানুষকে, তবে হত্যার কৌশলও আবার ভিন্ন, জনসম্মুখে।
প্রশ্ন হলো- তোমরা যখন ভাত খাবে, গ্লাসে ঢেলে জল খাবে, তখন কি তোফাজ্জলের সেই ম্লানমুখ, বিষণ্ন মনমরা চেহারা, হতাশাগ্রস্ত, কাঙ্গালপনা মুখটা তোমাদের চোখের সামনে ভাতের বদলে ফিরে ফিরে আসবে না? জানি, এ পশ্নের কোনো উত্তর নেই। সর্বশেষ বলতে চাই, এই ঘটনাগুলো যদি সরকারের দিক থেকে আন্তরিকভাবে আমলে নেওয়া না হয় এবং দোষীদের যদি গ্রেপ্তার করে উপযুক্ত শাস্তি না দেওয়া হয়, তাহলে এই দেশ আরও ভয়াবহতার দিকে ধাবিত হবে।বঙ্গ রাখাল: কলাম লেখক, কবি ও প্রাবন্ধিক