প্রকৃত তারকা বাদ দিয়ে আমরা কাদের পিছনে ছুটছি?

বর্তমান পৃথিবীতে মানুষ স্টার, সেলিব্রেটি, জনপ্রিয়, মডেল ও তারকাসহ যে নামেই হোক না কেন এসবের পিছনে ছুটছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেকে জানান দিতে মানুষ কত না অদ্ভুত কাণ্ড-কীর্তি করে বেড়াচ্ছে। অনেকে আবার ধারাবাহিকভাবে পরিশ্রম করে কাজ করার পরিবর্তে হঠাৎ জনপ্রিয়তা অর্জনের পিছনে ছুটছে। কেউবা তৎক্ষণাৎ জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্যে নিয়ম-কানুন ও বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করেও বেফাঁস মন্তব্য করে ভাইরাল হওয়ার অপচেষ্টায় মত্ত রয়েছেন। সমাজে ভাইরাল হওয়ার বা ভিউ বাণিজ্যের কবলে পড়ে সামাজিক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। বাইচান্স এ ধরনের জনপ্রিয়তা অর্জন আদৌ কারো জন্য সম্মানের বিষয় হতে পারে না। সামাজিক এসব অসংগতির মাঝেও পৃথিবীতে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি রয়েছেন, জনপ্রিয়তা তাদের পিছনে ছুটলেও তারা কখনো জনপ্রিয়তার পিছনে ছোটে না বরং তারা এটাকে খ্যাতির বিড়ম্বনা মনে করে। তারা সামাজিক মাধ্যমকে স্রেফ যোগাযোগের মাধ্যম ব্যতীত কিছুই ভাবেন না। এমনই একজন হলেন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহলের সেন্ট্রাল প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সরকার অনুমোদিত ও রিকমেন্ডেড অর্গানাইজেশন প্রতিভা এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সোসাইটির চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। তিনি গত প্রায় এক মাসেরও বেশি সময়ব্যাপী অসুস্থ থাকায় লেখালেখি হতে নিজেকে বিরত রাখতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি অসুস্থ হওয়ার পূর্বের লেখনি হতে এ প্রবন্ধটি হুবহু প্রকাশ করা হলো:
টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার, ছোট ছোট তারকাগুলো মিটি মিটি জ্বলে। অন্ধকার রাতে তারকারাজি দেখতে কত না ভালো লাগে। অন্ধকার হলেই মনে হয় তারকাগুলো কোথায় লুকালো। বাবা-মায়ের আদরের শিশু কথা বলা শিখলেই তাকে আকাশের পানে তাকাতে বলে এটা দেখ, এটা তারকা। এই তারকা নিয়ে পৃথিবীর মানুষের কত আগ্রহ, কত গল্প, কত উপন্যাস। অন্ধকার রাতে চাঁদ নিয়ে এত বন্ধনা নয়। অন্ধকার রাতে সূর্য নিয়ে বন্ধনা নয়। কারণ চন্দ্র বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করে, সূর্যও চন্দ্রের মতোই। চন্দ্রগ্রহণ হয়, সূর্যগ্রহণও হয়। তারকাগ্রহণ হয় না, তারকা সর্বদাই আলোর প্রতীক। পথ চলতে আলোর প্রয়োজন হয়। তারকা পথ চলতে আলো দিয়ে সাহায্য করে। তারকা জ¦ল জ¦ল করে আলো দেওয়ার প্রতীক।
