ঝিনাইদহ সরকারি শিশু হাসপাতাল

কলা বিক্রির টাকায় অক্সিজেন, মানুষের অনুদানের টাকায় হয় বেতন

মো. শাহানুর আলম, ঝিনাইদহ
  প্রকাশিত : ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯:২৬
অ- অ+

নানামুখী সমস্যা নিয়েও শিশুদের ভালো সেবা দিয়ে যাচ্ছে ঝিনাইদহের ২৫ শয্যার সরকারি শিশু হাসপাতালটি। হাসপাতাল চত্বরে আবাদ করা কলা বিক্রির টাকা ও মানুষের অনুদানে চলে চিকিৎসাসেবা। সরকারি উল্লেখযোগ্য কোনো বরাদ্দ না থাকায় চিকিৎসাসেবায় প্রয়োজনীয় যেকোনো জিনিস কিনতে হয় অনুদানের টাকায়।

সরকারি এ শিশু হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৬০ জনের বেশি রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকে। হাসপাতালে চিকিৎসকের ৫টি পদের মধ্যে আছেন তিনজন। ফার্মাসিস্ট, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, রেডিওগ্রাফি, প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক, অফিস সহকারী কাম ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ও স্টোরকিপারের পদও খালি। এছাড়া ২১ জন নার্স পদের বিপরীতে আছেন ১৭ জন। তবে এমএলএসএস, ওয়ার্ড বয়, আয়া, মালি, নিরাপত্তাপ্রহরী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কোনো পদই নেই। তারপরও এসব পদে যে কজন আছেন তাদের বেতন হয় অনুদানের টাকায়।

কিছু ব্যবসায়ী, কয়েকজন চিকিৎসক এবং ডা. আলী হাসান ফরিদের একাধিক বন্ধুর সহায়তায় শয্যা, যন্ত্রপাতি ও জনবল দিয়ে চলছে হাসপাতালটি। ঝিনাইদহের জাহেদি ফাউন্ডেশন নিয়মিত সহায়তা করে। এছাড়া ১৫ জন হৃদয়বান ব্যক্তি কিছু সহায়তা দেন। এরপরও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অক্সিজেন ও ওষুধের যে চাহিদা তার অর্ধেকও বরাদ্দ নেই সরকারের।

২০০৫ সালের ৭ মে ঝিনাইদহ জেলা শহরের টার্মিনাল এলাকায় ২৫ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি এই শিশু হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এরপর রাজনৈতিক বেড়াজালে আটকে বছরের পর বছর বন্ধ থাকে হাসপাতালটি। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০২১ সালের ৯ জানুয়ারি হাসপাতালটি তার সেবা কার্যক্রম শুরু করে।

হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উদ্বোধনের পর হাসপাতালে কোনো সরঞ্জাম না থাকায় কনসালট্যান্ট আলী হাসান ফরিদ তার বাসা থেকে ব্যক্তিগত কম্পিউটার নিয়ে আসেন। ওই কম্পিউটার হাসপাতালের কাজে ব্যবহার করেন এবং শিশুদের চিকিৎসা ও মায়েদের পরামর্শ দেন। এভাবে আস্তে আস্তে হাসপাতালটি আশপাশের এলাকার মানুষের কাছে সুনাম অর্জন করেছে। মানুষ এখন এ হাসপাতালের চিকিৎসাসেবায় আস্থাও রাখেন।

কিন্তু সিভিল সার্জনের কার্যালয় বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাসপাতালটির ওপর কোনো নজর নেই। হাসপাতালের কর্মকর্তারা বারবার অনুরোধ করেও জনবল, যন্ত্রপাতি ও অর্থসহায়তা পান না।

সরেজমিন শিশু হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, বড় প্রবেশ গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা মেলে চারপাশে নানা ধরনের ফুলের বাগান। এর সামনে লাল ইটের দোতলা ভবন। হাসপাতাল চত্বরটি খুবই পরিপাটি করে সাজানো। ভবনের ভেতরে প্রবেশ করে বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল পর্যাপ্ত শয্যা আছে। শয্যাগুলোর গায়ে লেখা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম, যারা এগুলো দান করেছেন।

