কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন

বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায় রচনা করেছে ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের দাবির আন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। আর সেই অভ্যুত্থানেই অবসান হয় স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনের। ইতিহাসে এই গণআন্দোলন চিহ্নিত হয়ে আছে ‘৩৬ জুলাই আন্দোলন’ নামে।
২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্টের এক রায়ে সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল হলে ছাত্রসমাজ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ। প্রথমদিকে এটি সীমাবদ্ধ ছিল ঢাকা ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়-ক্যাম্পাসে; কিন্তু সরকারের কঠোর অবস্থান ও দমনপীড়নে পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে পড়ে।
তবে বিক্ষোভের অনলে ঘি ঢালেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজেই। কথায় কথায় যারা আন্দোলন করছেন তাদের রাজাকার বানিয়ে দেন। তিনি আন্দোলনরত ছাত্রদের রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দেন। ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার ‘রাজাকার’-সংক্রান্ত এক বক্তব্য ও শিক্ষার্থীদের দাবিকে আইন-আদালতের চক্করে ফেলার পর তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সেদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে এসে স্লোগান দেওয়া শুরু করেন—‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে ওঠে।
১৫ জুলাই থেকে ছাত্রলীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর দমন চালাতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, জাহাঙ্গীরনগরসহ দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, গ্রেপ্তার, এমনকি গুলিবর্ষণও শুরু হয়। ১৬ জুলাই নিহত হন আবু সাঈদ, ওয়াসিমসহ ছয়জন।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একে একে যোগ দেন শিক্ষক, অভিভাবক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী, শিল্পী ও সাধারণ মানুষ। ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা করে ৯ দফা দাবি উত্থাপন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
আন্দোলনের শীর্ষ ছয় নেতা—নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের ও নুসরাত তাবাসসুমকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের পর জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও বার্তা রেকর্ড করানো হয়। ১ আগস্ট তারা মুক্তি পান এবং আন্দোলন আরও তীব্র হয়।
৩ আগস্ট শেখ হাসিনা আলোচনার প্রস্তাব দেন, কিন্তু শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখ্যান করে। ৫ আগস্ট ঢাকামুখী গণজোয়ার নামে। দেশজুড়ে সংঘর্ষে আরও বহু প্রাণ হারায়। সরকারের পতন তখন কেবল সময়ের ব্যাপার।
৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ছোট বোন শেখ রেহানাসহ গোপনে দেশ ত্যাগ করেন। জনতা বিজয় মিছিলে ফেটে পড়ে। গণভবনে ঢুকে পড়ে বিক্ষুব্ধ মানুষ। শাসকের প্রাসাদ আর রক্ষা করা যায়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, ১৫ বছর ধরে দেশজুড়ে যে অবিচার ও অরাজকতা তৈরি হয়েছিল, মানুষ তা থেকে মুক্তি চেয়েছিল, যা মানুষের মধ্যে একটি মানসিক ঐক্য তৈরি করেছে। আর সেই ঐক্যের ফলই গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থান। কোটা সংস্কার আন্দোলন গণমানুষের আন্দোলনে রূপ দিতে পারাটাই ছিল সবচেয়ে বড় সফলতা।
(ঢাকাটাইমস/৫ আগস্ট/আরজেড)

মন্তব্য করুন