দুনিয়ার তারকাদের আবার গণ্ডি বা কাজের সীমানা রয়েছে। যেমন—হলিউড, বলিউড, টালিউড ও ঢালিউড। কেউবা আবার আরো ছোট গণ্ডি নিয়ে বা যত উড আছে তাদের, সেখানে নাচ, গান, কেউবা সামাজিক মাধ্যমনির্ভর কাজ করে থাকেন। দুনিয়াতে যত উডগুলোতে বা সিনেমা তৈরি করে, কিংবা সামাজিক মাধ্যমে তারকাখ্যাতি পেয়েছেন বা পাওয়ার চেষ্টায় ঘুম হারাম করছেন। এদের একটা অংশ বেহায়াপনা বা নেতিবাচক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকে। এদের অনেকে আবার যৌন উত্তেজক কন্টেন্ট তৈরি করে থাকেন।
তবে নগণ্য ক্ষেত্রে হলেও কেউবা শিক্ষণীয় নাটিকা, জনসাধারণের উপকারার্থে বিভিন্ন তথ্যবহুল কন্টেন্ট তৈরি করে থাকেন। এটা অবশ্যই প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে।
এরা নিজেদেরকে মডেল ডাক শুনতে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকেন। এই মডেল ও তারকাদেরও আবার মডেল/তারকা রয়েছে। যেমন–তাদের কেউবা ইউনিভার্সেল স্টার বা বিশ্ব তারকা/মডেল বা আদর্শ। যেমন-অঞ্জলীনা জোলি, ব্রাডফিটসহ আরো অনেকে। কেউবা আবার তাদের উপমহাদেশীয় তারকা ও মডেল যেমন-শাহরুখ খান, সালমান খান ও ক্যাটরিনা কাইফ প্রমুখ। তথাকথিত তারকাদের একটা অংশ গ্রেডের দিক থেকে বিভিন্ন শ্রেণির হলেও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে প্রায় একই। এরা যেন একে অপরের যমজ ভাই। অজ্ঞতার দিক থেকেও এরা প্রায় একই। যেমন-এদের একটা অংশ বেহায়াপনা বা নেতিবাচক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকলেও এরা সবাই নিজেকে শিল্পী বা আর্টিস্ট বলেও গর্ববোধ করে থাকে। এ কারণে তথাকথিত তারকাগুলো/মডেলগুলো হয়তবা ইতর প্রাণীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে অর্ধনগ্ন হওয়া শিক্ষা গ্রহণ করেছিল দীর্ঘকাল পূর্বে। এ পৃথিবীর ধার্মিক মানুষগুলোকে সাধারণত ইবলিস শয়তান প্রায়শ বিরক্ত করে বিধায় যথাযথভাবে কার্যক্রম করতে বেগ পেতে হয়। এ তথাকথিত তারকাদের একটা অংশের বড় সুবিধা হলো ইবলিস শয়তান এদেরকে কেবল পরম বন্ধুই ভাবে না, বরং এদেরকে ওস্তাদ মনে করে, কারণ এদের বেহায়াপনা দেখে শয়তানও হতবাক।
এসব তথাকথিত তারকাদের একটা অংশ এতটা মানবিক যে, এরা বিয়ে করার মাস, বছর না পেরোতেই তালাক দেওয়া যেন এদের রুটিন কাজ। একটা অংশ মানবিকতার দিক থেকে আরো একধাপ এগিয়ে, এদের স্ত্রীগণ প্রকাশ্য দিবালোকে স্বামী দাবি করাটা অনেক বড় অপরাধ। এদের স্ত্রীগণ এদেরকে তাদের সন্তানের পিতা জনসম্মুখে দাবি করা অনেক বড় অপরাধ। এসব তারকা এতটা তথ্য অধিকারে বিশ্বাসী যে এরা স্বামী-স্ত্রী কি করেছে এটাও সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করে থাকেন। হয়তবা এটা তাদের কাছে তথ্য অধিকার আইনে বৈধ বলে প্রতীয়মান হয়। যা আমার জানা নাই। তথাকথিত তারকাদের একটা অংশ এতটা ডোন্ট মাইন্ড পরিবার থেকে আগত যে, বাবার সঙ্গেও স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করতে পারে স্বাচ্ছন্দ্যে। এদের একটা অংশ এতটা বাক স্বাধীন যে, স্বাচ্ছন্দ্যে টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে বলতে পারে আমার ছোট বেলায় শখ ছিল আব্বুকে বিয়ে করব। এদের পোশাক আশাক এতটা মিতব্যয়ী যে, চেরা-পাটা তালি দেওয়া প্যান্ট ও শার্ট পরা, যা একজন রুচিশীল ভিক্ষুকও পরিধান করে না।
সৃষ্টিকর্তা মানুষকে অনুসরণ ও অনুকরণ করার জন্য হযরত আদম (আ.) হতে শুরু করে শেষনবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম পর্যন্ত সকল নবী-রাসূল দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। তারা শতভাগ আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্দেশিত সীমারেখা মেনে চলেছেন। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের সাহাবী বা সঙ্গী যারা ছিলেন তারা কখনো সীমা লঙ্ঘন করতেন না। তাদের মধ্য হতে যে সবচেয়ে দুর্বল ও পেছনের কাতারে ছিলেন, আমরা তাকেও অনুসরণ করতে পারলে এ দুনিয়াতে ও পরকালে সফল হতে পারব। এরাই তো আমাদের প্রকৃত সুপার স্টার বা মডেল।
এরা এত বেশি জ্ঞানী যে, এদেরকে নামাজ পড়া বা পর্দাসহ অন্য কোনো ইবাদত বন্দেগী করার কথা বললে এরা বলে মনের পর্দা বড় পর্দা, আরো বলে মনে শয়তানি থাকলে নামাজ পড়ে লাভ কি? এসব ভুয়া মডেলদের চেনার আরেকটা উপায় হলো এরা সদাসর্বদা আত্ম প্রচার এবং নিজেদেরকে জাহির করার চেষ্টা করে থাকেন।
তবে প্রকৃত মডেল নিশ্চয়ই পৃথিবীতে এখনো বিদ্যমান আছে। যার মধ্যে আল্লাহর ভয় যত বেশি বিদ্যমান, সে তত বড় মডেল বা স্টার যা-ই বলি না কেন। মডেল বা আদর্শ চেনার আরেকটা উপায় হতে পারে যার মধ্যে ইতর প্রাণীদের মধ্যকার পার্থক্য যত বেশি সে তত বড় আদর্শ হতে পারে, যার সঙ্গে ইতর প্রাণীর সাদৃশ্য যত বেশি সে তত বড় ভুয়া মডেল। এখন অবশ্য নতুন ধরনের মডেল বের হয়েছে, যারা নিজের সন্তান ও স্বামীকে বাদ দিয়ে কুকুরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে পছন্দ করেন।
একজন রিকশাওয়ালা বা কুলি-মজুর যিনি দিনে এনে দিনে খান, তার মেকআপ লাগানো দূরে থাকুক একদিন কর্ম না করলে অন্ন জোটে না, এমন একজন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি ব্যক্তির চেহারার দিকে প্রকৃত পক্ষে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে যদি তাকিয়ে দেখা হয়, যে পরিমাণ নুরের ঝলক বা আল্লাহ প্রদত্ত মেকআপ দেখতে পাওয়া যাবে। অন্যদিকে বিশ্বখ্যাত একজন তথাকথিত স্টার/মডেল বা আদর্শ যা বলি না কেন, যার সামাজিক মাধ্যমে প্রতিটি কন্টেন্টে কয়েক কোটি ভিউ হয়, যার মুখে লাগানো কৃত্রিম মেকআপ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করার পর নিরপেক্ষভাবে যদি তাকিয়ে দেখা হয়, যে চেহারাটা দীর্ঘদিন কোটি টাকা খরচ করে পরিচর্যা করেছে, অনেকে আবার কসমেটিক্স সার্জারি বা প্লাস্টিক সার্জারিও করেছেন এমন ব্যক্তিও হতে পারে, যেমন মাইকেল জ্যাকসন। বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই ধরনের ব্যক্তির চেহারা নিরপেক্ষভাবে দেখার পূর্বে বমির ট্যাবলেট খেতে ভুলবেন না কিন্তু।
পৃথিবীর ধর্মগুলোতে উল্লেখযোগ্য ধর্ম প্রচারক ও আদর্শবান ব্যক্তিদেরকে তারকার সঙ্গে তুলনা করা হয়। মুসলিমদের ধর্মীয় কিতাবসমূহে সাহাবীদেরকে অনুকরণ ও অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। তাদেরকে আমাদের জন্য তারকা হিসেবে মেনে নিতে বলা হয়েছে। বর্তমান পৃথিবীতে তারকা খ্যাতি পাওয়ার জন্য মহাদেশে-মহাদেশে, দেশে-দেশে মানুষ কত কাণ্ড করে বেড়াচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও কত ঘটনাই বা ঘুরপাক খাচ্ছে। আকাশের তারকারাজি আলোকিত হলেও পৃথিবী নামক গ্রহের মানুষরূপি তারকারা বেশিরভাগই অন্ধকারাচ্ছন্ন কাজই করে বেড়াচ্ছেন।
এ ধরনের ব্যক্তি যারা নিজেদেরকে স্টার বা মডেল মনে করে থাকেন অথবা মডেল হওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করে থাকেন, তারা নগ্নতাকে স্মার্ট মনে করেন। তারা একবারও কি ভাবেন না যে, নগ্ন হওয়া মানে স্মার্ট হলে ইতর প্রাণী যেমন– কুকুর সবচেয়ে বড় স্মার্ট। ভাষাগত দিক থেকে এরা হাই, ব্রো, মর্নিং ইত্যাদি বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। খাওয়া দাওয়ার দিক থেকে এরা সারা বছর ফাস্টফুড খেতে পছন্দ করলেও বাংলা নববর্ষের দিন তিন দিনের পচা পান্তা ভাত খেয়ে অনেক বড় বাঙালি সাজে। ইংরেজি নববর্ষের দিন এরা এবং এদের অনুসারীরা অনেক বড় ইংলিশম্যান। গভীর রাতে এদের এবং অনুসারীদের আতশবাজি ও ককটেলের কারণে সবার ঘুম হারাম। এরা এতটা স্মার্ট যে, এটুকু বোঝারও বোধশক্তি নাই যে, প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি রয়েছেন। এরা এবং এদের অনুসারীরা সময়েরও তোয়াক্কা করেন না। এরা এবং এদের অনুসারীরা ঘুমায় ফজরের আজানের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এবং ঘুম হতে উঠে প্রায় দুপুর ২টার দিকে। মহান ভাষা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারিতে এরা এবং এদের অনুসারীদের দরদ খুব উতলে উঠে। ইংরেজি না জানলেও এরা ভাংগা ইংরেজি সারা বছর বলে থাকেন। এসমস্ত তথাকথিত স্টার বা আদর্শদেরকে সালাম দিলে এরা উত্তর দেয় হায়। এসব তথাকথিত তারকার পিছনে ছোটা মানে মরুভূমির মরীচিকার পিছনে ছোটা নয়কি ?
পরিশেষে উদাত্ত আহ্বান, আসুন তথাকথিত স্টারদের পিছনে না ছুটে ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহলের সেন্ট্রাল প্রেসিডেন্ট ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের তত্ত্ব অনুযায়ী কেবলমাত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নয়, বরং হাতে হাত রেখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সকলের অংশগ্রহণে উৎসবমুখর পরিবেশে গণসচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে মাদক মুক্ত বিশ্ব গড়তে এগিয়ে আসি। এসো নেশা ছেড়ে কলম ধরি, মাদকমুক্ত সমাজ গড়ি।
লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন, কর্ডিনেশন অফিসার ও রাসেল বাবু, অ্যাসিস্ট্যান্ট কর্ডিনেশন অফিসার
আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টি অ্যালকোহল বাংলাদেশ শাখা

মন্তব্য করুন