ঝিনাইদহ সদরের নতুনবাড়ি এলাকা থেকে আসা হীরা খাতুন বলেন, ‘এ হাসপাতালে ভালো চিকিৎসা পাওয়া যায়। আমার বড় ছেলে এখান থেকে সুস্থ হয়েছে। এখন ছোট ছেলে অসুস্থ, তাই এখানে এসেছি। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা দিয়েছিলেন, কিন্তু এখানে কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাইরে থেকে পরীক্ষা করে ডাক্তারকে দেখাতে দুই দিন দেরি হয়ে গেল।’

কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে আসা নাসিমা বেগম বলেন, ‘আমার ১৬ মাসের সন্তানের শ্বাসকষ্ট হলে প্রথম উপজেলা হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে এখানে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়। এখানে এসে সন্তান অনেকটা ভালো আছে। হাসপাতালটি খুবই সুন্দর, সেবার মানও ভালো।’

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন পর চালু হলেও নানা সংকট রয়েছে হাসপাতালটিতে। নেই পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য কোনো ল্যাব। হাসপাতালে ভর্তি থাকার পরও বাড়তি টাকা খরচ করে বাইরে থেকে পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। এতে ভোগান্তির পাশাপাশি বাড়তি টাকা খরচ হচ্ছে। তাই দ্রুত হাসপাতালটিতে পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য ল্যাব চালু করার দাবি রোগীর স্বজনদের।

কনসালট্যান্ট আলী হাসান ফরিদ বলেন, ‘হাসপাতালে নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যা নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের জন্য বছরজুড়ে কৃত্রিম অক্সিজেনের দরকার হয়। এতে বছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার অক্সিজেন লাগে। সরকারের কাছ থেকে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা পাওয়া যায়। হাসপাতালে পড়ে থাকা তিন বিঘার মতো জমিতে চাষ করা কলা বিক্রি করে গত বছর আশি হাজার টাকার অক্সিজেন কেনা হয়। এ বছরও তাই করতে হবে। হাসপাতালে রাতের নিরাপত্তার জন্য লাইট ও অন্যান্য জিনিসপত্র কলা বিক্রির টাকা দিয়েই কিনতে হয়।’

ওষুধ, অক্সিজেন এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে হয় মানুষের অনুদানের টাকায়। জনবল ও অন্যান্য সহযোগিতার জন্য সিভিল সার্জন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখায় অনেকবার আবেদন জানালেও কোনো কাজ হয়নি সবলে জানান আলী হাসান।

ঝিনাইদহ সিভিল সার্জন ডা. হাদী জিয়া উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘হাসপাতালটিতে সাধারণত রোগী থাকে ৬০ থেকে ৭০ জন। আর ছোট বাচ্চাদের সবারই অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। আমাদের শিশু হাসপাতালে সরকার থেকে যে পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করা হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় যথার্থ না। ২৫ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে জনবলের যে সংকট সে বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রতি মাসেই আমরা চিঠি পাঠাচ্ছি। বড় কোনো নিয়োগ হলে হয়তো ডাক্তারের সংকট সমাধান করা যাবে।’

(ঢাকাটাইমস/৫জানুয়ারি/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
দিল্লিতে ৪ মাত্রার ভূমিকম্প, উত্তর ভারতজুড়ে তীব্র কম্পন
দুদিনের কর্মসূচি শুরু আজ: দাবি আদায়ে সরকারকে চাপ প্রয়োগসহ বিশ্বে তিস্তার দুঃখ তুলে ধরা হবে
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক পাচ্ছেন দুজন গবেষক ও এক প্রতিষ্ঠান
চট্টগ্রামে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেত্রীকে পুলিশের দিলেন বৈষম্যবিরোধীরা
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা