কুমিল্লা টাউনহল মাঠে ঐতিহ্যের হা-ডু-ডু, কুস্তি খেলা, দর্শকদের উপচেপড়া ভিড়

নববর্ষ মানেই উৎসব আর সেই উৎসবের রঙ ছড়িয়ে দিয়ে কুমিল্লা মহানগর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির ব্যতিক্রমী আয়োজনে টাউনহল মাঠে ফিরে এলো বাংলার ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলা হা-ডু-ডু ও বলী-কুস্তি। মাঠজুড়ে যেন ছিল উল্লাস আর আবেগের এক প্রাণবন্ত দৃশ্য। কুমিল্লা টাউনহল মাঠজুড়ে ছিল হাজারো মানুষের ঢল। কেউ এল গা ছমছমে হা-ডু-ডু দেখতে, কেউ এল বলী কুস্তির দারুণ লড়াই উপভোগ করতে। চারপাশে মানুষের গর্জন—শহরের বুক জুড়ে যেন মাটির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল নববর্ষের হাওয়ায়।
বুধবার বিকাল থেকে কুমিল্লা মহানগর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির উদ্যোগে এই গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী হা-ডু-ডু ও বলী-কুস্তি খেলার আয়োজন করা হয়। এই আয়োজন কেবল খেলা নয়, এক আত্মার উৎসব।
কুমিল্লা মহানগর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ যেন শহরের প্রাণে এক অন্য রকম উত্তাপ ছড়িয়ে দেয়। সন্ধ্যা নামে, আলো ঝলমলে মাঠে শুরু হয় বাংলার চিরায়ত খেলাগুলোর প্রাণভোমরা—বলী কুস্তি।
হা-ডু-ডু-তে ছিল গতি, বলীতে ছিল গর্জন
বিকাল ৪টা থেকে হা-ডু-ডুর সূচনা হয়। খেলোয়াড়দের নিঃশ্বাসে লড়াই, দর্শকের হাততালিতে উত্তেজনা। শেষমেশ লাল দলের জয়জয়কার। এরপর শুরু হয় রাতের চমক বলী-কুস্তি।
মাঠে তখন নামেন কুমিল্লার পরিচিত সব পরিচিত ও জনপ্রিয় কুস্তিগির—কামাল মাল, টাওয়ার শামীম, ড্যান্সার কালিয়া, রাশেদ মালসহ আরো অনেকে। প্রতি ম্যাচ ১০ মিনিট, কিন্তু উত্তেজনা যেন পুরো রাতজুড়েই বজায় থাকে। পাল্লা দিয়ে চলে লড়াই—পূর্ব দল বনাম পশ্চিম দল।
কুস্তিগির কামাল মাল বলেন, “আজকের মাঠের সেই গর্জন, মানুষের ভালোবাসা—আমার দীর্ঘদিনের খেলোয়াড়ি জীবনে এমন দিন খুব কম এসেছে। শহরে থেকেও আমরা যেন আজ গ্রামে ফিরে গেছি। বলী খেলাটা শুধু শরীর নয়, এটা আত্মার লড়াই।”
সাবেক বলী খেলোয়াড় আবু সাইদ দায়িত্ব পালন করেন রেফারি হিসেবে। তার তীক্ষ্ণ চোখ আর অভিজ্ঞতা ম্যাচগুলোকে করে তোলে আরও জমজমাট ও নিরপেক্ষ। মাঠের একপাশে ধ্বনিত হয় বাঁশি, অন্য পাশে গর্জে ওঠে হাজারো কণ্ঠ—“আরেকটা রাউন্ড দে!”
কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ মোল্লা টিপু বলেন, “ঐতিহ্য হচ্ছে আত্মার শক্তি। আজকের এই আয়োজন আমাদের শিকড়ের দিকে ফিরে যাওয়ার ডাক। আমরা শুধু রাজনৈতিক সংগঠন নই—আমরা কুমিল্লার সংস্কৃতির সেবক হতে চাই।”
এই খেলা দেখতে কুমিল্লা জেলার দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন নানান বয়সী দর্শক। কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সবাই উপস্থিত ছিলেন দর্শকদের সারিতে৷
হোমনা থেকে খেলা দেখতে আসা ৭৫ বছর বয়সী সাহেদ উল্লাহ বলেন, “আমার নাতিকে নিয়ে এসেছি। ও তো কুস্তি দেখেই না! আজ যখন মাঠে কামাল মাল আর টাওয়ার শামীম লড়ছে, ওর চোখে আমি আগুন দেখেছি! এটাই তো দরকার—আমাদের ছেলেমেয়েরা যেন জানে আমরা কে, কোথা থেকে এসেছি।”
ভিক্টোরিয়া কলেজ শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন বলেন, "এমন খেলা সচরাচর দেখাই যায় না। আজ দারুণভাবে উপভোগ করেছি খেলা। আধুনিক যুগে এসেও এমন খেলা আমাদের ঐতিহ্য মনে করিয়ে দেয়। কিছু সময়ের জন্য মনে হচ্ছিল এই বুঝি আশি কিংবা নব্বই এর দশকে ফিরে গিয়েছি।”
পুরো মাঠ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ, অনেকেই দাঁড়িয়ে খেলা দেখেছেন। এমনকি মাঠের বাইরে থেকেও মানুষ উঁকি দিয়েছে ভিড়ের ফাঁক গলে। খেলার শেষে বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় অর্থ পুরস্কার ও সম্মাননা।
এই আয়োজন প্রমাণ করল, ইট-পাথরের শহরেও মাটির টান মরে না। হাইরাইজ আর কংক্রিটের মাঝে এখনো আমরা খুঁজে পাই শিকড়, ঐতিহ্য আর আত্মার চিহ্ন। কুমিল্লা দেখিয়ে দিল, হারিয়ে যাওয়া কিছুই নয়—বাঁচিয়ে রাখতে জানলে সবই ফিরে আসে।
এসময় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিন, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আশিকুর রহমান মাহমুদ ওয়াসিম, কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সভাপতি উদবাতুল বারী আবু, কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ মোল্লা টিপু, সাবেক এমপি আব্দুল গফুর ভূঁইয়া, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার জাহান দোলন, কুমিল্লা মহানগর বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক শওকত আলী বকুল।
(ঢাকাটাইমস/১৭এপ্রিল/এফএ)

মন্তব্য করুন