জুলাই-আগস্ট বিপ্লব পরবর্তী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ভাবনা
আজ ১ নভেম্বর। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ দিবস। এটি বিচারক তথা বিচার বিভাগের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিবস। এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে নিহত আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ আহত হাজার হাজার ছাত্র-জনতা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের, যাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা বিশ্বের দরবারে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ ও জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছি।
সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক মাজদার হোসেন মামলার রায় অনুসারে, ২০০৭ সালের এই দিনে বিচার বিভাগকে বাংলাদেশে শাসন বিভাগ থেকে আলাদা করা হয়। আজ ১৭ বছর পার হলো সেই পৃথকীকরণের। বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের লক্ষ্য পূরণে সেই রায়ে ১২ দফা নির্দেশনা দিলেও তা সম্পূর্ণভাবে আজও কার্যকর হয়নি।
পৃথকীকরণের সময় দেশে সাড়ে ১৫ লাখ মামলার জট থাকলেও বর্তমানে তা এসে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৪৪ লাখে। ফলে পৃথকীকরণের সুফল অদ্যাবধি অধরা রয়ে গেছে (সূত্র: দৈনিক সমকাল)। তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের মূল দফা স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলছে, যা অনেকটা আশার সঞ্চার করে।
বর্তমান প্রধান বিচারপতি ইতোমধ্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিষয়ক তাঁর ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। সেখানে তিনি দ্রুত সুপ্রিম কোর্টের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। যত তাড়াতাড়ি তাঁর এ প্রস্তাব গৃহীত হবে, তত দ্রুত বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পথে এগোবে।
দেশ ও জাতিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সরকারের তিনটি অঙ্গ-শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হয়। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্র এটাই করে। অন্যান্য বিভাগের ওপর শাসন বিভাগের আধিপত্য, যা ব্রিটিশ আমল থেকে দৃশ্যমান, সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই কাম্য নয়। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার বিপ্লব, দীর্ঘদিনের স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী স্বাধীন বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করে নয় বরং স্বাধীন বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্র তৈরি করার মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা সংবিধানের ন্যায় মাজদার হোসেন মামলার রায়েও প্রতিফলিত হয়।
বিচার বিভাগের পৃথীকরণ নিয়ে বিগত ১৭ বছরে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার মোটাদাগে খুব বেশি কাজ করেনি, বরং বিচার বিভাগকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহার করেছে। এতে সহায়তা করে নির্বাহী বিভাগ, যার ফলে সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কনসেপ্টটি আজও পূরণ হয়নি, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
সত্যিকার অর্থে সরকারের কোনো বিভাগের মধ্যে আধিপত্য কিংবা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় একটি বিভাগের প্রভাব বিস্তার নয়, বরং সব বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে নিজ নিজ বিভাগের কার্য সম্পাদনে তৎপর ও উদ্যোগী হলেই সুশাসন অনেকটা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। সুতরাং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে সব সরকার, রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের এক মঞ্চে আসা দরকার। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে।
আইনের ব্যাখ্যাদান ও বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিচারকদের স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতাকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বোঝায়। তবে বিচারকদের এ ধরনের স্বাধীনতার অর্থ কোনোভাবে তাদের অবাধ কিংবা যা খুশি তাই করার ক্ষমতাকে বোঝায় না। বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পাশাপাশি সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিচারকদের দায় বহুলাংশে বেড়ে গেছে।
বিচারকের সঙ্গে ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি সাংঘাতিকভাবে জড়িত। জ্যাকবীয় যুগের (১৫৯৭) শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও আইনজীবী ফ্রান্সিস বেকন তাই বলেছিলেন, ‘আদালতে প্রতিটি অভিযোগ কোনো না কোনো ব্যক্তির অধিকারের প্রশ্নসম্পৃক্ত। ন্যায়বিচারের প্রশ্নে বিচারপ্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগত অনুরাগ যদি বিচারককে অপরাধীর পক্ষ নিতে প্ররোচিত করে, তবে তার উচিত সুনির্দিষ্ট রায় না দিয়ে বিষয়টিকে সমঝোতার মাধ্যমে ফয়সালার পদক্ষেপ নেওয়া।’
ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বিচারকদের আপসহীন ও বিবেকবান হতে বলেন ফ্রান্সিস বেকন, ‘বিচারকদের হতে হবে সিংহের মতো।’ সিংহাসনের ছত্রছায়া তাদের ওপর থাকবে, কিন্তু বিচারককে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হতে হবে অবিচল।
সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানবিরোধী বিধি-বিধানকে অবৈধ ও বিধিবহির্ভূত ঘোষণার ক্ষমতা দিয়েছে। সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণের অভিপ্রায়ে পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধান বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছে।
সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে অর্থাৎ রাষ্ট্র্র পরিচালনার মূলনীতি অংশের অনুচ্ছেদ ২২-এ বলা হয়েছে, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের বিধান সম্পর্কে। ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন। (Article 22 of the Constitution provides that the State shall ensure the separation of judiciary from the executive organs of the State.)।
সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার অংশের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ সংবিধান প্রবর্তন থেকে সে সকল আইন ততখানি বাতিল হবে।’অর্থাৎ সংবিধান আমাদের বিচার বিভাগকে স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বিচারকদের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে সংবিধানের ১১৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ ও ম্যাজিস্ট্রেট বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন। (116A. Subject to provisions of the Constitution, all persons employed in the judicial service and all magistrates shall be independent in the exercise of their judicial functions.) অর্থাৎ সংবিধানের বিধানমতে বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন।
তাদের নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘বিচারবিভাগীয় পদে বা বিচারবিভাগীয় দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উক্ত উদ্দেশ্যে প্রণীত বিধিসমূহ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করিবেন।’
বলার অপেক্ষা রাখে না, যদি কোনো রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তবে বিচারকার্যে নানা রকমের জটিলতার সৃষ্টি ও ন্যায়বিচার প্রলম্বিত হয়।
২০০৭ সালের আগে পর্যন্ত ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ইচ্ছামতো বিচার বিভাগকে সাজাতে চেয়েছে। অবশেষে ২০০৭ সালে স্বাধীনতার ৩৭ বছর পর অরাজনৈতিক ও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সিদ্ধান্তে আপন পথ ফিরে পায় বিচার বিভাগ। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদের এই বাস্তব রূপদান ছিল এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, যাকে দেশের বিচারাঙ্গণসহ সব স্তরের জনগণ সাধুবাদ জানায়। ২০২৪ সালে আবারও দেশে রাজনৈতিক সরকারের পতনের পরে ড. মো. ইউনূস স্যারের নেতৃত্বে অন্তর্বতীকালীন সরকার কাজ করছে। তাই এই সময়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরও মজবুত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
বিচার বিভাগ স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে ২০০৭-২০০৮ সালে বেশ কিছু আইন সংশোধন ও নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়, যেখানে ১৯৭২ সালের সংবিধানে উল্লেখিত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতিফলন ঘটে। যেমন- বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা ২০০৭, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পে স্কেল-২০১৬ ইত্যাদি। এছাড়া অধস্তন আদালতগুলোর শৃঙ্খলা বিধানসহ একটি আলাদা ও স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়।
সবচেয়ে যুগান্তকারী সংশোধনী আনা হয় ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এ। এই আইনের ৬ ধারায় দুই ধরনের ম্যাজিস্ট্রেটের পদ সৃষ্টি করা হয়। এক পক্ষে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যপক্ষে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭-১৪৮ ধারা, ১৭৬ ধারাসহ আরও কিছু ধারা যেমন ২৯(বি) ধারায় কার্যক্রম পরিচালনা ও দণ্ড প্রদানের ক্ষমতাসহ মোবাইল কোর্ট ২০০৯-এর অধীনে বাংলাদেশে প্রচলিত ১১৯টি (২০১৯ পর্যন্ত) আইনে নির্বাহী ম্যাজিস্টেটরা তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।
বিচার বিভাগের হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা মূলত বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ নীতির বাস্তবায়ন। জনগণ ইতোমধ্যে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সুফল টের পাচ্ছে। এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলা জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসিতে নিষ্পত্তি হয়েছে এবং হচ্ছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে।
বিশ্বের মধ্যম আয়ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আমাদের দেশে নির্বাচিত সরকার, আইন পরিষদ ও জুলাই বিপ্লবের পরে ছাত্র-জনতার হাতে গড়া দেশ ও বিচারব্যবস্থার নিরিখে দেশে গণতন্ত্রকামী জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা পূরণ করার উপযোগী পরিবেশ বিদ্যমান। তার পরও বাস্তবে আইনের শাসনের প্রতিফলন ঠিক সে রকম ফলাও করে লেখার মতো নয়। যদি বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়, তবে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন শক্তিশালী ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
সেদিক বিবেচনায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ। একই সঙ্গে বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সার্বিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করা শুধু স্বাধীন বিচার বিভাগের একার পক্ষে সম্ভব নয়। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথক (Separation of Power) হওয়াটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সবচেয়ে শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম মাত্র।
বিচার বিভাগের কাছে ন্যায়বিচার পাওয়া যেসব উদ্যোগ ও অনুষঙ্গের ওপর নির্ভর করে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বিচারকদের সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত মানসিকতা। তারা যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংকল্পে শক্ত অবস্থান নেন, তবে পৃথকীকরণের সুফল মিলবে তাতে সন্দেহ নেই।
বর্তমান ছাত্র-জনতার সরকার বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণে ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন। ছাত্র এবং জনগণও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে বিচার বিভাগের পৃথককরণ নীতি এই অন্তর্বতীকালীন সরকারের আমলে বাস্তবায়ন হবে। তারা আরও আশা করে, বিচার বিভাগ যাতে সামগ্রিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বদা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে, সে ব্যাপারে সরকার সার্বিক সহযোগিতা এবং বিচার প্রশাসনে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (Sustainable Development Goal) অর্জনে বদ্ধপরিকর।
সুতরাং, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে সব সরকার, রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের এক মঞ্চে আসা দরকার। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। বিচার বিভাগ পৃথক মানে যে কতগুলো পৃথক ভবন, পৃথক নিয়োগ কাঠামো, পৃথক কর্মচারী, পৃথক ওয়েবসাইট এবং পৃথক একটা সমিতি যেমন বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে বিষয়টি ঠিক তেমন নয়।
ছাত্র-জনতা বিচার বিভাগের যেমনটি স্বাধীনতা দেখতে চেয়েছিলেন সেটা হলো, সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় হবে, বিচার বিভাগের জন্য বাজেট প্রণয়নের বিচার বিভাগই প্রধান দায়িত্ব পালন করবে, এক্সিকিউটিভ এবং লেজিসলেচার বিচার বিভাগ নিয়ে কখনোই কোনো মাথা ঘামাবে না, বিচারকদের চাকরি, শৃঙ্খলা, বদলি, পদোন্নতি ইত্যাদিতে মন্ত্রণালয়ের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না, পৃথক একটি প্রসিকিউশন সার্ভিস হবে, পৃথক একটি তদন্তকারী সংস্থা হবে।
তবে কিছুই হচ্ছে না, সেটিও বলা যাবে না। যেমন- বিচারকদের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় গঠনের জন্য প্রস্তাব ইতোমেধ্য পাঠানো হয়েছে, ই-জুডিসিয়ারি প্রকল্প গৃহীত হয়েছে, আলাদা ন্যাশনাল জুডিসিয়াল একাডেমি প্রতিষ্ঠা, পৃথক বেতন কাঠামো, পৃথক নিয়োগ, বিচারকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা মোটাদাগে বেড়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। পৃথক সচিবালয়ও হবে এবং পৃথক একটি প্রসিকিউশন সার্ভিস হবে, পৃথক একটি তদন্তকারী সংস্থা হবে।
তবে আশার বাণী হলো, অন্তর্বর্তী সরকার গত ৩ অক্টোবর বিচার বিভাগ সংস্কার এবং এর স্বাধীনতা নিশ্চিতে পৃথক কমিশন গঠন করেছে। উচ্চ আদালতের মাজদার হোসেন ও অন্যান্য রায়ের আলোকে বিচার বিভাগের অধীনে পৃথক সচিবালয় গঠনের জন্য ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়কেও চিঠি দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। বিচার বিভাগের অধীনে কয়েক মাসের মধ্যে পৃথক সচিবালয় গঠন হবে বলে আশা রাখি।
বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি। রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে সরকারের ইচ্ছা অনুসারেই রায় বা আদেশ হয়- এ ধারণা থেকে বিচার বিভাগকে মুক্ত করতে হবে। বিচার বিভাগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে সংস্কার কমিশনকে উদ্যোগী হতে হবে। ফলে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে নীতিমালা প্রণয়ন ও কমিশন গঠন, বিচার বিভাগের অধীনে নিজস্ব সচিবালয় গঠন, মামলা ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও স্বচ্ছতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
বিচার বিভাগের পৃথককরণ নিয়ে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বর্তমান ড. ইউনূস সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। যাহোক, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস স্যারের আন্তরিকতা এবং বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকার ও তার আইন উপদেষ্টা সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কনসেপ্টটিতে ছাত্র-জনতার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বিচার বিভাগের গঠনমূলক স্বাধীনতা বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর- এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
লেখক: মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম (পিএইচডি গবেষক) কলামিস্ট ও আইন বিশ্লেষক।
মন্তব্য করুন